হত্যা মামলার আসামি কানুকে গ্রেফতার না করায় সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ০০:০০
সোনার বাংলা ডেস্ক: কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে খুনের মামলার আসামি সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ আব্দুল হাই ভূঁইয়া কানুকে নিয়ে নির্যাতিত জনতার আবেগীকাণ্ডে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র ঝড় বইছে। সবার প্রশ্ন একটাইÑ মুক্তিযোদ্ধা হলেই কী তার সব অপরাধ মাফ। মুক্তিযোদ্ধারা কি আইনের ঊর্ধ্বে? এমন বৈষম্যমুক্ত সমাজের জন্যই কি ছাত্র-জনতা জীবন দিয়ে দ্বিতীয় স্বাধীনতা এনেছে? হত্যা চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলার আসামি কানুকে গ্রেফতার না করায় সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ অব্যাহত আছে।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের কুলিয়ারা উচ্চবিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্বে কেন্দ্রীয় কৃষক লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই ভূঁইয়া কানুকে লাঞ্ছিত করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ ঘটনায় কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস অভিযুক্তদের গ্রেফতারে বিবৃতি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। কানুর বিরুদ্ধে ৮-৯টি মামলা রয়েছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তারপরও তাকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে নাÑ এ নিয়েও জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ কানু কতিপয় রাজনৈতিক দলের নেতা ও সরকারের এমন আনুকূল্যের সুযোগের অপব্যবহার করে দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় অপতথ্য প্রচার করছে, যা ৩৬ আগস্টের বিপ্লব ও এ সরকারের জন্য মানহানিকর বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকমহল।
চৌদ্দগ্রাম থানা ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আব্দুল হাই কানুর বিরুদ্ধে ১টি হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ১ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, গত ২২ ডিসেম্বর রোববার দুপুরে বাতিসা ইউনিয়নের কুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযোদ্ধা ও কেন্দ্রীয় কৃষক লীগ নেতা আব্দুল হাই ভূঁইয়া কানুকে জুতার মালা পরায় প্রবাসী আবুল হাশেমসহ এলাকার কতিপয় যুবক। এ সময় উপস্থিত স্থানীয়দের বলতে শোনা যায়, আব্দুল হাই কানুর কারণে তারা গত ১৫ বছর এলাকায় থাকতে পারেনি। ২০১৬ সালে যুবলীগ নেতা আবু বক্কর ছিদ্দিক প্রকাশ রানা হত্যার প্রতিবাদে এবং অভিযুক্ত কৃষক লীগ নেতা আবদুল হাই ভূঁইয়া কানু ও তার ছেলে গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বিপ্লবকে গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে স্থানীয় আ’লীগ সমাবেশ করে। সমাবেশে উপজেলা আ’লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাবেক চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন বলেন, আব্দুল হাই কানুর কারণে স্থানীয় আ’লীগ নেতাকর্মীরাও এলাকা ছাড়া।
ফেনীতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানু মুঠোফোনে অভিযোগ করেন, আমি রোববার পেশার মাপার জন্য স্থানীয় পাতড্ডা বাজারে একটি ফার্মেসিতে যাই। সেখানে আমার পেশার মাপাকালীন আবুল হাশেম নামের এক ছেলের নেতৃত্বে কয়েকজন আমাকে টেনেহিঁচড়ে কুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে আসে। এ সময় তারা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে গলায় ‘জুতার মালা’ পরিয়ে দেয়। ভয়ে আমি উপস্থিত সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে গত ২২ ডিসেম্বর রোববার বিকেলেই ফেনীতে চলে আসি। আজ (সোমবার) ফেনী সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে রামপুর এলাকায় ভাগিনার বাসায় অবস্থান করছি। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আলাপ করে থানায় অভিযোগ করা হবে।
গত ২৩ ডিসেম্বর সোমবার সকালে সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে স্থানীয় জসিম উদ্দিন বলেন, আবদুল হাই ভুঁইয়া কানুর সাথে আ’লীগ ব্যতীত আর কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দ্বন্দ্ব নেই। ভাইরাল ভিডিওটি রাজনৈতিক নয়। এলাকার ভুক্তভোগী কতিপয় যুবক ঘটনা করেছে। এ সময় আমিও সাথে ছিলাম। হত্যাকাণ্ডের শিকার যুবলীগ নেতা রানা হত্যা মামলায় ১নং আসামি আবদুল হাই কানু। তিনি কুলিয়ারা উচ্চবিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আবদুল হালিম মজুমদারকে লাথি মেরে পুকুরে ফেলে দেয়। ওই নির্বাচনে আমাকেও লাঞ্ছিত করে।
স্থানীয় ট্রাক্টরচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, পারিবারিক দ্বন্দ্বে এ ঘটনা ঘটেছে। এর সাথে রাজনীতির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। গত ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর যুবলীগ নেতা আবু বক্কর ছিদ্দিক প্রকাশ রানাকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে কানু, তার ছেলে বিপ্লব ও তাদের সহযোগীরা। ওইদিন আমি নিজেও গুলির শব্দে ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে আহত হই। কানু আমার চাচা নুরুল ইসলাম মিনারকে রাতের আঁধারে মারধর করে। একই বছর তিনি মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া নঈম নামে এক ব্যবসায়ীকে একটি অনুষ্ঠানে দুপুরে খাওয়ার সময় হেনস্তা করে এলাকাছাড়া করে।
আবদুল হালিম মজুমদারের ভাই আবদুর রহমান (৮০) অভিযোগ করে বলেন, কানু আমার ভাইকে বিদ্যালয়ের নির্বাচনের সময়ে লাথি মেরে পুকুরে ফেলে দেয়। আ’লীগ সরকারের সময়ে আমার ভাইয়ের থেকে ২৬ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করে। এমনকি আমার ঘর নির্মাণের সময় আমার থেকেও ৭ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের আরও বলেন, বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির নির্বাচনের দ্বন্দ্বেই গত ২২ ডিসেম্বর রোববার দুপুরে কানুকে আটক করে এলাকাবাসী।
সাবেক ইউপি মেম্বার ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আবদুল হক বলেন, কানু গত ১৭ বছরে এলাকায় সন্ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করেছে। একাধিক হত্যা, বাড়িঘর ভাঙচুর এবং চাঁদাবাজির সাথেও সে জড়িত। স্থানীয়রা পূর্বের ক্ষোভ থেকে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি বেলাল হোসাইন বলেন, কৃষক লীগ নেতা আব্দুল হাই ভূঁইয়া কানু হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলার আসামি। পূর্বের বিভিন্ন বিরোধ থেকে এলাকাবাসী এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এর সাথে রাজনৈতিক কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
চৌদ্দগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এটিএম আক্তার উজ জামান গত ২৩ ডিসেম্বর সোমবার দুপুরে বলেন, আব্দুল হাই কানুর বিরুদ্ধে ৮-৯টি মামলার বিষয়ে পুরনো অপারেটরের মাধ্যমে জেনেছি। তবে আমার কাছে একটি হত্যা মামলা এবং একটি ভাঙচুরের মামলার তথ্য রয়েছে। ভাইরাল ভিডিওতে অভিযুক্তদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। ওনারা এখনো কোনো অভিযোগ দেয়নি। আইনি ব্যবস্থার জন্য যা করা প্রয়োজন, আমরা সে ব্যবস্থা নিচ্ছি’। কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আরাফাতুল ইসলাম বলেন, সকলের সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। কোনো ব্যক্তি যদি কোনো অপরাধ করে, আইন অনুযায়ী বিচার হবে। অপরাধীকে জুতার মালা পরিয়ে সম্মানহানির কোনো সুযোগ আইনে নেই।