ফ্যাসিস্ট দুঃশাসনের একটি নির্মম খণ্ডচিত্র:মুহাদ্দিস আবু সাঈদের জানাজা ও দাফন
৩০ মে ২০২৫ ১৬:৪২
আবু সাঈদ মোঃ শাহাদাত হুসাইন। মুহাদ্দিস আবু সাঈদ নামে পরিচিত ছিলেন একজন বাংলাদেশ জামায়াত-ই-ইসলামী রাজনীতিবিদ এবং যশোর-২- এর সংসদ সদস্য ছিলেন।
সোনার বাংলা অন লাইন ডেস্ক
আবু সাঈদ মোঃ শাহাদাত হুসাইন। মুহাদ্দিস আবু সাঈদ নামে পরিচিত ছিলেন একজন বাংলাদেশ জামায়াত-ই-ইসলামী রাজনীতিবিদ এবং যশোর-২- এর সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন মুহাদ্দিস, একজন ইসলামী বক্তা ও আলেম। কুরআন , হাদিস , ফিকাহ , উসুল আল-ফিকাহ সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি শেখ হাসিনার আমলের এমপিদের মতো সেগুনবাগিচায় সিল মারা ব্যালট, একতরফা ভোট, রাতের ভোট কিংবা ডামি নির্বাচনের সংস্দ সদস্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রিয় সদস্য সংসদ। ২০২০ সালের ৩০ মে দুপুর ৩টার দিকে একটি ভার্চুয়াল কনফারেন্সে বক্তব্য দেওয়ার পরপরই তিনি ইন্তিকাল করেন ( ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার জানাজা ও দাফনের সময় ফ্যাসিস্ট হাসিনার পুলিশ তার স্বজনদের সাথে কেমন নিষ্ঠুর আচরণ করেছে, আজকের এই দিনে সেই ঘটনা নিয়ে একটি আবেগময় পোস্ট আবু সাঈদ মোঃ শাহাদাত হুসাইনের ছোট ভাই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পাঠকপ্রিয় কবি মোশাররফ হোসেন খান একটি আবেগময় পোস্ট তার ফেসবুকে শেয়ার করেছেন। সোনার বাংলার পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো।: ‘মুহাদ্দিস আবু সাঈদ: কী ছিল তার অপরাধ
আজ ৩০ মে, আমার বড়ো ভাই মুহাদ্দিস আবু সাঈদের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী। সকলের দোয়ায় শামিল রাখার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।
২০২০ সালের ৩০ মে দুপুর ৩টার দিকে একটি ভার্চুয়াল কনফারেন্সে বক্তব্য দেওয়ার পরপরই তিনি ইন্তিকাল করেন ( ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
আমি তখন সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি। একটি অনুষ্ঠান শেষ করে আসর নামাজ আদায় করে বাসায় আসার একটু পর একটি কল আসে। আমি ব্যস্ততার কারণে সেটা ধরতে না পারলে আমার স্ত্রীকে বললাম দেখো তো কে কল করছে। তিনি মোবাইল নিয়ে অন্য রুমে গিয়ে কল রিসিভ করলেন। অপর প্রান্ত থেকে আমার ছোট ভাই হেলাল আনওয়ার ফোনে জানালো মিয়া ভাই ইন্তিকাল করেছেন। দ্রুত খবরটি আমাকে জানালে আমি একপ্রকার ধমক দিয়ে উঠলাম, সেটা কেমন করে হয়! এইতো সকাল সাতটায় কথা হয়েছে মিয়া ভায়ের সাথে। তাকে এসব কথা বলার মধ্যেই ফোন করলেন নূরুল ইসলাম বুলবুল ভাই। তিনি একই সংবাদ দিয়ে জানালেন দ্রুত গুছিয়ে সবাইকে নিয়ে বাড়ি যাবার জন্য।
দ্রুত বললেই তো দ্রুত হয় না। সবাইকে নিয়ে গুছিয়ে গাড়ি ঠিক করে বেরোতে বেরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। পাটুরিয়া ফেরিঘাটে যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় নয়টা। ফেরিতে ওঠার পর বারবার ছোট ভাইয়ের ফোন আসছে। একই কথা। প্রশাসন চাপ দিচ্ছে দ্রুত দাফনের ব্যবস্থা করতে। আমি তাকে বললাম ওসি সাহেবকে দাও কথা বলি। সেটাও সম্ভব হলো না। উপস্থিত সবাই অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আর পুলিশ প্রশাসন চাইছে দরকার হলে তারাই নিজেদের মতো করে দাফনের কাজ সারবে, তবুও কোনভাবেই দেরি করতে দেওয়া যাবে না। প্রশাসনের এমন অন্যায্য এবং দুর্ভাগ্যজনক হঠকারিতার বিষয়ে জানার পর ছোট ভাইকে বললাম তাহলে দাফনের ব্যবস্থা করো। আল্লাহ ভরসা।
কথাটি আমার পরিবারের যারা গাড়িতে আছে তাদের কাউকে জানাইনি। জানাযায় উপস্থিত থাকতে না পারার কারণে বুকের ভেতর অসম্ভব এক কষ্ট ও যন্ত্রণা নিয়ে যেভাবে যাচ্ছিলাম ঠিক সেভাবেই আবারো ফেরি পার হওয়ার পর যাত্রা শুরু করলাম।
রাত একটার দিকে যখন ঝিকুরগাছা পার হয়ে বাঁকড়ার দিকে আমাদের গাড়ি চলছে,তখন দেখলাম আমার পেছনে এবং সামনে অনেকগুলো পুলিশ ও র্যাবের গাড়ি। কোনোটা যাচ্ছে ,কোনোটা আসছে। সেই সাথে চলছে আমাদের গাড়ি ফলো করা।
বাঁকড়া বাজারে পৌঁছানোর পর দৃশ্যপট হয়ে গেল এক ভয়ানক ভয়ালো। পুলিশের গাড়ি আমাদের গাড়ির সামনে এবং পেছনে। বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে অবস্থান করছে পুলিশ।
এর মধ্য দিয়েই বাড়িতে যখন পৌঁছুলাম তখন মধ্যরাত ছাড়িয়ে গেছে। বীভৎস এক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে আগত মানুষ ,পাড়াপড়শি সবাই অতন্দ্র প্রহরীর মতো আগলে রেখেছে আমাদের বাড়িটি। সকলের বুকে কান্নার তুফান। শোকের মাতম।
পরদিন জেনেছি, তারা কেউ রাস্তা দিয়ে আসতে পারেনি। এসেছে মাঠ ঘাট বন বাদাড় দিয়ে।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, মুহাদ্দিস আবু সাঈদ কি ছিলেন কোনো সন্ত্রাসী? নাকি খুনের আসামী? কী ছিল তার অপরাধ?
আসলে তিনি এসবের কিছুই ছিলেন না। তিনি ছিলেন গোটা যশোর বাসীর প্রাণের স্পন্দন । ভালোবাসার পাত্র। আশ্চর্য, ভালোবাসাও শত্রুদের মনে ভয়ের কম্পন তোলে? বাস্তবে না দেখলে হয়তো আমারও বিশ্বাস হতো না।
মাত্র কয়েকদিন ছিলাম বাড়িতে। শোক কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না অশতিপর অসুস্থ মা। অবশ্য কেউই পারছিলেন না। না বাড়ির লোক, না প্রতিবেশী, না এলাকার লোক।
পরদিন বহু দূর দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ এসেছেন মাঠের রাস্তা ব্যবহার করে তাঁর কবর জিয়ারত করার জন্য। কারণ তখনও, এমনকি কয়েকদিন যাবত প্রত্যেকটি রাস্তায় টহল দিয়ে রাখছে পুলিশ। যেন কেউ আমাদের বাড়িতে আসতে না পারে। কিন্তু জোয়ার যখন উথলে ওঠে তখন সে আর কোনো বাধা মানে না। তেমনি ঘটেছিল আমার চোখের সামনে বাড়িতে। জোয়ার প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল আমাদের ছোট্ট আঙিনাটি। মানুষের ভালোবাসা তিনি পেয়েছিলেন জীবিত অবস্থায়। তার মৃত্যুর পর আরো অনেক অনেক বেশি পাচ্ছেন। আশা করি পেয়ে যাবেন এভাবেই।
ফ্যাসিবাদের জেল ,জুলুম, নির্যাতন সবকিছু উপেক্ষা করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জনগণের খুব কাছের মানুষ। আপনজন। তার প্রতি মানুষের এই অকৃত্রিম ভালোবাসা, এটা জালিম সরকারের কখনোই পছন্দ ছিল না। যে কারণে বারবার তাকে জেল জুলুমের শিকার হতে হয়েছে।
তিনি ছিলেন মজলুম। তিনি যেমন জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, ঠিক তেমনি ছোট ভাইগুলোও বিনা অপরাধে জেল জুলুমের শিকার হয়েছে। তাদের নামে অসংখ্য মিথ্যা মামলা। মোটকথা আমাদের গোটা পরিবারটি জুলুমের শিকারে পরিণত হয়েছিল।
অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে চব্বিশের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট মুক্ত হয়েছে এদেশ। দেশের মানুষ ফিরে পেয়েছে বাক স্বাধীনতা, অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা, স্বাধীন মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। মানুষের এই অনিবার্য প্রাপ্য স্বাধীনতা আনার জন্যই ছিল মুহাদ্দিস আবু সাঈদের মতো হাজারো নির্ভীক বিপ্লবীদের আপসহীন সংগ্রাম।
আফসোস! তিনি তার স্বপ্নের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলেন না। তবুও এইসব সংগ্রামী লড়াকু বিপ্লবীদের নাম যেন ইতিহাসের পাতা থেকে কখনো মুছে না যায়, সেটা লক্ষ্য রাখার বিষয়।
যারা চলে গেছেন তাদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে যোগ্য উত্তরসূরীদের। এটাই সময়ের দাবি।
আল্লাহ তার ভালো কাজগুলোকে কবুল করুন, ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন, সর্বশেষ তাকে সম্মানিত স্থানে অধিষ্ঠিত করুন— এটাই আজকের দিনে একান্ত কামনা।
মোশাররফ হোসেন খান
৩০.৫.২০২৫’