গণঅভ্যুত্থানের ফল পেতে জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য

একেএম রফিকুন্নবী
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:০২

স্লোগানে স্লোগানে আন্দোলন : আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থান

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় আন্দোলনের ফলে স্বৈরাচারী হাসিনা সব ফেলে তার প্রিয় মোদির দেশে পালিয়ে গেছে। দেশে দেশে স্বৈরাচারদের এমন ঘটনা বিরল নয়। দেশ জনগণের, জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। স্বাভাবিকভাবেই হাসিনা তার কাজের ফল ভোগ করতেই পালিয়ে গেছে। জনগণ স্বস্তি পেয়েছে। নতুনভাবে স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে অতীতের দুঃশাসন থেকে উঠে এসে মুক্ত বাতাসে মানুষ চলাফেরা করছে।
স্বৈরাচার পালালেও তার দোসররা তো সব জায়গায়ই লুকিয়ে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। গার্মেন্টসশিল্পে অরাজকতা, ছাত্রদের মধ্যে বিভেদ, প্রশাসনে ঘাপটি মেরে বসে থাকা স্বৈরাচারের লোকেরা মাথাচাড়া দিতে ওত পেতে সুযোগ খুঁজছে। তাদের থাবা আবার জনগণের দিকে বিস্তার করা যায় কিনা?
এদেশের মানুষ ক্ষমা করতে জানে, যদি ক্ষমার যোগ্য হয়। মানুষ ক্ষেপলে শত্রুর টুঁটি চেপে ধরতে তৎপরও হয়ে ওঠে। আমরা জনগণের ঐক্য ধরে রাখতে চাই।
আমাদের মনে থাকার কথা, গত ৫ আগস্ট দুপুর ২টার পর ঢাকাসহ সব শহরে মানুষের যে মিছিলের ঢল নেমেছিল, তা অবিশ্বাস্য। ছোট-বড়, ধনি-গরিব, ছাত্র-জনতা হাসিনার পালানোর খবরে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ১৬ বছরের চাপা ক্ষোভ দূরীভূত করার জন্য স্বাধীনভাবে খোলামনে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার জন্য মাঠে নেমে আসে। গণভবনের মতো সুরক্ষিত এলাকা জনগণের দখলে চলে যায়। সবাই যার যার মতো গণভবনে হাসিনার ব্যবহার্য সব জিনিসপত্র নিয়ে যায়। অবশ্য সরকারের আহ্বানে পরে ফেরত দিয়েছে। বর্তমানে গণভবন ঐতিহ্যের জন্য যেখানে যে অবস্থায় আছে, তা জাদুঘরের মতো রক্ষিত থাকবে- স্বৈরাচারের পতনের দৃশ্য থাকবে দেখানোর জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
তাই বিদেশ থেকে যতই হুমকি-ধমকি দেয়া হোক না কেন, জনগণের যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সময়েই দেখা গেছে। ভয়ের কোনো কারণ নেই। আশঙ্কারও কোনো কারণ নেই। মহান আল্লাহ ৫ আগস্ট বিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করেছেন, ভবিষ্যতেও বাংলাদেশকে তিনিই স্বৈরাচারমুক্ত রাখবেন, ইনশাআল্লাহ।
১৬ বছরের জঞ্জাল সাফ করতে সময় লাগবেই। উপদেষ্টারা যেহেতু রাজনৈতিক লোক নন, তাই তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দলগুলোকেই। উপদেষ্টারাও দলগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখছেন। তাদের সাধ্যের মধ্যে কাজ করার চেষ্টা করছেন।
বিশেষ করে প্রশাসনের সংস্কার, পুলিশের সংস্কার, নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই গঠিত হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে আমি চিনি। তিনি ভালো মানুষ। আশা করি, ভালো নির্বাচন করতে পারবেন, জাতীয় প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন। নির্বাচনী আইন সংস্কার করতে হবে। নির্বাচনের সাথে যারাই জড়িত, তাদের হাসিনার লোকদের থেকে উদ্ধার করতে হবে। নতুন লোক নিয়োগ করতে হবে। সৎ ও যোগ্য লোক নিয়োগ করতে হবে। আমার জানামতে, পুলিশপ্রধানও ভালো মানুষ। তার নেতৃত্বে ভালো ও সৎ লোক দ্বারা পুলিশ প্রশাসন সাজাতে হবে। নতুন সৎ, যোগ্য লোক নিয়োগ করতে হবে। ভালো প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনদরদি পুলিশ বাহিনী গড়তে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। দেশের সব জায়গায় খারাপ লোকের দাপট কমেনি। অতীতের পতিত সরকারের লোকজন বসে আগস্ট বিপ্লবের বিরুদ্ধে কাজ করছে। তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সাজার ব্যবস্থা করতে হবে।
ছাত্র-জনতার বিপ্লবের আলোকেই আমাদের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। ঐক্যে ফাটল ধরানো যাবে না।
বড় দল হিসেবে বিএনপিকে আরো কঠিন হিসাব-নিকাশ করে দল চালাতে হবে। ইতোমধ্যেই বিএনপির কিছু নেতা ও কর্মী পতিত সরকারের ফেলে যাওয়া হাট-ঘাট, নদী-নালা, সব ক্ষেত্রে আগের মতোই চাঁদাবাজি চালু রেখেছে। ৫ আগস্টের পর ২-৩ দিন চাঁদাবাজমুক্ত হাট-বাজার চলছিল। মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। যাক চাঁদাবাজ থেকে বাঁচা গেল। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই পূর্বের অবস্থা ফিরে এলো। আমরা দুঃখিত, মর্মাহত, লজ্জিত। ইতোমধ্যেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কর্মীদের চাঁদাবাজি, দখলবাজি বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অনেক কর্মীকে বহিষ্কার করেছেন। ভালো উদ্যোগ। ক্ষতি তো অনেক হয়ে গেছে। নেতাদের সজাগ থাকতে হবে জনগণের ভালো করার জন্য।
সুখের বিষয় জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নামে চাঁদাবাজি, দখলবাজির কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের নৈতিকমানে উত্তীর্ণ করেই জনগণের সেবার জন্য তৈরি করা হয়। এজন্যই জামায়াত-শিবিরের অনেক নির্বাচিত ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, এমপি, মেম্বাররা বার বার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। আগস্ট বিপ্লবের ৩ মাসের মধ্যেই অনেক জরিপে জামায়াতের ফল ভালো দেখা যাচ্ছে। আমরা স্বৈরাচারীদের দোসর ছাড়া সব দলের ঐক্য ধরে রেখেই আগামী নির্বাচনে সরকারি দল ও বিরোধীদল সৎ ও যোগ্য লোকের সমাবেশ দেখতে চাই। জনগণ আর পূর্বের দলবাজ, চাঁদাবাজ লোকদের সরকারে এবং বিরোধীদলে দেখতে চায় না।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আর দেশবিরোধী শক্তিকে কোনো জায়গায়ই দেখতে চায় না জনগণ। জনগণ বেশি কিছু চায় না। ভাত, কাপড়, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষার সুযোগ চায়। কোনো জায়গায়ই ফাঁকিবাজ, অসৎ লোকের পাল্লায় পড়তে চায় না।
এক্ষেত্রে দেশে ইসলামী দলগুলোর দায়িত্ব অনেক বেশি। যেহেতু আল্লাহ এক, রাসূল এক; তাই ছোট-খাটো মতবিরোধ ভুলে ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েমের জন্য ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। যার যেখানে কাজ ভালো, জনগণের সাপোর্ট ভালো, সেখানে তারা ভালো লোক দিয়ে নির্বাচন করে জিতে আসতে হবে। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আদায় করতে হবে। এ ব্যাপারে মাওলানা মামুনুল হকের এক বক্তব্য আমার ভালো লেগেছে। তিনি বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তাদের গঠনতন্ত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের কথা লেখা ছিল বলে। তাই আল্লাহর সার্বভৌমত্বের কথা স্বীকার করে সব ইসলামী দল যদি এক হতে পারে, তবে দেশে একটি বড় পরিবর্তন আসা সম্ভব। আমরা ছোট-বড় সব ইসলামী দলকে আল্লাহকে সামনে রেখে রাসূলের নীতির উপর ভরসা করে অবশ্যই ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। বড় দলগুলোকে কিছু ছাড় দিয়ে হলেও এ কাজ অবশ্যই করতে হবে। কারণ এদেশের বিরানব্বই ভাগ মুসলমান আল্লাহকেই ইলাহ মানে, রাসূলকে নবী মানে। তাই আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে পরকালের হিসাব দেওয়ার ভয়েই। মুসলিমদের দুনিয়ার ভালো কাজের অণুপরিমান লেখা থাকবে আবার অণুপরিমান খারাপ কাজও লেখা থাকে। এ অনুভূতি সামনে রেখেই আমাদের দুনিয়ার কাজ আঞ্জাম দিতে হবে। তাহলে দুনিয়ায়ও আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবো আর আখিরাতে পাব সীমাহীন শান্তি আর শান্তি।
পতিত স্বৈরাচারী হাসিনা এবং তার দোসররা কোনো সময় গার্মেন্টস শ্রমিকদের লেলিয়ে দিচ্ছে। কখনো ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে। আবার ইসকন নামে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে পাশের দেশের সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করছে। স্বৈরাচারকে বুঝতে হবে, এদেশের মানুষ ক্ষেপলে কাউকে ছাড় দেয় না। যেমন শেখ মুজিব ছাড় পায়নি। হাসিনা পালাতে বাধ্য হয়েছে। তাই জনগণ সজাগ থাকলে কোনো স্বৈরাচারই এদেশে কার্যকর হবে না, ইনশাআল্লাহ।
আমাদের প্রতিবেশী দেশের স্মরণে রাখতে হবে, বাংলাদেশে এখন আর তাদের সেবাদাসী ক্ষমতায় নেই। ভারতের পূর্ব দিকের সাত রাজ্য ও পশ্চিমবঙ্গ তাদের নীতির কারণে অশান্ত। আমরা কারও দেশের যেমন হস্তক্ষেপ চাই না, আবার আমরাও কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতেও চাই না। এ পর্যন্ত ভারতে যত মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। মসজিদ ভেঙে মন্দির করা হয়েছে। তাদের প্রায় ২৫ ভাগ জনশক্তি মুসলমান। মোদি সরকার তাদের হিন্দু রাষ্ট্র করার জন্য যত দাঙ্গা করিয়েছে, তার তুলনায় বাংলাদেশে কোনো দাঙ্গা হয়নি। মন্দির ভেঙে মসজিদ করা হয়নি, জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, আমরা এমন একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে চাই, যেখানে সব ধর্মের লোকেরা স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে। মসজিদ-মন্দির পাহারা দিতে হবে না। মেয়েরা স্বাধীনভাবে তাদের মর্যাদা নিয়ে সমাজে বসবাস করতে পারবে। কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে পারবে। কাউকেই বাধার সম্মুখীন হতে হবে না। কারণ আমরা মনে করি, আমাদের কাজের জন্য যেমন জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আবার পরকালে মহান আল্লাহর কাছেও জবাবদিহি করতে হবে।
সম্প্রতি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় হাইকোর্টে খালাস পেয়েছেন তথাকথিত সব আসামি। হাসিনাও তার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো খালাস নিয়েছিলেন, যা আইনসম্মত ছিল না। আজ আবার মামলাগুলো রিভিউ করা হচ্ছে। বিশেষ করে বিডিআর হত্যা মামলা। আমাদের সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস অফিসারকে হত্যা করা হয়েছিল দিনে-দুপুরে। নতুন করে মামলার রায়ে নায় বিচার প্রতিষ্ঠা হবে, ইনশাআল্লাহ।
দেশের অর্থনীতি হাসিনার সময় শেষ করে দেয়া হয়েছিল। ব্যাংকগুলো খালি করে দেশে টাকা বিনিায়োগ না করে সবই বিদেশে পাচার করে দিয়েছিল। বড় বড় প্রকল্পের প্রায় ৪০ ভাগ টাকা লুট করেছে হাসিনা ও তার লোকেরা। এ টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করছে বর্তমান সরকার। আমরা আশা করি দেশের টাকা দেশে ফিরে আসুক।
ইতোমধ্যে দুর্নীতির টাকা পাচারের শ্বেতপত্র কমিটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেছে। দেখা গেছে, হাসিনার আমলের এ ১৫ বছরে প্রতি বছর ১৬ মিলিয়ন টাকা পাচার হয়েছে, যা দেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। সুষ্ঠু তদন্ত, কূটনীতির বেড়াজালে সব পাচার করা টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করতে হবে। হাসিনার আত্মীয়-স্বজন এবং কাছের লোকদের শত শত কোটি টাকার সম্পদ পাওয়া গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। সরকার চেষ্টা করছে এ টাকা ফেরত আনার জন্য। আমরা চাই এ টাকা ফেরত আসার কাজ সম্পন্ন হোক।
প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধীদলগুলোকে দেশের বর্তমান অবস্থায় করণীয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। বৃহস্পতিবার দেশের ইসলামী দলগুলোর সাথেও আলোচনা করবেন। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সাথে প্রধান উপদেষ্টা আলোচনা করেছেন। আশা করা যায়, সবাই মিলে উদ্যোগ নিলে সব ষড়যন্ত্র নস্যাত করা যাবে। ইতোমধ্যেই দেশের মানুষ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে।
দেশে ও দেশের বাইরে বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র চলছে। এদের দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে। দেশের জনগণ, ছাত্র, যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে আর দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে ঠিক রাখতে পারলে কোনো ষড়যন্ত্রই পাত্তা পাবে না। মহান আল্লাহ যেমন ৫ আগস্ট বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন, তেমনি সব ষড়যন্ত্রও মহান আল্লাহ আমাদের সাহায্য করে নস্যাৎ করে দেবেন। আমাদেরকে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে তৈরি হতে হবে। তবেই আল্লাহ আমাদের তাঁর প্রিয় বান্দা হিসেবে সাহায্য করবেন, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।