॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন ॥
ফেনী জেলা থেকে ঢাকায় পড়তে এসেছেন হৃদয়। ভর্তি হয়েছেন সরকারি কবি নজরুল ইসলাম কলেজে। থাকেন মগবাজারের ডাক্তার গলিতে মেস বাসায়। তার ওই মেসে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের বসবাস। নিয়ম করে নিজেরাই বাজার করেন প্রতিদিন। তার আক্ষেপ সরকার কেন নিত্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মূল্য কারা বাড়ায়, কারসাজি কারা করছে, তারা কি সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাইতেও বেশি শক্তিশালী। যদি তা না হয়, তাহলে অদৃশ্য এমন কী কারণ থাকতে পারে? যে কারণে সরকার কারসাজিকারীদের ধরছে না। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এ শিক্ষার্থী জানান, ১০ হাজার টাকায়ও একজন শিক্ষার্থী ঢাকায় থাকতে কষ্ট হচ্ছে। শুধু পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলেই স্বস্তিতে বেঁচে থাকা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
গরুর গোশত বিক্রি করার জন্য সরকার প্রতি কেজি ৬৬৪.৩৯ টাকা মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু বাজারে গরুর গোশতের মূল্য ৭৫০ থেকে ৭৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। হৃদয় তার মেসে খাওয়ার জন্য এক কেজি গরু গোশত কিনেছেন ৭৭০ টাকায়। রুই মাছে কিনেছেন ৩৬০ টাকা দিয়ে। কচুরছড়া কিনেছেন ১৪০, কলার হালি কিনেছেন ৪৫, ভেন্ডি ৭০, বরবটি কেজিপ্রতি ৭০ টাকায় কিনেছেন। অর্থাৎ সরকারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পূর্বনির্ধারিত মূল্যে পণ্য কিনতে পারছেন না কেউ। বেগুন-টমেটো ছাড়া আর প্রায় সব সবজির মূল্য বেশি, শাকের মূল্য তো আকাশছোঁয়া।
প্রবাসী আনোয়ার হোসেনের পরিবার ঢাকার ডেমরায় থাকেন। তারা সবসময় নাজিরশাইল চালের ভাত খান। এবার ৫০ কেজির এক বস্তা চাল বাসায় পৌঁছতে মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩৯৬০ টাকা। অবশ্য এর আগে ঠিক একই দোকান থেকে একই চাল বাসা পর্যন্ত পৌঁছাতে (একশ’ টাকা পরিবহন খরচ) ১৬০ টাকা কম খরচ হয়েছিল। কোনো কারণ ছাড়াই বেড়েছে এ জাতের চালের মূল্য। শুধু নাজিরশাইল চালই নয়, প্রায় সব চালের মূল্যই বেড়েছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্রাক মালিকরা পরিবহন খরচ বাড়িয়ে দেওয়ায় মূল্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অবশ্য চালের ক্ষেত্রে আশার আলো দেখা দিতেও পারে। কারণ গত ২১ মার্চ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান হোছাইনী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দেশের বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে বেসরকারিভাবে ৮৩ হাজার টন চাল আমদানির জন্য ৩০ প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে সিদ্ধ চাল ৪৯ হাজার টন ও আতপ চাল ৩৪ হাজার টন। চালে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভাঙা দানা থাকতে পারবে বলে বরাদ্দ আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে। চালের বাজারের সংকট দ্রুত কাটিয়ে উঠতে আমদানি করা চাল ২৫ এপ্রিলের মধ্যে বাজারজাতের জন্য শর্ত বেঁধে দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯ লাখ ৮৮ হাজার এবং ২০২০-২১ অর্থবছর ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়। চলতি অর্থবছর এখন পর্যন্ত কোনো চাল আমদানি করা হয়নি। চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও এসব চালের বড় অংশই আমদানি করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন কোনো কোনো ব্যবসায়ী। কেননা ‘এলসি খুলে চাল দেশে আসতে এক মাসের মতো সময় লাগবে। আবার ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলাও সহজ নয়। তাছাড়া সবাই একত্রে এলসি খুললে সব চালই একই সময়ে দেশে আসবে। আবার একই সময়ে নতুন মৌসুমের চাল বাজারে আসবে। যে কারণে অনুমতি পাওয়া বড় অংশের চাল আমদানি হওয়ার সম্ভাবনা কম।’ বিগত বছরে এ সময়ে কখনো চালের দাম বাড়েনি। এবার সরবরাহে কিছুটা সংকট থাকায় চালের দাম বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে হঠাৎ করে প্রতি বস্তা চালের দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে।
এদিকে নিত্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে ২৯ পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। গত ১৫ মার্চ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এ ২৯ পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এ মূল্য নির্ধারণের দুই সপ্তাহ পার হলেও ২৯ পণ্যের অধিকাংশই বিক্রি হচ্ছে বিক্রেতাদের ইচ্ছামাফিক। তারা সরকারি সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ক্রেতাদের পকেট কাটছে। মূল্য নিচ্ছে যে যার মতো করে। সরকারের বেঁধে দেওয়া মূল্য বাজারে বাস্তবায়ন না থাকলেও এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।
সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তরা অনেকটা চোখ বন্ধ করে থাকার মতো অবস্থায় রয়েছে। বেঁধে দেয়া মূল্যে বাজারে পণ্য বিক্রিতে বিক্রেতাদের বাধ্য করতে এবং যারা নির্ধারণ হওয়া মূল্যে বিক্রি করছেন না, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে দুই সপ্তাহ পরও বিক্রেতারা সরকারি সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নিজেদের সিদ্ধান্তেই পণ্য বিক্রি করছে। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে খবর নিয়ে জানা গেছে, মাত্র কয়েকটি পণ্য বিক্রি হচ্ছে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে, আর অধিকাংশই বিক্রি হচ্ছে দোকানিদের ইচ্ছামাফিক।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বেঁধে দেয়া মূল্যতালিকায় দেখা যায়, প্রতি কেজি ছোলা খুচরা পর্যায়ে ৯৮.৩০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও তা বাজারে এখনো বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়, অর্থাৎ ছোলায় কেজিপ্রতি ১১ টাকা ৭০ পয়সা বেশি নেয়া হচ্ছে ক্রেতাদের কাছ থেকে। মসুর ডালের নির্ধারিত মূল্য (চিকন) ১৩০.৫০ হলেও বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়, এখানে বেশি নেয়া হচ্ছে সাড়ে ৯ টাকা। একইভাবে মসুর ডাল (মোটা) সরকারের বেঁধে দেয়া দাম ১০৫.৫০ টাকা, অথচ তা বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। খেসারি ডাল নির্ধারিত মূল্য ৯২.৬১ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়, অর্থাৎ খেসারির ডাল কেজিতে ৪৭ টাকা ৩৯ পয়সা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। গরুর গোশত নির্ধারিত মূল্য প্রতি কেজি ৬৬৪.৩৯ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৭২০ থেকে ৭৭০ টাকায়, ব্রয়লার মুরগির নির্ধারিত মূল্য ১৭৫.৩০ টাকার স্থলে তা বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকায়, সোনালি মুরগির নির্ধারিত মূল্য ২৬২ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৩১০ থেকে ৩২০ টাকায়, অর্থাৎ কেজিপ্রতি ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে এ জাতের মুরগি।
ডিম প্রতি পিস নির্ধারিত মূল্য ১০.৪৮ হলেও বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকায়। দেশি রসুন প্রতি কেজির নির্ধারিত মূল্য ১২০.৮১ টাকার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা, আমদানিকৃত আদা প্রতি কেজির নির্ধারিত মূল্য ১৮০ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়, শুকনো মরিচ প্রতি কেজি নির্ধারিত মূল্য ৩২৭.৩৪ টাকার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়। কাঁচামরিচ নির্ধারিত মূল্য প্রতি কেজি ৬০.২০ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়, বাঁধাকপির নির্ধারিত মূল্য প্রতি কেজি ২৮.৩০ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়, আলুর নির্ধারিত মূল্য প্রতি কেজি ২৮.৫৫ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। টমেটো প্রতি কেজি নির্ধারিত মূল্য ৪০.২০ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। মিষ্টিকুমড়া প্রতি কেজি নির্ধারিত মূল্য ২৩.৩৮ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়, জাহিদী খেজুর প্রতি কেজির নির্ধারিত মূল্য ১৮৫.০৭ টাকার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়, অর্থাৎ এ জাতের খেজুর কেজি প্রতি প্রায় ৩৫ টাকা বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। কলা প্রতি হালি নির্ধারিত মূল্য ২৯.৭৮ টাকার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। সরকার বেঁধে দেওয়া ২৯ পণ্যের মধ্যে মুগ ডাল, পাঙ্গাস মাছ, কাতল মাছ, ছাগলের গোশত, পেঁয়াজ, বেগুন, চিঁড়া ও বেসন বিক্রি হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দামে।
আমাদের দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা বাকি ১১ মাসের ব্যবসা রমযান মাসে করে, চাইলেই হঠাৎ করে এদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়- এমন মন্তব্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামের। তিনি বলেন, ‘আমরা দাম বেঁধে দিয়েছি এবং নিয়মিত তা মনিটরিং করছি। ইতোমধ্যে অনেক পণ্য আমাদের বেঁধে দেয়া দামের আওতায় চলে এসেছে।’ তিনি আরও বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ‘খাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যান-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, জাতীয় পর্যায়ে পরিবারপ্রতি মাসে গড় খানা খরচ ১২ হাজার ৫৩ টাকা। পল্লী, শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকার গড় মাসিক ব্যয় কম বেশি দেখা গেছে। পল্লীতে ১১ হাজার ৭১৮ টাকা, শহরে ১১ হাজার ৮৯০ টাকা এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় পরিবারপ্রতি খাবার খরচ ১৪ হাজার ১২৫ টাকা। সবচেয়ে বেশি খরচ হয় চাল কিনতে। পল্লী এলাকায় প্রায় ১২ টাকা টাকা শুধু খানা খরচ হলে গ্রামের মানুষের মাসিক আয় কত? তারা অন্য খরচ কীভাবে মেটায়, জীবন চলে কীভাবে।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হচ্ছে চীন
- খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনে বাড়ছে পেটে গ্যাস
- আবার পরিবর্তন আসবে হয়তো!
- ভারত থেকে আমদানি কমেছে
- ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করতে হবে---হামিদুর রহমান আযাদ
- আমাদেরকে ইসলামী আদর্শের দিকেই ফিরে আসতে হবে----মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন
- মানুষ ঠিকমতো মাহে রমাদানও পালন করতে পারছে না--ছাত্রশিবির সভাপতি
- সীমান্তে ২ জনের হতাহতের ঘটনা প্রমাণ করে স্বাধীনতা চরম সংকটে : মির্জা ফখরুল
- ঈদের আগেই উদ্ধারের আশা মালিকপক্ষের
- হজ, ওমরা এবং ট্রাভেল ব্যবসায়ীদের নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ