পাক-ভারত যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয়


১৫ মে ২০২৫ ১৫:৩৩

॥ এফ শাহজাহান ॥
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সংঘাত এবং উত্তেজনা নতুন কিছু নয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভাজনের মাধ্যমে দুটি রাষ্ট্রের জন্মলাভের পর থেকেই এ অঞ্চলটি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়ে গেছে। কাশ্মীর ইস্যু, সীমান্ত সংঘর্ষ, সন্ত্রাসবাদ এবং পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা- এ উপাদানগুলো দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর সম্পর্ককে করেছে জটিল ও হুমকিস্বরূপ। এর আগে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে উভয় দেশের ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস (ডিজিএমও) পর্যায়ের একটি চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা হয়েছিল, যা অনেকটাই অপ্রত্যাশিতভাবে শান্তির এক ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠছিল। সঙ্গতকারণেই ২০২৫ সালে কাশ্মীরের পেহেলগাম হামলাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের আবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এবং মার্কিন চাপে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়া নিয়েও রয়েছে নানা সন্দেহ-সংশয়। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক, নিরাপত্তাগত ও কৌশলগত নানা জটিলতা। পাকিস্তান-ভারতের অতীত যুদ্ধবিরতির পটভূমি, সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির বৈশিষ্ট্য, বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ করা হয়েছে এ নিবন্ধে।
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ পর্যটক নিহতের জেরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গত ৭ মে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে সামরিক হামলা চালায় ভারত। এর পাল্টা জবাব দিতে গত ৯ মে ভারতের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন বুনিয়ানুম মারসুস’ নামে সামরিক হামলা চালায় পাকিস্তান। ভারত-পাকিস্তানের এ পাল্টাপাল্টি সামরিক হামলার মধ্য দিয়ে ২০২৫ সালের মে মাসে শুরু হয়েছিল পাক-ভারত যুদ্ধ।
পাক-ভারত পাল্টাপাল্টি হামলা যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানের ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিতে’ সম্মত হওয়ার খবর দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা বাদে তা লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে উভয়পক্ষ। তাতে এ সমঝোতা কতদিন স্থায়ী হবে, তা নিয়েই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার মাত্র দুই ঘণ্টা পরই ভারতশাসিত কাশ্মীরে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের কারণ জানা না গেলেও বিভিন্ন শহরে ব্ল্যাকআউটের ঘটনা ঘটে। এরপর পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেন। তবে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে ভারত। আর সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকিস্তান। যুদ্ধবিরতি হলেও সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে না ভারত। আবার কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের সমস্যা দীর্ঘদিনের। সহসা এর সমাধান হওয়ার আশাও কেউ দেখছেন না।
পাক-ভারত যুদ্ধবিরতির অতীত-বর্তমান
এবারে সংঘাতের মূল কেন্দ্র কাশ্মীর। কাশ্মীর দ্বন্দ্ব ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী ও গুরুত্বপূর্ণ সংঘাতের বিষয়। অতীতেও এ নিয়ে একাধিকবার সংঘাতে জড়িয়েছে দুই দেশ। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ইতিহাস একাধিকবার ব্যর্থতার সাক্ষী হয়ে আছে।
২০০৩ সালে এক ঐতিহাসিক যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হলেও ২০০৩-২০২০ সময়কালে প্রায় ১৪ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন হয়েছিল (Ministry of Defence, India, 2021)। এর মধ্যে ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর সীমান্ত উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবার একটি নতুন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়, যার মাধ্যমে ২০২১-২০২৪ সময়ে সংঘর্ষ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। কিন্তু ২০২৫ সালের পেহেলগাম হামলা সেই স্থিতাবস্থাকে আবার ভেঙে দেয়। “Ceasefires are only as strong as the political will behind them. In the India-Pakistan context, that will is repeatedly undermined by non-state actors and mutual mistrust’ (Ganguly & Kapur, 2022).
১৯৪৭-৪৮, ১৯৬৫ এবং ১৯৯৯ সালে (কারগিল যুদ্ধ) কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ হয়। এর বাইরেও প্রায় প্রতিদিনই নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গুলিবিনিময়, মর্টার হামলা এবং স্নাইপার ফায়ার সংঘটিত হয়ে এসেছে। ২০০৩ সালে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও পরবর্তী বছরগুলোয় তা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে।
২০১৬ সালের সার্জিকাল স্ট্রাইক ও ২০১৯-এর বালাকোট এয়ারস্ট্রাইক এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ২০১৬ সালের উরি হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারত ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ চালায় এবং ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার জবাবে পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা করে। ২০২৫ সালে কাশ্মীরের পেহেলগাম হামলাকে কেন্দ্র করে দুই দেশ আবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং মার্কিন চাপে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। এ ঘটনাগুলো যুদ্ধের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয় এবং দুই দেশের মধ্যে ‘নিয়ন্ত্রিত উত্তেজনা’ (controlled instability) একটি নতুন বাস্তবতায় রূপ নেয়।
যুদ্ধবিরতির পরও ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে আতঙ্ক
যুদ্ধবিরতির পরও বাড়ি ফিরতে ভয় পাচ্ছেন আজাদ কাশ্মীরের বাসিন্দারা। একই অবস্থা ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের সীমান্ত জনপদেও। যুদ্ধবিরতি হলেও যুদ্ধের ধোঁয়া নাকি এখনো কাটেনি! ভয়-আতঙ্ক-হতাশায় এখন রয়েছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। কেউ আবার পরিবার-পরিজন নিয়ে আছেন উঁচু পাহড়ের ঢালে। সারা দিন জটলা পাকিয়ে একই দরবার সবার- বাড়ি যাব কি না? এ দোটানাতেই সময় কাটছে বাস্তুচ্যুত শিবিরগুলোয় আশ্রয় নেওয়া জম্মু-কাশ্মীরের শত শত মানুষের। আজাদ কাশ্মীরে ১,১৪৬ পরিবার। গত ১২ মে সোমবার সেই দৃশ্যই উঠে এসেছে ডন ও আল-জাজিরার প্রতিবেদনে।
পাক-ভারত ডিজিএমও বৈঠক
গত ১২ মে সোমবার বিকেলে যুদ্ধবিরতি নিয়ে প্রথম ভারত ও পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশন্স (ডিজিএমও) এর মধ্যে হটলাইনে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভাষ্য অনুযায়ী, উভয় পক্ষের মধ্যে এ আলোচনা এমন একটি প্রতিশ্রুতি ঘিরে হয়েছে যে, কেউ কারও ওপর গুলি চালাবে না এবং কোনো আগ্রাসী পদক্ষেপ নেবে না। দুই পক্ষই সীমান্ত থেকে সেনা কমানোর বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে। আপাতত জম্মু-কাশ্মীর এবং ভারত-পাকিস্তানের অন্যান্য সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) এবং পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষী বাহিনী রেঞ্জার্স। এছাড়া সীমান্তে সেনাবাহিনীও থাকবে, তবে সংঘাত পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে তারা সামনে আসবে না।
জাতির উদ্দেশে পাক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য
ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পর গত ১১ মে শনিবার গভীর রাতে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ জাতির উদ্দেশে এক ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণে তিনি যুদ্ধবিরতিকে ‘পাকিস্তানের ঐতিহাসিক বিজয়’ বলে দাবি করেছেন।
নরেন্দ্র মোদির ভাষণে ভিন্ন সূর
গত ১২ মে সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, যুদ্ধবিরতি হয়েছে ঠিকই, তবে অপারেশন সিঁদুর শেষ হয়নি। এটি কেবল স্থগিত রাখা হয়েছে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ‘অপারেশন সিঁদুর নতুন স্বাভাবিক (নিউ নরমাল) ঘটনা। যেখানেই সন্ত্রাসী ঘাঁটি রয়েছে সেখানেই ভারত আক্রমণ করবে এবং আমাদের দেশে আক্রমণ করা হলে তার জবাব জোরালোভাবে দেবে।’ নিউ নরমাল ব্যাখ্যা করে নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দেন, আগামী দিনে ভারতে কোনোরকম সন্ত্রাস হলে পাকিস্তানকে ছেড়ে কথা বলা হবে না।
মোদি বলেন, কোনো পরমাণু ব্ল্যাকমেইল ভারত সহ্য করবে না। পরমাণু ব্ল্যাকমেইলের আড়ালে বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসের ঠিকানায় ভারত নির্ভুল আঘাত হানবে। পাকিস্তানে সন্ত্রাসের মদদদাতা সরকার ও জঙ্গিদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হবে না। জাতির উদ্দেশে পাক প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্বের জন্য ভারতই সবচেয়ে বড় হুমকি। পাকিস্তানের অকল্পনীয় শক্তিমত্তার সামরিক হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়া ভারত তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য হলেও সময় ও সুযোগ পেলে তারা পাকিস্তানকে ছাড়বে না।
যুদ্ধবিরতিতে মার্কিন প্রভাব
গত ১১ মে রোববার ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ‘আমার পরবর্তী কাজ হলো ভারত ও পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে কাশ্মীর বিষয়ে একটি ‘সমাধান’ বের করার চেষ্টা করা।’ ট্রাম্পের এ মন্তব্য অনেক ভারতীয়কে ক্ষুব্ধ করেছে। তারা মনে করে, ওয়াশিংটন এ অঞ্চলে হস্তক্ষেপ ক্রমে বাড়াচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন।
১২ মে সোমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণের ঠিক আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাক-ভারত যুদ্ধবিরতি নিয়ে কথা বলেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলেন, তিনি দুই দেশকেই চাপ দিয়েছিলেন যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য। অন্যথায় ব্যবসার ওপর প্রভাব পড়বে বলেও দুই দেশকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন তিনি। দু’পক্ষকেই তিনি চাপ দিয়ে বলেছিলেন সংঘর্ষ বন্ধ করতে হবে, নয়তো তাদের সঙ্গে কোনো ব্যবসা করা হবে না।
যুদ্ধবিরতি নিয়ে বিজেপির ক্ষোভ
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর দুই দেশের বেশিরভাগ মানুষ; বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করেন। কিন্তু উগ্রবাদী হিন্দুরা যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় খুশি হতে পারেননি। এ ঘোষণায় তাঁরা হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হিন্দুত্ববাদী কর্মী, সরকারপন্থী সংবাদমাধ্যম ব্যক্তিত্ব; এমনকি বিজেপি নেতারাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, শক্তিমত্তার দিকে এগিয়ে থেকেও যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে ভারত আত্মসমর্পণ করেছে।
যেসব কারণে যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয়
যদিও তাৎক্ষণিক সংঘাত প্রশমিত হয়েছে, তবে এ যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে বহু সংশয় রয়েছে। ইতিহাস, ভূরাজনীতি, নিরাপত্তা বাস্তবতা এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় অবিশ্বাস; সব মিলিয়ে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। যে কারণে পাক-ভারত যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো-
সন্ত্রাসবাদের দায়-দায়িত্ব নিয়ে পারস্পরিক অবিশ্বাস
ভারত হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনকে দায়ী করেছে, আর পাকিস্তান সরাসরি এ দায় অস্বীকার করেছে। অতীতে যেমন পুলওয়ামা (২০১৯), উরি (২০১৬) বা পাঠানকোট (২০১৬) হামলার পরও এমন প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এর ফলে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও উভয়পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাস অটুট থেকেছে। ভারত সন্দেহ করে, পাকিস্তান জঙ্গিদের আশ্রয় দিচ্ছে। পাকিস্তান এটিকে ভারতের ‘ভিত্তিহীন দোষারোপ’ হিসেবে তুলে ধরে। এ পারস্পরিক অবিশ্বাস যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্বে বড় বাঁধা।
পেহেলগাম হামলা: দায়ভার ও দ্বন্দ্বের সূত্রপাত
পেহেলগামের ঘটনায় ভারত সরকার “লস্কর-ই-তইয়্যেবা” নামক পাকিস্তানভিত্তিক একটি সন্ত্রাসী সংগঠনকে দায়ী করে। পাকিস্তান সরকার একে ভিত্তিহীন অভিযোগ বলে প্রত্যাখ্যান করে। ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, “ This was a cross-border sponsored terror attack designed to derail peace and destabilize Kashmir’ (The Hindu, April 2025)। অন্যদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো দাবি করেন, “India is attempting to externalize its internal failures and shifting blame to Pakistan without any credible evidence’ (Dawn, April 2025)। এই পারস্পরিক দোষারোপ যুদ্ধবিরতির ভিতকে দুর্বল করে তোলে।
সীমান্তে সামরিক প্রস্তুতি ও সংঘর্ষের আশঙ্কা
পেহেলগাম হামলার পর ভারত LOC (Line of Control) বরাবর ৭০,০০০ সৈন্য মোতায়েন করে, যা ২০১৯ সালের বালাকোট উত্তরের পর সবচেয়ে বড় সামরিক সমাবেশ (Indian Express, 2025)। পাকিস্তানও পাল্টা সেনা সমাবেশ করে। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ছোট-খাটো গোলাগুলির ঘটনা যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
এক জরিপ অনুযায়ী, ৭৩% ভারতীয় নাগরিক মনে করেন, পাকিস্তানকে কড়া জবাব দেওয়া উচিত, যা রাজনৈতিক চাপ বাড়ায় (Pew Research Center, 2025)।
কাশ্মীর পরিস্থিতি ও মানবাধিকার ইস্যু
ভারতের সেনা মোতায়েন এবং কাশ্মীরের ওপর কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন তুলেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, “Following the Pahalgam attack, India intensified its cordon-and-search operations leading to civilian detentions and internet blackouts’ (HRW Report, May 2025)। এতে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ে এবং চরমপন্থীরা নতুন করে সদস্য সংগ্রহে সুবিধা পায়, যা আবার নিরাপত্তা হুমকি বাড়ায়।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ
২০২৫ সালে পাকিস্তানে একটি দুর্বল জোট সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, যার ওপর সেনাবাহিনীর প্রভাব অত্যন্ত বেশি। অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও আইএমএফ শর্ত বাস্তবায়নের চাপ সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বাড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মধ্যস্থতার সীমাবদ্ধতা
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ পেহেলগাম হামলার নিন্দা করে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। তবে গাজার যুদ্ধ ও ইউক্রেন সংকটের মতো ঘটনা আন্তর্জাতিক মনোযোগ বিভাজিত করে রাখে।
পাক-ভারত যুদ্ধবিরতি নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, “Peace between India and Pakistan is essential for regional stability, but this must be rooted in accountability and mutual trust’ (UN News, 2025)। তবে এনিয়ে কোনো শক্তিশালী মধ্যস্থতা হয়নি। চীন ‘দুই পক্ষের সংযম’ আহ্বান জানালেও ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য না করায় নয়াদিল্লির সন্দেহ থেকেই যায়।
নির্বাচনমুখী জাতীয়তাবাদ এবং জনমতের চাপ
২০২৫ সালের শেষে ভারতের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে শাসকদল ‘কঠোর জাতীয়তাবাদী’ মনোভাব প্রচারে আগ্রহী। নিরাপত্তা প্রশ্নে কোনো দুর্বলতা দেখালে ভোটব্যাঙ্কে প্রভাব পড়তে পারে।
এই বাস্তবতা যুদ্ধবিরতির স্থায়ী রূপ নিতে বাধা সৃষ্টি করে।
জঙ্গি হামলার সম্ভাবনা: যুদ্ধবিরতির চ্যালেঞ্জ
গবেষণায় দেখা গেছে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির সময়কালে প্রায়ই জঙ্গি হামলার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেওয়া হয়। যেমন ২০০১, ২০১৬, ২০১৯ সালের উদাহরণ রয়েছে (Stanford CISAC, 2024)। ২০০৩-২০২০ সময়ে ৪৭% সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘনের সূত্রপাত হয়েছিল জঙ্গি হামলার পর (Sahni, 2022)। এবারও যদি পেহেলগামের মতো আরেকটি হামলা হয়, তাহলে ভারত প্রতিক্রিয়ায় আবার সীমান্তে অভিযান চালাতে পারে, যা যুদ্ধবিরতি ভাঙবে।
যদিও ভারত ও পাকিস্তান আপাতত সংঘাত থেকে সরে এসেছে, তবে যুদ্ধবিরতি বজায় থাকবে কি না, তা এখন দেখার বিষয়। দুই দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে ভিসা স্থগিত ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো ব্যবস্থা নেয়। ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ পানিবণ্টন চুক্তি থেকে সরে আসার কথা জানায়। এ পদক্ষেপগুলো প্রত্যাহার করা হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এ অবস্থায় পাক-ভারত যুদ্ধবিরতি কতদিন স্থায়ী কবে সেটাই এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল আগ্রহের বিষয়।