অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় ঝড়ো গতি
১৪ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০০
বাড়ছে আমদানি-রফতানি : দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে উৎপাদন, কৃষি, নির্মাণ ও সেবা খাত
॥ উসমান ফারুক॥
তিন মাস আগে শুরু হওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে ঝড়ো গতি এসেছে সর্বশেষ অক্টোবর মাসে। বেড়েছে রপ্তানি আদেশ। মেশিনারি আমদানিতে নতুন এলসি খোলার হার বেড়েছে। আমদানি বাড়ছে স্থানীয় বাজারের জন্য। এতে কর্মসংস্থান বাজার সম্প্রসারিত হবে সামনের দিনগুলোয়। অর্থনীতি দ্রুত সম্প্রসারিত হওয়ায় পিএমইআই সূচক গত মাসে দাঁড়ায় ৫৫ দশমিক ৭ পয়েন্ট। আগের মাসের তুলনায় গত অক্টোবরে সূচকে প্রবৃদ্ধি হয় ১২ শতাংশের বেশি। এটি গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। দুর্নীতিবাজ সরকারের উৎখাতের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় ও কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল খাদে ফেলে দেওয়া বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে টেনে তোলা। পাচার রোধ, অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধ করে সৎ নেতৃত্ব দেয়ায় ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতি। পুরো ব্যবসায়ী সমাজে একটি বার্তা গেছে যে, সৎভাবে ব্যবসা করলে কোনো সমস্যা হবে না। চাঁদাবাজি বন্ধ হবে। গ্যাস, তেল চুরি করে কেউ ব্যবসা করতে পারবে না। এতে ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে একটি সুস্থ পরিবেশ তৈরি হয় এবং সৎ ব্যবসায়ীরা পুরো মাত্রায় বিনিয়োগ শুরু করেন। এর সুফল পাওয়া গেল তিন মাস শেষে। পিএমআই সূচক অনুযায়ী, দেশের আর্থিক খাতের মধ্যে উৎপাদন, কৃষি, নির্মাণ ও সেবা খাত সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত তিন মাসে অর্থনীতি সংস্কারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে চলছে। তাৎক্ষণিক, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি এসব পরিকল্পনার বাস্তবায়নও শুরু করেছে সরকার। ফলে গত তিন মাস সময়ে ডলার বাজারে স্থিতীশীলতা আসা, রেমিট্যান্সে ইতিহাস সৃষ্টিকারী প্রবৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ কমানো ও আমদানি কার্যক্রমে এলসি জটিলতা কেটে যেতে শুরু করায় অর্থনীতির চারটি খাত ঝড়ো গতিতে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এখন জ্বালানি সরবরাহের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে অর্থনীতির সব খাতেই তার ছোঁয়া লাগবে। সতর্ক থাকতে হবে, পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজন যেন কোনো ‘স্যাবোটাজ’ তৈরি করে কৃত্রিম অচলাবস্থা তৈরি করতে না পারে।
পিএমআই সূচক কী?
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির খাতগুলো কেমন চলছে, তার তাৎক্ষণিক ধারণা পাওয়া যায় এমন কোনো তথ্যভাণ্ডার বা প্রতিবেদন সরকারি ও বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান এখনো তৈরি করে না। সরকারিভাবে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়, তা কমপক্ষে তিন মাস আগের। অর্থাৎ চলতি নভেম্বর মাসে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে, তা তিন মাস আগের জুলাইয়ের তথ্য দিয়ে।
ফলে অর্থনীতির সামগ্রিক তৎপরতা সম্পর্কে ধারণা নেয়া তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান ও আগাম ধারণা পাওয়া যায় না। দুর্যোগ বা ক্রান্তিকালে এ তথ্য ঘাটতি সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ফেলেছিল বাংলাদেশকে ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময়ে।
অর্থনীতির প্রধান খাতগুলোর মধ্যে চারটি খাতের মাসভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনা করে বর্তমান ও আগামী কয়েক মাস কেমন যেতে পারে, তার একটি আগাম ধারণা দিতে পার্চেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স (পিএমআই) চালু করা হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ (পিইবি) গত মে মাস থেকে পিএমআই সূচক প্রকাশ করছে। এতে আর্থিক সহযোগিতা করছে ইউকে ডেভেলপমেন্ট ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠান।
সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক খাতে মধ্যে কৃষি, উৎপাদন, নির্মাণ ও সেবা খাতে নিয়োজিত সারা দেশের পাঁচশত কোম্পানির কাছ থেকে সরাসরি প্রতি মাসে তথ্য সংগ্রহ পিএমআই সূচক তৈরি করা হয়।
পিএমআই সূচক যেকোনো দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক অবস্থা বুঝতে সহায়তা করে। ১৯৪৯ সাল থেকে চালু হওয়া পিএমআই সূচক বেশিরভাগ দেশই চালু করেছে।
পিএমআই সূচকে মোট ১০০ পয়েন্টের বিপরীতে মান ৫০-এর নিচে হলে অর্থনীতি সংকুচিত হচ্ছে, আর সূচকের মান ৫০ হলে ধরা হবে অর্থনীতি স্থবির (এক জায়গায় স্থির থাকা) হয়ে আছে। অন্যদিকে ৫০-এর বেশি হলে অর্থনীতি সম্প্রসারিত বা অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য বেড়েছে বলে ধরা হবে। সেখানে গত অক্টোবর মাসে ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ মানে অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে।
সচল হচ্ছে কৃষি খাত
পিএমআই সূচকে কৃষি খাতের মধ্যে শস্য উৎপাদন, মৎস্য ও প্রাণিজ উৎপাদনকারী মিলিয়ে ৪৬টি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব খাতের সবগুলো কোম্পানি জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বর মাসের চেয়ে অক্টোবর শেষে ৬ পয়েন্ট বেড়েছে। অক্টোবরে পিএমআই দাঁড়িয়েছে ৫৩ পয়েন্ট, আগের মাস সেপ্টেম্বরে যা ছিল ৪৭ পয়েন্ট।
কৃষি খাতের উৎপাদন যে বেড়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিক সময়ের সবজি বাজারের দর নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন ভূমিকার কারণে। ঊর্ধ্বমুখী হওয়া মরিচ, পেঁপে, চিচিঙ্গা, করলা, ঝিঙা, পটোল ও ফুলকপির দাম গত মাসেই নিয়ন্ত্রণে আসে। বাজারে আলুর সরবরাহ যথেষ্ট থাকলেও বাজার সিন্ডিকেটের কারণে এখনো তা পেঁয়াজের বাজারও চড়া। বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
আশা করা যায়, শীতকালীন সবজির সরবরাহ আরেকটু বাড়লে এ সবজির দামটিও নিয়ন্ত্রণে আসবে। অন্যদিকে টেকসই কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত হচ্ছে শিল্প, অর্থাৎ উৎপাদন খাত। কোনো দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হচ্ছে দেশটির উৎপাদন খাতের অবস্থা। এ খাতটি ভালো চলা মানেই হচ্ছে, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। শক্ত ভিত রচনা করছে।
পিএমআই সূচক তৈরিতে এজন্য এ খাত থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যা কত ২১২টি কোম্পানির তথ্য নেয়া হয়। এর মধ্যে উৎপাদন খাতের বৃহৎ কোম্পানি ৪৪টি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ৩০টি ও কুটির শিল্পের ১৮টি মিলিয়ে ৯২টি কোম্পানি, নির্মাণ খাতের ৫০টি এবং সেবা খাতের খুচরা পণ্য বিক্রেতা, আবাসন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা, খাদ্যসহ বিভিন্ন কোম্পানি মিলিয়ে ২১২টির তথ্য নিয়েছে।
গত অক্টোবর মাসে উৎপাদন খাতে পিএমআই সূচক ৫৬ দশমিক ৬ পয়েন্ট হয়ে আছে, আগের মাসে যা ছিল ৫২ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, উৎপাদন খাতের পিএমআই সূচক বৃদ্ধি পাওয়া মানেই হচ্ছে রপ্তানি আদেশ বাড়তে শুরু করেছে। আগের মাসের চেয়ে গত অক্টোবরে এলসি করার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন নতুন মেশিনারি আমদানি বেড়েছে। পুরনো মেশিন সংস্কারে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি বেড়েছে। এর মানে হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা শিল্প-কারখানার উৎপাদন বাড়ানো ও নতুন কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগ বাড়িয়ে চলছেন। আর নির্মাণ খাতে পিএমআই ৪৭ পয়েন্ট থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৫৩ পয়েন্ট।
অন্যদিকে গত অক্টোবর মাসে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে সেবা খাতে। আগের মাসে থাকা পিএমআই পয়েন্ট ৪৯ দশমিক ৪ পয়েন্ট থেকে সাড়ে সাত পয়েন্ট বেড়ে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৫৬ দশমিক ৯ পয়েন্ট। এক মাসের ব্যবধানে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয় ১৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। ঝড়ো গতিতে এটি হওয়ায় নিম্ন ও শ্রমজীবী মানুষের আয় করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ কর্মক্ষম মানুষ কাজের সুযোগ পাচ্ছে। সেবা খাত সম্প্রসারিত হওয়া মানেই হচ্ছে, মানুষের চলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থনৈতিক কারণে। যাতায়াত বৃদ্ধি পাওয়া মানেই গণপরিবহন, রিকশার ব্যবহার বাড়ানো, পাইকারি ব্যবসায়ীদের বিক্রি বৃদ্ধি ও খাদ্য পণ্যের বিক্রি বেড়ে যাওয়া। দৈনন্দিন আবশ্যকীয় জীবন ধারণের এসব খাত সচল হওয়া মানেই অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরতে শুরু করেছে।
রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দেশের জনগণের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো বসে থাকা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় গত ৫ আগস্ট। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের ছাত্র-জনতা ১৬ বছরের দুঃশাসনকে উৎখাত করলে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। তার দেশ ছাড়ার আগ থেকেই পরিণতির ভয়াবহতা আশঙ্কা করে দেশ থেকে গোপনে পালিয়ে গিয়েছিল সরকারের অনেক ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও দলের নেতারা।
শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর দেশ ছাড়া নেতাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। পাসপোর্ট ছাড়া অর্থাৎ অবৈধ পথে সবাই গিয়ে আশ্রয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের বুদ্ধি ও মদদদাতা দেশ ভারতে। কলকাতাসহ দিল্লির মতো শহরগুলো এখন আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিণত হয়েছে। যেখানে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা অবৈধভাবে থাকতে পারছে।
সেই ফ্যাসিস্ট সরকারের কারণে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে খাদে ফেলে দিয়েছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। সেই খাদ থেকে অর্থনীতিকে টেনে তুলে আনার অদম্য চেষ্টা করে যাচ্ছে জনগণের কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
অর্থনীতিবিদ, বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আওয়ামী প্রতিনিধিরা ঘাপটি মেরে আছে। সবচেয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া অর্থনীতিকে ভালো অর্থনীতি বলে মিথ্যা ও বানোয়াট প্রতিবেদন এ আমলারাই করেছে। তারা এখনো নিজ নিজ পদে বহাল রয়েছে। মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরির দায় সরকারি কর্মচারীরা এড়াতে পারে না। মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়েই আওয়ামী সরকার দানব সরকারে পরিণত হয়েছিল। ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবে আসা সরকারকে এখন দুর্নীতিবাজ এসব কর্মচারীকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সঠিক ও নির্ভুল তথ্য সরবরাহে বাধ্য করতে আইনি সংস্কারেও হাত দিতে হবে। সর্বোপরি সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্য যেন ম্লান করে দিতে না পারে, সেজন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার তৃণমূল পর্যায় থেকে ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগীদের সরানো সময়ের দাবি। সারের ডিলার থেকে শুরু করে শ্রমঘন শিল্পের প্রতিটি ধাপের নিয়ন্ত্রণকারীদের মধ্য থেকে ফ্যাসিস্ট সরকারের কর্মী, সমর্থক ও সুবিধাভোগীদের সরিয়ে দেশপ্রেমিকদের আনতে হবে।