আ’লীগ আমলে চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রের উত্থান
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:০০
স্টাফ রিপোর্টার : বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রের উত্থান ঘটে। রাজনৈতিক গোষ্ঠী, উর্দি পরা বা উর্দি ছাড়া আমলা এবং ব্যবসায়ী- এ তিন গোষ্ঠীর সমন্বয়ে চোরতন্ত্র সৃষ্টি হয়। চোরতন্ত্রের বিষবৃক্ষ সৃষ্টির উৎস ছিল ২০১৪ সাল থেকে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন। এর মাধ্যমে মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার এবং জবাবদিহির জায়গা নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। এখান থেকে বেরোনোর জন্য জবাবদিহিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি। গত ১ ডিসেম্বর রোববার অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রকাশের পরদিন গত ২ ডিসেম্বর সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে এর প্রণয়ন কমিটির প্রধান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এমন মন্তব্য করেন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনইসি ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শ্বেতপত্র কমিটির বাকি ১১ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। গত ১ ডিসেম্বর রোববার অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে রিপোর্ট জমা দেয় কমিটি। কমিটি বর্তমান সরকারের ন্যূনতম দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন, সংস্কারের অগ্রাধিকার নির্ধারণ, উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সংলাপসহ বিভিন্ন সুপারিশ করেছে।
শুরুতে শ্বেতপত্র প্রণয়নের পদ্ধতি বর্ণনা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল চুরির বর্ণনা দেওয়া। চোর ধরা কমিটির উদ্দেশ্য নয়। এটি দুদক, বিএফআইইউ, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা দেখবে। রিপোর্ট প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রথাগত জ্ঞান, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা, নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক এবং জনশুনানির ভিত্তিতে করা হয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ৬০টি সভা করা হয়েছে। ১৮ বার এ কমিটি মিলিত হয়েছে। আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। উঁচু মানের পেশাদারিত্বের সঙ্গে রিপোর্ট করা হয়েছে।
সুপারিশ বাস্তবায়নের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মনে রাখতে হবে যে, অর্থনীতিতে মনোযোগের অভাবে রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি মনে করে, বিগত সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংকিং খাতে। এরপর অবকাঠামো, তৃতীয় জ্বালানি এবং চতুর্থ তথ্যপ্রযুক্তি খাত। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ১০০ টাকার পণ্য ১ লাখ টাকা দেখিয়ে কেনা হয়েছে। এর আগে দুর্নীতির টাকা সাধারণত দেশের মধ্যে বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ হলেও বিগত সরকারের সময়ে বেশিরভাগ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ বা বিচার বিভাগ যখন গোষ্ঠীবদ্ধভাবে একটি চুরির অংশ হয়ে যায়, সেটাই চোরতন্ত্র। চোরতন্ত্রের ভেতরে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী, উর্দি পরা বা উর্দি ছাড়া আমলা এবং ব্যবসায়ীদের সহযোগ সৃষ্টি করা হয়। তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার এবং সামাজিক শক্তিকে দুর্বল করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক শক্তি অবশ করে দেওয়া হয়েছে। এর ভেতরে ছিল নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমকর্মী এবং বেসরকারি খাতের লোকজন। অনেক সময় বিদেশিরা অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রশংসা করেছে। যেসব বিষয় নিয়ে প্রশংসা করেছে, তার ভিত্তি এখন সন্দেহের ভেতর রয়েছে। এ জায়গা থেকে বের হওয়ার জন্য জবাবদিহিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সংস্কারে যেতে হলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার স্থিতিশীলতা থাকা জরুরি। অন্যদিকে যদি বাজারে পণ্যের দর নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার বিপদসংকুল হবে। এর জন্য মানুষের যে ধৈর্য দরকার, তা থাকবে না।
কমিটির সদস্যদের মধ্য থেকে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, একসময় বলা হতো, মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিতে আছে দেশ। এটি ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। এখান থেকে বের হওয়ার তিনটি উপায়ের পরামর্শ দেন তিনি। প্রথমত, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, প্রয়োজনীয় সংস্কার ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মেগা প্রকল্পের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়েছে বেশি। অতিমূল্যায়িত প্রকল্পের ঋণের জন্য মাথাপিছু দেনার বোঝা বাড়ছে। একসময় ৪৭ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ থেকে বছরে ২ বিলিয়ন যেত ঋণ পরিশোধে। এখন ২০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার যায়। ঋণের কারণে সৃষ্ট এ সংকট এড়াতে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সুদহার কমানো এবং পরিশোধের সময় বাড়িয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, সংস্কারের বিরোধিতা এখনো রয়েছে। বিনিয়োগ বাড়াতে চাইলে সব খাতের সংস্কার করা প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু ইউসুফ বলেন, করছাড় সুবিধার ক্ষেত্রে এনবিআর কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করে না। প্রয়োজনীয় গবেষণাও নেই প্রতিষ্ঠানটির। অথচ করজালের বাইরে থাকা এক কোটি করযোগ্যকে শনাক্ত করা এবং করছাড় অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক খাতে দ্বিগুণ বিনিয়োগ করা সম্ভব।
ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটির সহ-উপাচার্য ড. এনামুল হক বলেন, সরকারি ব্যয়ের অন্তত ৪০ শতাংশই তছরুপ হয়েছে গত ১৫ বছরে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ম. তামিম বলেন, নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদন না বাড়িয়ে এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
ব্র্যাক বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন দারিদ্র্যের সংজ্ঞা ও আয়বৈষম্য নিয়ে কথা বলেন। এ সময় ড. দেবপ্রিয় বলেন, ৮৫ শতাংশ সম্পদের কর্তৃত্ব করছে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শারমিন্দ নিলোর্মি বলেন, বিগত সময়ে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির সংস্কৃতি তৈরি হয়। জলবায়ু তহবিলের কেন স্বচ্ছতা থাকবে না! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রামরুর চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, অভিবাসনের জন্য হুন্ডির মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ পাচার হয়েছে। বিল্ডের প্রধান নির্বাহী ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগ জটিলতা ছিল সবচেয়ে বেশি।
সরকারের কাছে ৫ সুপারিশ : শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি সুপারিশ তুলে ধরে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকার এসব বাস্তবায়ন করবে কিনা, তা সময় হলে বোঝা যাবে।