শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে তুঘলকি কারবার
আবার পরিবর্তন আসবে হয়তো!
॥ সামছুল আরেফীন॥
বাস্তবায়নাধীন নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সমালোচনা ছিল শুরু থেকেই। বিশেষ করে পরীক্ষাবিহীন মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে ছিল উদ্বেগ। শিক্ষার্থীদের বইবিমুখ করে প্রযুক্তিনির্ভর করে ফেলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ ওঠে। ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্ত দিয়ে ফলাফল নির্ধারণের প্রক্রিয়া বাতিলেরও দাবি উঠেছিল। নানা আলোচনা-সমালোচনার পর মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন (অ্যাসেসমেন্ট) পদ্ধতি নিয়ে একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
আগামী জুন থেকেই নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছে বোর্ড। চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির পরীক্ষা বা মূল্যায়ন কেন্দ্র হবে শিক্ষার্থীর নিজ প্রতিষ্ঠানেই। আর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার জন্য যেতে হবে নিজ স্কুলের বাইরের ভিন্ন কেন্দ্রে। আগামী জুন মাসে এ মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকার গত বছর থেকে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করেছে। ১ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণি দিয়ে শুরু হয়েছে এর যাত্রা। চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবমে এবং ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে এটি চালু হবে। নতুন কারিকুলামে এসএসসি পরীক্ষা হবে ২০২৬ সালে।
শিক্ষার্থীরা পড়বে, মুখস্থ করবে এবং পরীক্ষা দেবে। উত্তরপত্রে যা লিখবে, তা দিয়েই মূল্যায়ন। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দীর্ঘদিনের চিত্র এটি। তবে নতুন শিক্ষাক্রমে তা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। শিক্ষার্থীরা এখন প্রথমে কাজ করবে, বুঝবে, তারপর শিখবে। তাদের এসব কার্যক্রম দেখে মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা। থাকছে না কোনো পরীক্ষা। তবে এ পরীক্ষা না থাকা নিয়েই চরম ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। ‘পরীক্ষাবিহীন’ পড়াশোনায় কোনো অভিভাবকই যেন আস্থা রাখতে পারছেন না। অভিভাবকরা বলছেন, তাদের সন্তানরা স্কুলে যাচ্ছে-আসছে। কিছুই পড়ছে-লিখছে না। হোমওয়ার্ক, প্রাইভেট-টিউশনিও চাইছে না। শিক্ষার্থীরা স্কুলে যা শিখছে, বাড়িতে এসে যা করছে, তা কোনো ‘পড়াশোনা নয়’ বলে মনে করছেন তারা।
এবার পরীক্ষা পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এনসিটিবি বলছে, স্কুল সময়ে (সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা) প্রতিদিন একটি বিষয়ে মূল্যায়নের জন্য খসড়া প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। এতে টানা পাঁচ ঘণ্টা বসে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিতে হবে না। তবে বিষয়ভেদে এক থেকে দেড় ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষা হবে।
খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রতিটি বিষয়ে মিডটার্ম ও বার্ষিক পরীক্ষা হবে পাঁচ ঘণ্টার। পাঁচ ঘণ্টায় হবে এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা। এ দুটি পরীক্ষা হবে অন্য কেন্দ্রে। আর চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির পরীক্ষা হবে নিজ নিজ স্কুলে। সকাল ১০টা থেকে এ মূল্যায়ন চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। মাঝখানে এক ঘণ্টার বিরতি থাকবে।
নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে এ মাসের শুরুতে সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে সরকার। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, তারা মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে একটি খসড়া চূড়ান্ত করেছে। গত ২৪ মার্চ রোববার শিক্ষা বোর্ডগুলোর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়। সে অনুযায়ী শ্রেণিভিত্তিক পরীক্ষা নেওয়া হবে বছরে দুটি। প্রতি বিষয়ে ৫ ঘণ্টার লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষা নেওয়া হবে। তবে আগের পদ্ধতিতে আর পরীক্ষা হবে না। পরীক্ষাকে এখানে ‘মূল্যায়ন’ বলা হবে।
জানা গেছে, নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মার্কিং (চিহ্নিত) করার নিয়ম থাকবে না। ‘রিপোর্ট ভালো’, ‘অর্জনের পথে’ এবং ‘প্রাথমিক পর্যায়’ এমন তিন ভাগে ফলাফল হবে। চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মিডটার্ম ও ফাইনাল পরীক্ষা হবে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে চূড়ান্ত পরীক্ষার মাধ্যমে। খসড়া অনুযায়ী, মিডটার্ম ও বার্ষিক পরীক্ষায় সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে নতুন কারিকুলামের আলোকে।
চলতি বছরের জুন থেকে এ প্রক্রিয়ায় মূল্যায়ন হবে স্কুলে। এর আগেই সব চূড়ান্ত হবে জানিয়ে এনসিটিবির সদস্য (কারিকুলাম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের নিয়ে খসড়া করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিষয়টি চূড়ান্ত করবেন।
পুরোনো কারিকুলাম অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের তিন ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো। আর পৃথক দিনে ব্যবহারিক পরীক্ষা হতো। নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী, মূল্যায়ন প্রক্রিয়াও ভিন্ন হচ্ছে। পরীক্ষা ও মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষাবিদদের মতামত নিয়ে এ খসড়া প্রস্তাবনা তৈরি করার কথা জানিয়েছে এনসিটিবি। এটি এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সেখানে হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
নতুন পাঠক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন কেবল দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি অনুসারেই অভিন্ন দশটি বিষয়ের ওপর এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে। একইভাবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষার পরিবর্তে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি আলাদা পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর দুই পরীক্ষার ফল সমন্বয় করে হবে এইচএসসির চূড়ান্ত ফলাফল।
কেন্দ্রীয়ভাবে আগে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী-পিইসি, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট-জেএসসি এবং জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট-জেডিসি পরীক্ষা নেওয়া হতো। এসব পরীক্ষা এখন আর নেই।
বাংলাদেশের জন্ম থেকে অনেকগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। প্রতিটি কমিশনের ছিল নিজস্ব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সব শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির মতোÑ কাজ যেন শেষই হয় না।
১৯৭১ মাল পরবর্তী প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় ১৯৭২ সালে, যা ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন নামে বেশি পরিচিত। এরপর ১৯৮২ সালে হয় মজিদ খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৮৭ সালে মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ সালে শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, ২০০১ সালে এমএ বারী শিক্ষা কমিশন, ২০০৩ সালে মনিরুজ্জামান শিক্ষা কমিশন এবং সর্বশেষ ২০০৯ সালে কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন। ১৯৭১ সালের পর থেকে অর্ধ শতাব্দির বেশি সময় পার হলেও জাতি আজ পর্যন্ত শিক্ষার বিষয়ে কোনো সঠিক দিকনির্দেশনা পায়নি। কোমলমতি শিশু-কিশোরদের নিয়ে এসব পরীক্ষার খেলা রীতিমতো দুঃখজনক।
একসময় পরীক্ষায় এমসিকিউ পদ্ধতি ছিল। তারপর এলো সৃজনশীল। সেটা ধাতস্ত হতে না হতেই এখন এলো মূল্যায়ন পদ্ধতি। তারপর কী? শিক্ষাক্রম, পদ্ধতি নিয়ে এক্সপেরিমেন্টের শেষ কোথায়?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মো. মজিবুর রহমান বলেন, মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের জায়গায় অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। এ অবস্থায় নতুন শিক্ষাক্রমটি কতটা কাজে দেবে, সেটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ ধরনের একটি উদ্যোগ গ্রহণের আগে প্রয়োজনীয় গবেষণার পাশাপাশি এর সাথে জড়িত প্রতিটি অংশীদারের সাথে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করা উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি। বলেন, অভিভাবক এবং শিক্ষকরা এ উদ্যোগের সবচেয়ে বড় দুই অংশীদার। কিন্তু শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের আগে তাদের সাথে কি বসা হয়েছে? বসা হলে কয়জনের সাথে আলাপ-আলোচনা বা পরামর্শ করা হয়েছে? তাদের সাথে আলোচনা করে ধাপে ধাপে এটি বাস্তবায়ন করা হলে এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না বলে আমি মনে করি।
মাউশির সাবেক মহাপরিচালক গোলাম ফারুক বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এতদিন খুব অল্প নম্বর ছিল শিক্ষকদের হাতে। পাবলিক পরীক্ষায় হয়তো ২০-২৫ নম্বর ছিল ব্যবহারিক বিষয়ে। সেটাতেও মাঝেমধ্যে কাউকে কম, কাউকে বেশি দেওয়ার অভিযোগ শোনা যায়। নতুন শিক্ষাক্রমে যদি নিরপেক্ষতা ধরে রাখা না যায়, তাহলে বড় বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। তাছাড়া ভালো প্রশিক্ষণ না পেলে সঠিকভাবে মূল্যায়নও করতে পারবেন না শিক্ষকরা। এটাও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছিলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মূল্যায়ন পদ্ধতির চ্যালেঞ্জের কথা যদি বলেন, সেখানে বেশকিছু নতুন বিষয় আসছে। এগুলো আমরা দেখছি। এখানে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে আরও কিছু পরিবর্তন করতে হবে। তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম যে একেবারে স্থায়ী, তা কিন্তু নয়। আমরা এর আগেও বলেছি, যে কারেকশনগুলো আসবে, সেগুলো আমরা সমাধান করব।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হচ্ছে চীন
- খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনে বাড়ছে পেটে গ্যাস
- ২৯ পণ্যের সরকারি মূল্য মানছে না ব্যবসায়ীরা
- ভারত থেকে আমদানি কমেছে
- ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করতে হবে---হামিদুর রহমান আযাদ
- আমাদেরকে ইসলামী আদর্শের দিকেই ফিরে আসতে হবে----মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন
- মানুষ ঠিকমতো মাহে রমাদানও পালন করতে পারছে না--ছাত্রশিবির সভাপতি
- সীমান্তে ২ জনের হতাহতের ঘটনা প্রমাণ করে স্বাধীনতা চরম সংকটে : মির্জা ফখরুল
- ঈদের আগেই উদ্ধারের আশা মালিকপক্ষের
- হজ, ওমরা এবং ট্রাভেল ব্যবসায়ীদের নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ