শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার স্বপ্ন বুকে নিয়ে আমাদের পথচলা
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:৫৮
অধ্যাপক তাসনীম আলম : আমাদের প্রিয় নেতা আবদুল কাদের মোল্লা এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তিনি আমাদের হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে আছেন এবং থাকেন। চিরদিন তিনি বেঁচে থাকবেন ইসলামপ্রিয় জনতার মাঝে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রেরণার উৎস হয়ে।
তাঁর শাহাদাতের পর আমি লিখেছিলাম, পাক-ভারত উপমহাদেশে ইসলামী আন্দোলনের একজন নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করার ঘটনা ইতিহাসে এই প্রথম। এই প্রথমই যদি শেষ হতো, তাহলে কত না ভালো হতো! কিন্তু মানুষের ভাবাগুলো সবসময় সত্য হয় না। আমার ভাবনাটিও সত্য হলো না। শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার জান্নাতি পথে চিহ্ন অনুসরণ করে একই পথে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করে শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ধন্য হলেন আমাদের আরো দুজন প্রাণপ্রিয় নেতা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও শহীদি কাফেলা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী লেখক ও সাংবাদিক মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সফল সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। উল্লেখ্য, শহীদ আবদুল কাদের মোল্লাও একজন সাংবাদিক ছিলেন। তিনি ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে পরপর দুই বছর তৎকালীন অভিন্ন ঢাকা ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট (ডিইউজে)-এর সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। মনে হয় এই তো সেদিন, ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১ মিনিটে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এ সময় আমিসহ আমাদের শত শত নেতাকর্মী কাশিমপুর জেলখানায় ছিলাম। মোল্লা ভাইয়ের ফাঁসির খবর শুনে কর্মী ভায়েরা মহান আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে সময় কাটিয়েছে। অনেকে জেলখানার অন্ধ প্রকোষ্ঠে বসে নীরবে-নিভৃতে কেঁদেছে। জেলখানায় বসে মোল্লা ভাইয়ের ফাঁসির যেসব খবরাদি পেয়েছি, পত্রপত্রিকায় যেসব খবর এসেছে, তাতে আমরা চরম দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও অনুপ্রাণিত হয়েছি। ফাঁসির রশি গলায় নিয়ে তিনি যেভাবে স্বাভাবিক ছিলেন তা অনেককেই বিস্মিত করেছে। শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা যে একজন সাচ্চা মুমিন ছিলেন- এটাই তার প্রমাণ।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী থাকা অবস্থায় আবদুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের নাম শুনেছি। তার আলোচনা শুনে মুগ্ধ হয়েছি। বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে তিনি খুব যুক্তিপূর্ণ আলোচনা রাখতেন। বিশেষ করে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তার আলোচনা হতো খুবই জ্ঞানগর্ভ ও যুক্তিপূর্ণ।
শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ভাইকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে ২০০২ সাল থেকে। আমার আগে আবদুল কাদের মোল্লা ভাই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ছিলেন। এরপর তার ওপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব অর্পিত হয়। আর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব আসে আমার ওপর। প্রচার বিভাগের অফিস কেন্দ্রীয় অফিসের নিচতলায়। তিনি আগে নিচতলায় বসতেন। এরপর নতুন দায়িত্ব আসায় ওপরে বসতেন। কিন্তু জোহরের নামাজের সময় প্রায়ই প্রচার বিভাগের বাথরুমে অজু করতেন এবং নামায পড়ে এসে আবার বসে কিছু সময় কথাবার্তা বলতেন। আমরা তার ছাত্র অথবা ছোট ভাইয়ের মতো কথাগুলো শুনতাম। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোক তার সাথে কথা বলতে আসতেন। তিনি অনেক সময় আমার রুমে বসে কথা বলতেন। আমি তার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে বাইরের রুমে বসে কাজ করতাম। মোল্লা ভাইয়ের ডায়াবেটিস ছিল। ডায়াবেটিক রোগীদের নিয়ম মতো খাওয়া-দাওয়া করতে হয়। কিন্তু বাসায় যাবার সময়ও যদি কেউ কথা বলতে চাইতেন, তাহলে তিনি বসে কথা বলতেন। ভুলে যেতেন তাকে সময়মতো খেতে হবে। আমরা অনেক সময় কৌশল করে বাসায় যাবার কথা স্মরণ করে দিতাম।
মোল্লা ভাই বিজ্ঞানের ছাত্র এবং আধুনিক শিক্ষিত হওয়ার পরও পায়জামা-পাঞ্জাবি ও টুপি পরতেন। তবে পোশাক ছিল মার্জিত ও রুচিসম্মত। মোল্লা ভাই প্রেস ক্লাবের সদস্য ছিলেন। প্রেস ক্লাবে গেলে বিভিন্ন মত ও পথের সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরতো। সবার প্রিয় মোল্লা ভাইও উৎফুল্ল চেহারায় হাসিমুখে নানা প্রশ্নের জবাব দিতেন। মোল্লা ভাই খুবই মিশুক ছিলেন। সবার সাথে খোলামনে মিশতেন। কী রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী সকল শ্রেণি-পেশার লোকের সাথে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। সমাজের কত লোকের সাথে যে তার সম্পর্ক ছিল, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। কীভাবে যে তিনি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নেতৃস্থানীয় লোকদের সাথে সম্পর্ক করতেন এবং তা রক্ষা করতেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। তিনি ছিলেন সবার মোল্লা ভাই। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মোল্লা ভাইয়ের ভূমিকা ছিল অনন্য। তিনি স্পষ্টবাদী ছিলেন। যুক্তিবাদী ছিলেন, ছিলেন অসীম সাহসী। রাজনৈতিক অঙ্গনে আবদুল কাদের মোল্লা ছিলেন একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। একজন জাতীয় নেতা।
কত স্মৃতি, কত কথা আজ মনে মনে, ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার চত্বরে ইসলামী ছাত্রশিবিরের তিনজন নেতা শাহাদাত বরণ করেন। সেই নির্মম ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিক হিসেবে তিনি একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল, ‘শোক করিয়া লাভ নাই, শহীদি খুনের নাজরানা চাই।’ সত্যি সত্যি তিনি নিজের লেখার শিরোনামকে জীবন দিয়ে বাস্তবায়ন করে গেলেন। তিনি লিখেছেন, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, পশুত্বের বিরুদ্ধে মানবতার, অমানুষের বিরুদ্ধে মানুষের, সর্বোপরি কুফরির বিরুদ্ধে ইসলামের সংগ্রামের ইতিহাস এভাবেই রক্তের আখরে লেখা। কোনো নবীই এ পথ এড়াইতে পারেন নাই, কোনো মুজাহিদের জন্যই ভিন্ন পথ ছিল না, কোনো ইমামও অন্যপ্রকার পুষ্প আচ্ছাদিত পথের কথা চিন্তাও করেন নাই। সুতরাং এ যুগেও যাহারা ঐ একই পথের যাত্রী বলিয়া দাবি করে, তাহাদের পথ ভিন্নতর কিছু হইবে কেমন করিয়া। ইসলামের গোটা ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে যেন আমার মনে হয়, ইসলাম নামই শ্যামল সতেজ গাছের রং সারের অভাবে যখনই ফিকা পিঙ্গল হইয়া গিয়াছে, তখনই শহীদের তাজা রক্তের সার দিয়া গাছটিকে আবার তরতাজা করিয়া ফুলে ফলে সুশোভিত করা হইয়াছে। সুতরাং ভয়ের কিছু নাই। শঙ্কার কিছু নাই। আক্ষেপেরও কিছু দেখিতেছি না। বরং দিব্যদৃষ্টিতে যেন দেখিতেছি এ দেশেই ইসলামের কালেমা খচিত বিজয়ী পতাকা শহীদদের রক্তের মিনারের চূড়ায় পতপত করিয়া উড়িতেছে। শহীহ শাব্বিরের পিতার অসামান্য ধৈর্য দেখিয়া আমার ঈমান ইয়াকীনে পরিণত হইতেছে।… অন্যথায় শুধু বুক চাপড়াইয়া শহীদদের জন্য শোক করিয়া কোনো লাভ নাই। আজ একটি গজলের কলিগুলো বড় আবেগাপ্লুত কণ্ঠে গাহিতে ইচ্ছা করিতেছে,
তোরি দেশের বাঁকে বাঁকে
লক্ষ শহীদ আজো ডাকে
তবু কি তুই রইবি বেহুঁশ
আজি একথার জবাব যে
চাই।”
জবাব দিতে হইলে মুখের কথায় অথবা মিটিং-মিছিল আর প্রতিবাদ সভায় কাজ হইবে না। ঈমানের আলোতে প্রজ্জ্বলিত বক্ষের তাজা শহীদি খুনের নাজরানা চাই।’
আমরাও শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের এ দীপ্তবাক্য আর স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে ইসলামী আন্দোলনের কঠিন পথে এগিয়ে চলছি। ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আজন্ম লালিত স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে।