আওয়ামী শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন ও পরিমার্জন

যথাসময়ে নতুন বই হাতে পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা


২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ০০:০০

যুক্ত হচ্ছে গণঅভ্যুত্থানের লেখা ও গ্রাফিতি
॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন ॥
আগামী ১ জানুয়ারি ২০২৫ সালে নতুন পাঠ্যবই হাতে পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো তৎপর রয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ধারাবাহিক তদারকি করছে- যাতে বই ছাপাতে পারেন প্রেস মালিকরা। সর্বশেষ বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সঙ্গে গত ২২ ডিসেম্বর রোববার বৈঠক করে এনসিটিবি। ওই বৈঠক থেকে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রাথমিকের সব বই এবং মাধ্যমিকের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই ছাপা শেষ করে স্কুলে পৌঁছাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তাছাড়া ২০২৫ সালের ১০ জানুয়ারির মধ্যে মাধ্যমিকের আরও পাঁচটি বই এবং ২০ জানুয়ারির মধ্যে বাকি সব বই পৌঁছানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। এনসিটিবি জানায়, বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৪০ কোটি ১৬ লাখের বেশি পাঠ্যবই ছাপাতে ছাপাখানা মালিকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে সরকার। চুক্তি অনুযায়ী দ্রুত ছাপার কাজ চলছে।
বই ছাপাতে সময় চেয়ে গোপন আবেদন, কঠোর অবস্থানে এনসিটিবি
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি রাব্বানী জাব্বার এবং সাধারণ সম্পাদক কাউসারুজ্জামান রুবেলকে ডেকে গত ২২ ডিসেম্বর এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান যথাসময়ে বই ছাপার কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেন। বেঁধে দেওয়া সময়সীমা অনুযায়ী, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রাথমিকের সব বই এবং মাধ্যমিকের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই ছাপা শেষ করে স্কুলে পৌঁছাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তাছাড়া ২০২৫ সালের ১০ জানুয়ারির মধ্যে মাধ্যমিকের আরও পাঁচটি বই এবং ২০ জানুয়ারির মধ্যে বাকি সব বই পৌঁছানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। জানা গেছে, বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির অফিসিয়াল প্যাডে শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর একটি চিঠি লেখেন সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান জুনায়েদুল্লাহ আল মাহফুজ। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘২০২৫ সালের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য আগামী ২৪ মার্চ পর্যন্ত সময় প্রয়োজন। এর আগে পাঠ্যবই ছাপা শেষ করা সম্ভব নয়।’ আর এরই প্রেক্ষিতে সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ডেকে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনও করেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান। এতে তিনি বলেন, শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর প্রেস মালিকদের একজন সদস্য যে আবেদন দিয়েছেন, এটা কোনোভাবেই বিধিসম্মত নয়। আমরা গোয়েন্দা সংস্থা এবং অন্য অংশীদারদের সমন্বয়ে তদন্ত করেছি, পাঠ্যবই পৌঁছাতে চুক্তি হওয়া সময়ের বেশি লাগবে না। তারা এখন শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে লিখিত আবেদনের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান জুনায়েদুল্লাহ আল মাহফুজ বলেন, আমি লিখিত আবেদনের জন্য ক্ষমা চাই। কয়েকজন প্রেস মালিকের দাবির প্রেক্ষিতে আমি এ ধরনের আবেদন জমা দিয়েছিলাম। মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি মো. রাব্বানী জাব্বার বলেন, শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে লিখিত আবেদনের বিষয়ে আমি অবগত ছিলাম না। বিষয়টির জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। এ ধরনের ভুল বোঝাবুঝির জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। এ ধরনের কাজ আর কখনো হবে না। এনসিটিবির সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছাতে কাজ করছি। এদিকে, শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে লিখিত আবেদনের বিষয়টি জানাজানি হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এনসিটিবি কর্মকর্তাদের ওপর চাপ আসতে থাকে। পরিস্থিতি ঘোলাটে দেখে এনসিটিবি কর্মকর্তাদের পরামর্শে রাতে আবার শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর চিঠি লেখেন মুদ্রণ সমিতির এ নেতা। তাতে ‘বিভ্রান্তি ছড়ানো’ ও ‘জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ’ করায় জাতির কাছে ক্ষমা চান তিনি।
জানুয়ারিতেই পাঠ্যবই পাবে শিক্ষার্থীরা
বছরের প্রথম দিনই নতুন পাঠ্যবই হাতে পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তবে বছরের প্রথম দিন সব বই শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে কিছুটা সংশয় এখনো রয়েছে। কারণ এখনো সব বই হাতে পায়নি এনসিটিবি। তবে এনসিটিবি জানিয়েছে, জানুয়ারি মাসের মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জানুয়ারির মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে। এ বছর সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই পৌঁছাতে পারা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও নভেম্বর মাসে বিশেষ ব্যবস্থা নেয় সরকার। বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে ডিপিএম পদ্ধতিতে (টেন্ডার ছাড়া সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি) এক কোটি পাঠ্যবই দ্রুত ছাপতে আর্মি প্রিন্টিং প্রেসকে দেওয়া হয়।
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, ৭৫ শতাংশ বইয়ের জোগান ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা হলো, ৯০ শতাংশ বই ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে হাতে আসছে। বাকি ১০ শতাংশ বই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে যাবে। মাধ্যমিকের এক কোটি বই ছাপানোর জন্য সরাসরি আর্মি প্রিন্টিং প্রেসকে দিয়েছি সরাসরি ডিপিএম পদ্ধতিতে (ডিরেক্ট পারচেজ ম্যাটার), যাতে বই ছাপার প্রক্রিয়াটি দ্রুত হয়।’ এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, ডিসেম্বরের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি পাঠ্যবই ছাপিয়ে শিক্ষার্থী পর্যায়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকের পাঠ্যবই ডিসেম্বরের মধ্যেই ছাপা শেষে মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এনসিটিবি জানায়, এবার মোট বইয়ের সংখ্যা ৪০ কোটি ১৬ লাখের মতো। এর মধ্যে মাদরাসার ইবেতেদায়ি এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য দুই কোটি ৩১ লাখের মতো এবং প্রাথমিক স্তরের জন্য ৯ কোটি ২০ লাখের মতো। ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে (২০১৩ সাল থেকে পাঠ্যবই) ফেরত যাওয়ায় মাধ্যমিকের বইয়ের সংখ্যা এবার বেশি। কারণ স্থগিত হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থীকে ১৪টি করে বই পড়তে হতো। আর ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ২২টি করে এবং নবম-দশম শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ৩৩টি করে বই ছাপতে হতো। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের পড়তে হতো ১৪টি করে পাঠ্যবই।
এবার উৎসব হচ্ছে না
এবার নতুন বছরের প্রথম দিনে পাঠ্যবই উৎসব হবে না। দেশে বিনামূল্যের পাঠ্যবই সরবরাহের শুরু থেকে প্রত্যেকবার বছরের প্রথম দিন বই উৎসব করে বই বিতরণ করা হতো। ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১ জানুয়ারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই উৎসব করেই তুলে দেওয়া হয়। তবে এবার নতুন বছরে পাঠ্যবই উৎসব অনুষ্ঠান হবে না। এনসিটিবির চেয়ারম্যান রিয়াজুল হাসান বলছেন, ‘বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হবে। বই উৎসব করে অর্থ অপচয় করা হবে না।’ শিক্ষার্থীরা যাতে নির্ভুল বই পায় এবং যথাসময়ে পায়, সেদিকে বেশি নজর দিয়েছে সরকার। আনুষ্ঠানিক উৎসবে সরকারের কোনো আগ্রহ নেই।
বইয়ে পরিবর্তন বিলম্বে শুরু হয় ছাপার কাজ
মাধ্যমিকের প্রতি শ্রেণির বাংলা বইয়ে যুক্ত হয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে লেখা, কবিতা অথবা কার্টুন। প্রতিটি বইয়ের পেছনের কভারে থাকছে গ্রাফিতি। এর বাইরে ইতিহাসনির্ভর অনেক বিষয়েও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সেইসঙ্গে পাঠ্যবই থেকে বাদ যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ‘অতিরঞ্জিত’ চিত্র। এনসিটিবি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর আওয়ামী শিক্ষাক্রম পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার কথা জানানো হয়। এ কারণে চলতি বছরের চেয়ে আগামী শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বাতিল করা নতুন শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক স্তরে একেকটি শ্রেণির জন্য ১০টি বিষয় ছিল। পুরোনো শিক্ষাক্রমে বিষয় আরও বেশি। যেমন পুরোনো শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিকে বইয়ের সংখ্যা ২৩ (সবকটি সবার জন্য নয়)। ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ায় আবার ছাপা হচ্ছে আরবি, সংস্কৃত, পালি ভাষা শিক্ষা বই। এনসিটিবি জানায়, ‘ইতিহাসে যার যার যে স্থান বা ভূমিকা, সেটাই আমরা নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এজন্য পরিমার্জনের সঙ্গে জড়িত লেখক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবীদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।’ বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এজন্য মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন ইতিহাসনির্ভর বিষয়েও কিছু কাটছাঁট করা হয়েছে। এনসিটিবি সূত্র বলছে, পাঠ্যবইয়ে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে মেজর জিয়াউর রহমানের নাম যুক্ত করা হয়েছে। আর বাদ যাচ্ছে বইয়ের শেষ কভারে লেখা শেখ হাসিনার ছবিসংবলিত বাণী। একই সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লেখাও বাদ যাচ্ছে পাঠ্যবই থেকে। গণঅভ্যুত্থানে শহীদ দু-একজনের কথাও পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে গত ১৬ জুলাই রংপুরে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে যান তিনি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সংশোধনী আনার কারণে বই ছাপা শুরুই হয়েছে বিলম্বে, তাই কিছুটা সময় লেগে যেতে পারে।
ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রায়হানা খানম বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে যথাসময়ে বই পৌঁছে যাবে বলে আগেই শিক্ষা অফিস থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরাও সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়েছি। ৩১ ডিসেম্বরের আগেই স্কুলে নতুন পাঠ্যবই পৌঁছে যাবে এবং শিক্ষার্থীরা ১ জানুয়ারি ২০২৫ সালের নতুন বই হাতে পাবে।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার নতুন শিক্ষাক্রম বাদ দিয়ে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই পরিমার্জন করে ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এ প্রক্রিয়ায় বই পরিমার্জনের কাজ ও কিছু ক্ষেত্রে নতুন করে দরপত্রের কারণে ছাপার কাজে দেরিতে শুরু হয়। বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান জানিয়েছেন, এবার বিভিন্ন কারণে ছাপার কাজ দেরিতে শুরু হয়েছে। আবার কাগজের সংকটও আছে। তারপরও যথাসময়ে বই পাওয়ার সব প্রক্রিয়াই সম্পন্ন করা হয়েছে।