দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ চায় বিএনপি


১৪ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০০

॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন ॥
দল গোছাতে সক্রিয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের পর অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে দীর্ঘদিন রাজপথে থাকা এ দলটি। ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর দলটির জন্য এখনই সবচেয়ে ভালো সময়। আর এ ভালো সময়কে কাজে লাগিয়ে বিএনপি দেশজুড়ে তাদের মূল ও অঙ্গ সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করতে চায়। কারণ বিএনপির সামনে এখন একটাই লক্ষ্য- তারা দ্রুত একটি জাতীয় নির্বাচন চায়, যে নির্বাচনের মাধ্যমে দলটি দেশপরিচালনার সুযোগ চাইবে। সম্ভাব্য নির্বাচনে যাতে বিজয় অর্জন করা যায়, সেটিই এখন মূল লক্ষ্য। দলটি এখন যেসব কার্যক্রম নিচ্ছে, তার উদ্দেশ্যেই হচ্ছে ভোটে অংশ নেওয়া। সরকারের কাছেও দলটি দ্রুত নির্বাচন চাইছে। কারণ বিএনপি মনে করে, নির্বাচিত সরকারের হাতেই দেশ বেশি নিরাপদ।
গত ৮ নভেম্বর রাজধানীসহ সারা দেশে সিপাহি-জনতার বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে র‌্যালি করে বিএনপি। ওই র‌্যালিতে উজ্জীবিত বিএনপির নেতাকর্মীরা। বিএনপি মনে করে ওই র‌্যালিতে ব্যাপক সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। দলমত-নির্বিশেষে সাধারণ জনগণের শহীদ জিয়াউর রহমানের প্রতি যে সম্মান ও ভালোবাসা তা প্রমাণ করেছে এবারের র‌্যালিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। দলটি সাংগঠনিক কাজগুলো আরও সুচারুরূপে সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য নতুন কিছু কর্মসূচি পালন করবে। গত ১১ নভেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ওই বৈঠকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, সিলেট, রংপুর, কুমিল্লা ও ফরিদপুর বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করার কথা আলোচনা হয়েছে। প্রথমে ঢাকা অথবা চট্টগ্রাম দিয়ে বিভাগীয় সমাবেশ শুরু করতে পারে বিএনপি। দলটি মনে করে, কর্মসূচি দিয়ে নেতাকর্মীদের সক্রিয় রাখতে হবে।
বিএনপি সর্বশেষ অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির সূত্রে জানা গেছে, তারা দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ চায়। একইসঙ্গে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে চায় দলটি। রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডার আড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা না করতে এবং বিএনপির রাজনৈতিক শক্তিকে যাতে খাটো করে না দেখা হয়, সেই বার্তাও থাকবে বিভাগীয় সমাবেশে। আগামী মাসের শুরুতে সমাবেশ শুরু হতে পারে। দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে আলোচনা করে শিডিউল চূড়ান্ত করবে দলটি। জানা গেছে, এছাড়া ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে আরও একটি বড় জনসমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। পাশাপাশি জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে ৩১ দফা প্রস্তাব নতুন করে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
বার্তা সংস্থা ইউএনবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতায় এলে ৪২টি সমমনা রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দেশ পরিচালনার মূলমন্ত্রে রূপ নেবে। সংস্কার রূপরেখার মাধ্যমে জনগণের সমর্থন অর্জনের উদ্দেশ্যে বিএনপি নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনগুলোর কর্মীদেরও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব নেতাকর্মী দেশের বিভাগীয় শহর ও গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরগুলোয় কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে ৩১ দফা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করবেন। সেইসঙ্গে রূপরেখাটি আরও সমৃদ্ধ করতে বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন খাতের লোকদের কাছ থেকে এ বিষয়ে বিএনপি প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করবে বলেও জানা গেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, তাদের শেষ দুটি বৈঠকে সংস্কার, নির্বাচন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জামায়াত ও অন্যান্য দলের সঙ্গে সম্পর্ক এবং বিএনপির পরবর্তী করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
ওই নেতা বলেন, বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনী প্রক্রিয়াÑ দুটিই একইসঙ্গে এগিয়ে যাওয়া উচিত। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে অবিলম্বে একটি (নির্বাচনের) রোডম্যাপ উপস্থাপন করতে হবে। যতদিন এ রোডম্যাপ দেওয়া না হবে, ততদিন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন পেছানোর আশঙ্কা থেকেই যাবে। তিনি বলেন, বিএনপির বিশ্বাস করে যে, এ সরকারের কেবল নির্বাচনী প্রক্রিয়া সংস্কারের দিকেই মনোনিবেশ করা উচিত। কারণ বড় আকারের সংস্কার বাস্তবায়নে এ সরকারের কোনো ম্যান্ডেট নেই। তিনি আরও বলেন, আমাদের নীতিনির্ধারকদের সন্দেহ, পর্যায়ক্রমে উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো, আসলে এ সরকারের দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় থাকার কৌশলের অংশ।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত কোনো কূটকৌশলের আশ্রয় না নিয়ে অবিলম্বে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা উপস্থাপন করা। তিনি বলেন, ‘জাতি নির্বাচনের তারিখ জানতে চায়। সরকার যদি দেশের জনগণকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে, তাহলে অলসভাবে বসে বসে তাদের উপহাস দেখার কোনো কারণ দেখছি না।’ তার ধারণা, অহেতুক কালবিলম্ব না করে সরকার শিগগিরই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেবে। দেশের মানুষ অতীতে অনির্বাচিত সরকার মেনে নেয়নি, ভবিষ্যতেও নেবে না।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নিজস্ব চিন্তা ও দর্শনের ভিত্তিতে রাষ্ট্র সংস্কারের কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) কেবল সেই সংস্কারগুলোই বাস্তবায়ন করতে পারে, যা সব পক্ষের দ্বারা অনুমোদিত। এতে আমাদের (বিএনপির) কোনো আপত্তি নেই। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশে দ্রুত গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে- এমন সংস্কার তারা করতে পারে।’ আমীর খসরু বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৬ সালে ভিশন ২০৩০-এর মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তারেক রহমানও এক বছর আগে সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ৩১ দফা সংস্কার পরিকল্পনা প্রস্তাব করেন। ‘বিএনপি শুধু ঐক্যের ভিত্তিতে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবই উত্থাপন করেনি, তারা এটাও বলেছে যে, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ যদি আমাদের দলকে সমর্থন দেয়, তাহলে জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য, জনগণের পূর্ণ সমর্থন ও আস্থার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সংস্কার সাধন করতে হবে। আর নির্বাচিত সরকারের পক্ষেই তা অর্জন করা সম্ভব।’
গত ১২ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে বলেন, নির্বাচনের ডেটলাইন দিতে আপনাদের মধ্যে এত দ্বিধা, এত সংকোচ কেন। আপনারা ৫ আগস্টের চেতনাকে ধারণ করতে পারছেন না। আপনারা বিভিন্ন জায়গায় স্বৈরাচারের দোসরদের বসিয়ে রেখেছেন। তারা তো আপনাকে ব্যর্থ করবেই। সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি আরও বলেন, আপনি আবার নতুন কিছু উপদেষ্টা করেছেন। নতুন উপদেষ্টা করার অধিকার আপনার আছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশীজন যারা, তাদের তো একটা অভিমত নেওয়ার দরকার ছিল। যে মেয়েটি বিতর্কিত শেখ মুজিবের বায়োপিক ছবিতে অভিনয় করেছে। আপনারা তার স্বামীকে উপদেষ্টা বানিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারে বিএনপির সমর্থন রয়েছে উল্লেখ করে রিজভী বলেন, জনগণের সমর্থন নিয়ে আপনারা সরকার হয়েছেন। আপনাকে বিএনপি সমর্থন করেছে। যারা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছে, তারা সমর্থন দিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা সমর্থন দিয়েছে। আমরা তো আপনাদেরই সমর্থন করে যাচ্ছি। কিন্তু মাঝে মাঝে কথা বলতে হয় কেন। এক উপদেষ্টার বক্তব্যের জবাবে রিজভী বলেন, তাদের একজন উপদেষ্টা বলছেন, খালি নির্বাচন, নির্বাচন করলে হবে। উপদেষ্টাকে বলি, আপনি কি হেডমাস্টার। আপনি আগে শিক্ষা দেবেন, তারপর আমরা শিখব, পড়াশোনা করব। আমরা কি জানি না, সংস্কার কী। আপনারা প্রস্তাব দিতে পারেন। সেই প্রস্তাবটা দেবেন নির্বাচিত সরকারে কাছে। এজন্য নির্বাচন দিন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি যে নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়া করছে, দলীয় নেতা-কর্মীদের বেপরোয়া আচরণও তার অন্যতম কারণ। কেননা গত ৫ আগস্টের দলটির নেতাকর্মীদের একটি অংশের বেপরোয়া আচরণের খবর গণমাধ্যমে আসছে। বিএনপির হাইকমান্ড এ বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিয়েও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের শামাল দিতে পারছেন না। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা বলেন, বিএনপি বিশাল দল, হাজার নেতাকর্মী; কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো ঘটবেই। কিন্তু অঘটনের সংখ্যা যখন হাজারের ওপরে চলে যায়, তখন আর সেটি বিচ্ছিন্ন থাকে না। সহজাত হয়ে যায়। বিএনপির নেতৃত্ব মনে করছে, নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হলে সব নেতা-কর্মী তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে দলে নিজের অবস্থান শক্ত করতে চাইবেন।