ভারত বাংলাদেশের সনাতনীদের বাংলাদেশি হতে দেয়নি
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:০৩
১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানের সাথে প্রতিবেশী ইন্ডিয়ার সম্পর্ক কখনো ভালো ছিল না, অর্থাৎ একদিনের জন্য সৎ-প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক ছিল না। কারণটা কী ? কারণটা বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব মোহাম্মদ আসফউদ্দৌলাহর বক্তব্য থেকে জেনে নিন। কয়েক বছর পূর্বে জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি বলেছেন, ১৯৪৭ সালে ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুকে দেশ বিভাগ তথা ভারত মাতার বিভক্তির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি সোজাসুজি বললেন, “We hereby decided to accept the present partition for the timebeing.” এটা পাকিস্তানের জন্য ‘আইরনি অব ফেট’। অথচ দীর্ঘদিনের চিন্তা-ভাবনা, জ্ঞান-গবেষণা, শুদ্ধচিন্তা, অশুদ্ধ চিন্তা, কল্যাণ ও অকল্যাণ চিন্তা সবকিছু মিলিয়ে ধারণা করা হয়েছিল টু নেশন থিওরির মাধ্যমে এ ভাগাভাগিটা সম্ভব হয়েছিল। বড় বাড়িটা অর্থাৎ ভারতবর্ষকে ভাগাভাগি করে নিলে কিয়ামত পর্যন্ত দুটি বড় জাতি নিজেদের জাতিসত্তা ও আত্মপরিচয়সহ স্বস্তি, শান্তি, সুখ ও আনন্দের সাথে বসবাস করতে পারবে।
একটি জাতি ছিল এমবিসাস এবং আরেকটি জাতি ভেবেছিল এখন থেকে তারা নিজেদের মনন চর্চায় অভিলাষী হতে পারবে। বলতে দ্বিধা নেই, এই ভাগাভাগি বা বিভক্তির সময় বড় ভাই স্বপ্ন দেখেছিল দুর্বল ছোট ভাইকে একটা সময় তারা গলধকরণ করতে পারবে। ওদের কাছে হাজার হাজার বছরের দেশি-বিদেশি পণ্ডিতদের টনটনে জ্ঞান-গরিমা বিদ্যমান ছিল। শেষের দিকে তারা মহাপণ্ডিত চাণক্যকেই অনুসরণ ও অনুকরণ করার দৃঢ় শপথ গ্রহণ করেছিল।
‘বিগ ফিশেস অলওয়েজ সোয়ালোড দা স্মল ফিশেস’- এ রাষ্ট্রনীতির ওপর বেসিস করে বাড়ির পশ্চিম ও পূর্ব অংশে ভাগাভাগিটা ঠিক হয়নি। আমাদের অঞ্চলগুলো ছোট ভাইয়ের দখলে রয়ে গেছে- এ নিয়ে টুকটাক দেনদরবার, সালিশ-নালিশ চলতেই থাকল। ধীরে ধীরে ছোট ভাই পাকিস্তান, কাশ্মীর, হায়দরাবাদ, মানভেদর ও জুনাগড়, কোনো রাজ্যের অংশবিশেষ, কোনো রাজ্যের গোটাটাই বড় ভাই ইন্ডিয়া দখলেই রাখল। অথচ সবাই জানেন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগাভাগি করার মহান আন্দোলনের দাবি চিরকালের জন্য সম্পন্ন করা হয়েছিল।
ছোট ভাই পাকিস্তান ছিল বড় ভাইয়ের পশ্চিম ও পূর্ব অংশে। অথচ দুনিয়ার সবাই জানেন ভারতবর্ষের মুসলিম অঞ্চলগুলো নিয়ে কয়েকটি স্টেট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কৌশলে বড় ভাই ইন্ডিয়া মুসলমানদের জন্য ভারতবর্ষের দুই অংশ মিলে একটি পাকিস্তান গঠন করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল এবং সফল হয়েছিল। ইন্ডিয়ার পূর্ব অংশে পাকিস্তানের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। এখানে বড় ভাই ইন্ডিয়া ভারত বিভক্তি কাল থেকে এখন পর্যন্ত সীমানা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে দেয়নি। বহু অঞ্চল, বহু ধরনের যুক্তি দিয়ে এরা দখল করে রেখেছিল। যুগে যুগে কিছু সীমান্ত নির্ধারণের ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি ও হতাহতকরণ নির্বিবাদে তারা চালিয়েছিল এবং এখনো তা অব্যাহত আছে।
স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল যার নাম ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। সে অঞ্চলের জনগণ স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করল বড় ভাই ইন্ডিয়া তাদের বিপুলভাবে ঠকিয়েছে। ঠকানোর এ প্রক্রিয়াও বৈষম্যপূর্ণ ছিল। এটা ছিল পরিষ্কার আধিপত্যবাদ। উপনিবেশবাদ চলে গেছে, স্থায়ীভাবে আসন গেড়ে বসেছে বড় ভাই ইন্ডিয়ার চরম আধিপত্যবাদ। কয়েক বছর না যেতেই পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ ‘ক্রাশ ইন্ডিয়া’র শুধু স্লোগান তোলেনি, সাথে সাথে শপথও গ্রহণ করেছিল। ‘বিল্ড পাকিস্তান’ এর শপথ গ্রহণ না করে ‘ক্রাশ ইন্ডিয়ার’ শপথ!
যারা এ বয়স্ক, তারা খুব ভালো করে জানেন পাকিস্তানিরা স্কুলে, খেলাধুলায়, গানে-কবিতায়, এ স্লোগান তুলেছিল। পরিবারে পরিবারে, স্কুলে, মাদরাসায় ইন্ডিয়াকে ধ্বংস করার স্বপ্নই তাদের উদ্বেলিত করেছিল। বরাবর ছোট-খাটো বন্দুক তো তাদের সাথেই ছিল। বনে-বাদাড়ে, খেলার মাঠে এবং আকাশকে তাক করে তারা যে খেলনা গুলি চালাতো, তখন তারা উচ্চকিতভাবে স্লোগান দিত ‘ইন্ডিয়া কো খতম কর, চলো চলো দিল্লি চলো’।
ইন্ডিয়া স্তম্ভিত হয়েছিল তাই শুধু নয়, তারা খানিকটা স্তব্ধ হয়েছিল। এরই ফলে পাকিস্তানের প্রচণ্ড চাপের মুখে ইন্ডিয়া পশ্চিম পাকিস্তানকে নদীর পানি সরবরাহ করতে বাধ্য হয়েছিল। ঠিক অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তানে নদীর পানি যাতে অবাধে প্রবেশ করতে না পারে, সে কারণে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করে ফেলল। পাকিস্তান বহু চেষ্টা করে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক প্রেসার ক্রিয়েট করেও পূর্ব পাকিস্তানের পানির অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। একই দেশের জন্য দুই সীমান্তে দুই ব্যবস্থা। যদিও পাকিস্তান অক্ষুণ্ন থাকা অবস্থায় ছোট-বড় বহু বাঁধ নির্মাণ করেও পানির প্রবাহকে তারা বন্ধ করতে পারেনি। এসব নানামুখী আধিপত্যবাদের ধ্বংসাত্মক অপচেষ্টার কারণে ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ও ইন্ডিয়ার মধ্যে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মাত্র ১৭ দিনের যুদ্ধে বিশ্ববাসী অবলোকন করল পাকিস্তান ইন্ডিয়াকে ক্রাশ করতে পারে। তখনই সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ভারত যুদ্ধবিরোধী প্রার্থনায় নিমগ্ন হয়েছিল। পাকিস্তানকে ঠেকানোর অনেক বড় দায়িত্ব ছিল জাতিসংঘসহ প্রতাবশালী রাষ্ট্রসমূহের। সেক্যুলারবিশ্ব জয়ী হয়েছিল। দেশকে বাঁচাতে পেরে আনন্দের আতিশয্যে ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ২৩ সেপ্টেম্বরে যুদ্ধবিরোধী চুক্তি সম্পন্ন করার অল্প কিছু দিন পর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের এখনো মনে আছে পাকিস্তান যেদিন ‘খেমকারান সেক্টর’ দখলে নিয়েছিল সেদিন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রহমান, একটি অপূর্ব কবিতা লিখেছিলেন। যার প্রথম চার লাইন ছিল নিম্নরূপ-
“এই দিন চিরদিন
জনতার চোখে জ্বলবে
সোনাঝরা আগামীর
রূপময় কথা বলবে।”
আমরা টু ন্যাশন তত্ত্ব বিশ্লেষণ করছি না। আমরা প্রজন্মের সামনে উদ্ভাসিত করার চেষ্টা করছি একটি বড় ভাইসুলভ প্রতিবেশী রাষ্ট্র নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে গত প্রায় আশি বছর ধরে কী নির্মম-নিষ্ঠুর ও মানবতাবিরোধী আচরণ করে আসছে। বলুন তো পৃথিবীতে এর সাথে কার তুলনা করা যায়? যে ব্রিটিশ উপনিবেশ ও আধিপত্যবাদী শক্তি আমাদের জন্য একটা অনৈতিক, অসম আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র সেসময় তৈরি করল, ঠিক একই সময় তারা ফিলিস্তিনে ইজরাইল রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে। (মানবজাতির জন্য ব্রিটিশের এর চেয়ে বড় অবদান আর কি হতে পারে?) গত প্রায় ৮০ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা বা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমরা যে জাহান্নামের আগুনে পুড়ছে আমরা তথা ভারতবর্ষের মুসলিমরা একই সমান্তরালে সে আগুনে পুড়ছি। ফিলিস্তিনে আধুনিক অস্ত্রসহ যুদ্ধ চলছে। যে যুদ্ধ ফিলিস্তিনের অধিকাংশ অঞ্চল ধ্বংস করে এখন লেবাননকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গেছে। সেখানে এখন পর্যন্ত লাখ লাখ বনি আদম শাহাদাত বরণ করেছে। সে একইভাবে ভারতীয় মুসলমানদের ভাতে-পানিতে, শিক্ষায়- চিকিৎসায়, বাসস্থান থেকে নিঃশেষ করার ষড়যন্ত্রে অবিরতভাবে সফলকাম হচ্ছে।
বিশ্বের তথাকথিত শ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক, মানবতাবাদী ও সভ্য দেশ ব্রিটেন দুনিয়ার বুকে যে আচরণ করছে, একইভাবে এ এলাকার তথাকথিত সবচেয়ে বৃহৎ গণতান্ত্রিক, মানবতাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিবেশী ছোট রাষ্ট্রের সাথে বিভিন্ন মাত্রায় সে আচরণই করে যাচ্ছে।
বাদ দিলাম পাকিস্তান। আসুন, এবার বাংলাদেশ পিরিয়ডে। ইন্ডিয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে। এজন্য বাংলাদেশ প্রায় প্রতিদিন ইন্ডিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমরা বন্ধুদেশ ইন্ডিয়াকে আমাদের সবকিছু দিয়েছি। তারা আমাদের কাছে যা চেয়েছিল, তার চেয়েও বহুগুণ বেশি উপঢৌকন আমরা তাদের প্রদান করেছি।’
এখন আসুন, এর বিনিময় আমরা কী পেলাম? মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধীনতা যুদ্ধ করলো বাংলাদেশ। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করল ইন্ডিয়ার কাছে। সময়মতো যদি পাকিস্তান শেখ মুজিবকে বাংলাদেশ ফিরে আসার সুযোগ করে না দিত, তাহলে আমাদের হেঁসেলের দা, বঁটি, চাকু কিছুই আর থাকত না। পাকিস্তানকে এজন্য অবশ্যই মোবারকবাদ জানাতে হয়। এ পর্যায়ে মহাবীর মেজর জলিলের জন্য দয়া করে একটু দোয়া করুন।
আসুন, মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও মনীষী বি এম আব্বাসের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে হাত তুলি। যাদের অতুলনীয় দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের জন্য প্রবল প্রতাপশালী হিংসুক ইন্ডিয়া বেশ ক’বছর ফারাক্কা বাঁধ উদ্বোধন করতে পারেনি। পরবর্তীতে পরকীয়ার আদলে ছলেবলে কৌশলে মাত্র ১০ দিনের জন্য ট্রায়াল দেওয়ার কথা বলে (রিহার্সাল) সেই যে ফারাক্কা বাঁধ উদ্বোধন করা হলো, যা প্রকৃত প্রস্তাবে নদীমাতৃক বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে ছাড়ল। শুধু কি ফারাক্কা পরপর ৫৪টি নদীর ওপর তথাকথিত বন্ধু দেশ, আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বাঁধ বেঁধে আমাদের নদীর নাব্য একেবারে শেষ করে দিল। সেনানায়ক সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দুই বছর খাল খনন ও পুনঃখনন না করলে যে সামান্য নাব্য এখন আছে, তাও আর থাকতো না। জিয়াউর রহমান নদী খননের জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে বহু চেষ্টা করেছিলেন। তথাকথিত বন্ধু রাষ্ট্র ইন্ডিয়ার কারণে তা আর হতে পারেনি। এই সাথে বলতে হয় ইন্ডিয়াসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহের সকল ধরনের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সার্ক নামক যে আঞ্চলিক সংস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং সে উদ্যোগ অত্র অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের অন্তরে আশাবাদ সৃষ্টি করেছিল, তাও ভণ্ডুল করে দেয় স্বার্থপর বন্ধু ইন্ডিয়া।
এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, সার্ক অত্র অঞ্চলের দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ, ইউনাইটেড স্টেটস অব সাউথ এশিয়ার (ইউএসএসএ) স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন। অনেকটা ইউএসএ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো প্রযোজ্যময় একটা কিছু। ইন্ডিয়ার আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ইন্ডিয়াসহ এ এলাকার ছোট বড় সকল দেশ নিজস্ব স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রেখে একটা শক্তিশালী উপমহাদেশ নয়, মহাদেশে রূপান্তর করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল লরিয়েট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসও একসময় এ স্বপ্নের সাথে জড়িত ছিলেন। (আমার ভুল হলে ক্ষমা করে দেবেন)।
এসব স্বপ্ন সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিল ‘বিগ ব্রাদার ইন্ডিয়া’। এ দেশটি একটি হিংসুটে, সংকীর্ণ, আধিপত্যবাদী এবং অপরিণামদর্শী দেশ। যারা নিজের স্বার্থ দেখা ছাড়া অন্য কারো স্বার্থ বা মানবতার স্বার্থ দেখতে চায় না। ফলে নিজসহ পার্শ্ববর্তী সকল দেশের ধ্বংস তারা ডেকে আনবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এবার ইন্ডিয়া আমাদের বিপ্লবকে সমর্থন জানাতে পারল না। এ থেকে কী প্রমাণিত হয়? ইন্ডিয়ার বর্তমান সরকার মনে হয় চোখ কান বন্ধ করে সবকিছু চিন্তাভাবনা করে। বিপ্লব হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব থেকে পানির প্রবাহ সৃষ্টি করে একের পর এক বন্যায় বাংলাদেশকে তারা ভাসাল। এতে ওদের মন ভরল না- তারা কী করল? পূর্ব থেকে অর্থাৎ ত্রিপুরা থেকে পানির প্রবাহ পাঠিয়ে কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের প্রায় সকল অঞ্চলে ১৯৭০ এর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মতো বন্যার উন্মত্তটা সৃষ্টি করে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ, শস্য, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, মাছের খামারসহ সহায় সম্পদ ধ্বংস করে দিলে। সব মিলে ছয়টি বন্যার জন্ম দিল তারা। মনে করেছিল বাংলাদেশের মানুষ গণিত দিয়ে জীবনের হিসাব কষে। বাংলাদেশে ২ আর একে ৩ হয় না। হয় আল্লাহর রহমতে ২দ্ধ১০ মিনিমাম ২০।
সাম্প্রতিক ঘটনা সবার জানা, বন্যার পরপরই সনাতন ধর্মের দুর্গাপূজা এসে গেল। ইন্ডিয়া থেকে নানা ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী তৈরি করা হলো এবং সেসব বাণী বাংলাদেশে হরদম রপ্তানি ও প্রচার করা হলো। ভাবখানা এমন, যেহেতু এবার দেশে আওয়ামী লীগ নেই, সেহেতু দুর্গাপূজার কী করে হবে? আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সকল মসজিদ-মাদরাসা ও স্কুল-কলেজের অধিকাংশ ছাত্র, রাজনৈতিক দল; বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরসহ সকল ইসলামী দল দুর্গাপূজার সময় শুধুই মন্দির ও মঠ পাহারা দেয়নি, পাহারা দিয়েছে বলতে গেলে সনাতন ধর্মালম্বীদের প্রতিটি বাড়ি ও প্রতিষ্ঠান।
এ কাজটা বাংলাদেশে নতুন কিছু ছিল না এবং কখনো এত সতর্কতা ও সাবধান হওয়ার প্রয়োজনও ছিল না। হাজার হাজার বছর ধরে সনাতনপন্থীরা যেমন ১২ মাসে ১৩ পালা পর্বণ পালন করেছে, তেমনি মুসলিমরাও নিজ নিজ রিচুয়াল পালন করেছে। কোনো পক্ষের তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। সব সময় এক পক্ষ আরেক পক্ষকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। ধর্মীয় বিষয়ে কিছু নিষেধাজ্ঞা থাকায় সকল ইবাদত ও উপাসনায় দুই পক্ষের কোনো পক্ষই প্রত্যেকের সর্বজনীন উৎসবে প্রত্যেকে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু আনন্দ উৎসবের বেলায় সব ধর্মের শিশু-কিশোর ও তরুণরা অংশগ্রহণ করেছে। সব দেশের সব সমাজে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল থাকে। তারা তাদের স্বার্থে কিছু অঘটন ঘটায়। এটাকে বাংলাদেশে বলা হয় সিস্টেম লস। পাকিস্তান বা বাংলাদেশ আমলে সনাতন ধর্মীদের পালা পার্বণের সময় বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা কখনো তেমন ঘটেনি। তবে ইন্ডিয়া সবসময় ছোট-খাটো ঘটনাকে বিশ্বের সামনে তিলকে তাল করে দেখিয়েছে। এবার ইন্ডিয়া বড় কোনো ঘটনা ঘটাবে এ আশঙ্কায় বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সতর্ক সাবধান ছিল। যে কারণে সারা বিশ্ব দেখেছে বাংলাদেশের সনাতন ধর্মীরা কি উচ্ছাস উদ্দীপনা নিয়ে দুর্গাপূজা পালন করেছে।
বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিল বিশ্ববাসীর মতো প্রতিবেশী ইন্ডিয়া বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও জনগণকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রতিবছরের মতো ইন্ডিয়া যে বয়ান পরিবেশন করে, তার চেয়েও নিকৃষ্টভাবে তাদের শাশ্বত বয়ান উচ্চকিত করেছে। এই তো কয়েকদিন পূর্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশংসা করেছে।
এখানে এসে একটা প্রণিধাণযোগ্য কথা আমাদের বলতে হয়। ইন্ডিয়া তাদের মুসলিম অধিবাসীকে যেমন ভারতীয় হতে বাধা দিয়ে আসছে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সনাতনীদের বাংলাদেশি হতে বাধাগ্রস্ত করেছে। ইন্ডিয়া ভারতীয় মুসলমানদের পাকিস্তানি বলে গত ৫৩ বছর ধরে গালাগাল করেছে এবং তারা সবসময় চেয়েছে মুসলিমরা পাকিস্তানে চলে যাক। আর বাংলাদেশের সনাতনপন্থীদের বিষয়ে তাদের বক্তব্য এমন ছিল বা আছে যে, বাংলাদেশ তোমাদের জন্য নয়। তোমরা শুধু সেখানে নির্যাতিত হচ্ছো।
লেখার শুরুতে বলেছিলাম, আমরা হিন্দু ও মুসলমান নিয়ে কোনো কথা বলবো না। রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রকে নিয়ে বলব। প্রতিবেশী ছোট ছোট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গত ৮০ বছর ইন্ডিয়া যে অত্যাচার-অবিচার করেছে এবং নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যে জুলুম-অত্যাচার জারি রেখেছে, তাকে আমরা ইসরাইলি বর্বরতা বলে উল্লেখ করেছি।
দেশ বা জাতীয়তাবাদ সব মানুষকে অন্ধ করে দেয় না। একটু দেখুন: অর্ক ভাদুড়ী, ভারতীয় সাংবাদিক বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের সাথে আমাদের ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব ছিল, তার ছেদ হওয়ার বড় কারণ হাসিনা প্রীতি।
আমরা যদি অন্যের ব্যাপারে নাক না গলাই, তবে সম্পর্ক আরো ভালো থাকবে। আমরা কেন পাশের বাড়ির মানুষের জানালায় উঁকি দেব।
আমাদের দেশের সরকারের কাজ কি বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের ঠিকাদারি নিয়ে বসে থাকা, নিশ্চয়ই না।
বাংলাদেশের জনগণ যে ভদ্রমহিলাকে উৎখাত করল, খুনি গণহত্যাকারী ভদ্রমহিলা- যিনি পরপর তিনটি ইলেকশনে ভোট চুরি করে, লুণ্ঠন করেছেন তার দায়টা আমরা ভারতীয়রা কেন নেব।
শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দেশের জনগণের বোঝাপড়া। সেই জনগণের সাথে আমরা কেন বিভেদ সৃষ্টি করব। যার বিরুদ্ধে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে গণহত্যার মামলা। এ মুহূর্তে গোটা বিশ্বে যিনি ধিকৃত, তার জন্য আমরা কেন দায় নেব।
ভারতীয় কিছু সংবাদপত্র ও বিশ্লেষক বলেছেন, এ আন্দোলন ছাত্র বা জনগণের আন্দোলন ছিল না। মূলত মৌলবাদী জামায়াত ও বিএনপির আন্দোলন ছিল। কিন্তু আমি তো দেখছি জামায়াত ও বিএনপি এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় আসতে পারল না। তিন মাস পেরিয়ে গেল।
ভারত কি মনে করে তার পুরাতন ভৃত্যকে সহযোগিতা করা দরকার?
শেখ হাসিনার আমলেও যথেষ্ট হিন্দু নির্যাতন হয়েছে। বিরোধীদলের কণ্ঠস্বর দমন করা হয়েছে।
ইউকে সরকার এ ভদ্রমহিলাকে আশ্রয় দিচ্ছে না। তার আত্মীয় তো সেখানকার এমপি, সে কেন সেখানে আশ্রয় নিতে পারছে না?
শেষে আবারো আসফউদ্দৌলাহ সাহেবের কথা।
‘যে ফারাক্কা বাঁধ দিতে পারে, তিস্তায় বাঁধ দিতে পারে, টিপাই মুখে বাঁধ দিতে পারে, সে কখনো বাংলাদেশের বন্ধু হতে পারে না।’
বাংলাদেশের সকল সরকার ইন্ডিয়ার সাথে বৈরী সম্পর্ক গড়তে বা রাখতে চায়নি, সবসময় একই মাত্রায় সম্মানজনক এবং সৎ-প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছে। বাংলাদেশের সে আশা হয়তো পূরণ হয়নি। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছা হলে একদিন তা হবে, ইনশাআল্লাহ।