স্বৈরাচার পতনের ৩৪ বর্ষপূর্তি

তীব্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট এরশাদ

স্টাফ রিপোর্টার
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:০০

জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে আজ থেকে ৩৪ বছর পূর্বে পতন ঘটে স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের। গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়লেও প্রায় তিন দশক ধরে রাজনীতিতে কীভাবে টিকে ছিলেন এ স্বৈরাচার। তাকে রাজনীতিতে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেছিল সদ্য পতন হওয়া ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি এরশাদ। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগসহ ওই সময় রাজপথে থাকা অধিকাংশ বিরোধীদল কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলে। একপর্যায়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
স্বৈরাচার পতনের এ দিনটিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। বিএনপি ‘গণতন্ত্র দিবস’, পতিত আওয়ামী লীগ দিনটিকে ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’, হিসেবে পালন করতো। এছাড়া স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টি ‘সংবিধান সংরক্ষণ দিবস’ হিসেবে দিনটি পালন করে।
দুর্নীতি ও অপশাসনের কারণে এরশাদের পতন হয়। তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসের এক তারিখে ঢাকা সেনানিবাসে এক জরুরি বৈঠকে বসেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। সে বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদ যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, সে প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত, সে বিষয়ে আলোচনা করা। জেনারেল এরশাদবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এর কয়েকদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় চিকিৎসক নেতা ডা. শামসুল আলম মিলনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সেনানিবাসের ভেতরে ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, দেশের চলমান সংকট একটি রাজনৈতিক বিষয় এবং এ সংকট সমাধানের জন্য রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা আরো সিদ্ধান্ত নিলেন যে, চলমান রাজনৈতিক সংকটে সেনাবাহিনীর করণীয় কিছু নেই। এমন অবস্থায় প্রেসিডেন্ট এরশাদ সেনা সদরকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, দেশে সামরিক আইন জারি করা হবে।
এরপর ডিসেম্বরের ৩ তারিখে তখনকার সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূর উদ্দিন প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে দেখা করতে যান। সেনা কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূর উদ্দিন যেন প্রেসিডেন্ট এরশাদকে পদত্যাগের জন্য সরাসরি বলেন।
কিন্তু সেনাপ্রধান প্রেসিডেন্ট এরশাদকে সরাসরি পদত্যাগের কথা না বললেও তিনি জানিয়ে দেন যে, দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অফিসাররা কোনো দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছে না। তখন ঢাকা সেনানিবাসে ব্রিগেডিয়ার পদে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। তিনি ২০১৩ সালে ইন্তেকাল করেন।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি বাংলার সাথে এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল চৌধুরী বলেন, উনি (সেনাপ্রধান) প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন আপনার উচিত হবে বিষয়টির দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান করা। অথবা বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেয়া। জেনারেল এরশাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সামরিক শাসন জারির বিষয়ে সেনাবাহিনী একমত নয় বলে প্রেসিডেন্টকে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন তখনকার সেনাপ্রধান। প্রেসিডেন্টের সাথে সেনাপ্রধানের বৈঠক নিয়ে তখন দেশজুড়ে নানা গুঞ্জন। সেসব বৈঠক নিয়ে নানা অনুমান তৈরি হয়েছিল সে সময়।
একদিকে ক্যান্টনম্যান্টের ভেতরে নানা তৎপরতা; অন্যদিকে রাস্তায় এরশাদবিরোধী বিক্ষোভ। সব মিলিয়ে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল। ডিসেম্বর মাসের চার তারিখে সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম প্রেসিডেন্ট এরশাদকে সরাসরি বলেন, তার পদত্যাগ করা উচিত। ‘পদত্যাগের কথাটা জেনারেল সালামই প্রথম সরাসরি বলেন। অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। আর্মি অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে’, বলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী।
জরুরি অবস্থা এবং কারফিউ জারির মতো কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমেও যখন গণআন্দোলন দমানো যাচ্ছিল না, তখন সেনাবাহিনীর দিক থেকে নেতিবাচক মনোভাব দেখলেন স্বৈরাচার এরশাদ। এমন অবস্থায় ডিসেম্বরের চার তারিখ রাতেই পদত্যাগের ঘোষণা দেন জেনারেল এরশাদ। এরশাদ সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন মওদুদ আহমদ, তিনি গণমাধ্যমকে জানালেন, সেনাবাহিনীর মনোভাব বোঝার পরেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি এরশাদ। তবে এর আগে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই স্বৈরশাসক মারা যান।