ভারতজুড়ে মুসলিম নিধন ও নির্যাতন
৮ মে ২০২৫ ১৩:৫৪
॥ গাজী মুহাম্মদ শওকত আলী॥
ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে গত ২২ এপ্রিল বন্দুকধারীদের হামলার পর সর্বত্র মুসলিম হত্যা, নির্যাতন-নিপীড়ন, অগ্নিসংযোগ, ঘরবাড়ি ও দোকানপাট ভাঙচুর করা হচ্ছে। ২২ এপ্রিল থেকে ২ মে ভারতজুড়ে ৬৪টি ঘৃণামূলক বক্তব্য নথিভুক্ত করেছে ইন্ডিয়া হেট ল্যাব (আইএইচএল) এর প্রতিবেদনে এ তথ্য দিয়েছে। সর্বোচ্চসংখ্যক ঘৃণামূলক বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে মহারাষ্ট্রে। এসকল বক্তব্য বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ডব্লিউএইচপি), আন্তঃরাষ্ট্রীয় হিন্দু পরিষদ (এএইচপি), রাষ্ট্রীয় বজরং দল (আরভিডি), হিন্দু জনজাগৃত সমিতি, সকল হিন্দু সমাজ, হিন্দু রাষ্ট্র সেনা এবং হিন্দু রাষ্ট্র দলসহ হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলোর মধ্য থেকে মুসলিমদের লক্ষ করে ঘৃণা ও ভয় দেখানোর জন্য ভারতব্যাপী সমন্বিত প্রচারণা চালনো হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, এসকল গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সহিংসতা ছড়াচ্ছে আর মুসলমানদের সামাজিক বর্জন ও অর্থনৈতিক বয়কটের আহ্বান জানাচ্ছে আর একাজে কাশ্মীর ট্র্যাজেডিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। হিন্দু নেতাদের বক্তব্যে সহিংসতা উসকে দিচ্ছে ও বিভিন্ন এলাকার মুসলমানদের বহিষ্কারের হুমকি দিচ্ছে।
ইন্ডিয়া হেট ল্যাব (আইএইচএল) এর প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়েছে, উত্তর প্রদেশে একজন মুসলমানকে কুড়াল দিয়ে নৃশংস হামলা করার পর হামলাকারীরা চিৎকার করে বলতে থাকে ছাব্বিশজন নিহত হয়েছে, তোদেরও ছাব্বিশজনকে হত্যা করা হবে। মিজোরাম বিমানবন্দর থেকে বাংলাভাষী (মুসলমান) দুই আমেরিকান নাগরিককে আটক করা হয়েছে। ত্রিপুরায় গরু নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তিন মুসলিম যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
২২ এপ্রিল ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে বন্দুকদারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হয়। এই ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করছে। একতরফাভাবে পাকিস্তানের সাথে পানি চুক্তি প্রত্যাহার, পাকিস্তানের সকল নিউজ চ্যানেল ভারতে নিষিদ্ধ করেছে। ঘটনা যে বা যারাই ঘটিয়ে থাকুক না কেন, বলির পাঁঠা হচ্ছে ভারতের মুসলমানগণ। হামলার পর গত ৪ মে রোববার রাতে নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে। কাশ্মীরের ২ হাজারেরও বেশি মুসলমানকে আটক করেছে। হামলায় জড়িত সন্দেহে বুলডোজার দিয়ে অনেকের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এখনো ব্যাপক ধরপাকড় চলছে আর ভাঙা হচ্ছে মুসলমানদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। ক্ষতিগ্রস্তরা বলছে, ‘আমার ভাই জড়িত থাকলেও পরিবারের অপরাধ কী?’
কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা মেইনল্যান্ড ইন্ডিয়া থেকে সকলক কাশ্মীরি মুসলমানদের বিতারিত করার হুমকি দিয়েছে। পেহেলগাঁওয়ের ঘটনায় ভারতজুড়ে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন নেমে এসেছে। আগ্রাতে কট্টর হিন্দুত্ববাদী গোরক্ষক দল ১ মে বৃহস্পতিবার দুজন মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। কট্টর হিন্দুরা প্রকাশ্যে আরো ঘোষণা করছে পেহেলগাঁওয়ের ২৬ জন হত্যার প্রতিশোধ নিতে ২,৬০০ মুসলমানকে হত্যা করা হবে।
মুসলিম নির্যাতনের কিছু চিত্র : ২৫ এপ্রিল শুক্রবার থেকে শুরু হয় গণগ্রেফতার। ২৬ এপ্রিল শনিবার রাত ৩টা থেকে বাংলাদেশি সন্দেহে শতাধিক মুসলমান নারী পুরুষ ও শিশুকে গ্রেফতার করে গুজরাটের রাজ্য পুলিশ। ২৬ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া গ্রেফতার অভিযানে ২৯ এপ্রিল মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত ৬ হাজারেরও বেশি মুসলমান নর-নারী ও শিশুকে আটক করা হয়। সংবাদ সংস্থা পিটিআই বিকাশ সাহায়কে উদ্ধৃত করে এ সংবাদ জানিয়েছে। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে ২৯ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত, তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি; এমনকি তাদের কোর্টেও তোলা হয়নি। বাংলাদেশি বলে গ্রেফতার করলেও তারা কেউ বাংলা ভাষাও জানে না। তারা মূলত ভারতীয় মুসলমান।
২৬ এপ্রিল শনিবার রাত ৩টার পর গুজরাটের পুলিশ রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত আহমেদাবাদ ও সুরাটে অভিযান চালায়। গুজরাটের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হর্ষ সাংঘতি জানিয়েছে চিরুনি অভিযানে নারী শিশুসহ এক হাজারেরও বেশি বাংলাদেশিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২৫ এপ্রিল জুমার দিন থেকেই গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়, পরের দিন শনিবার ২৬ এপ্রিল রাত ৩টায় ডিসিপি অজিত রাজিয়ানের তত্ত্বাবধানে চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে ১ হাজারেরও বেশি (কথিত) বাংলাদেশি (ভারতের মুসলমানকে) গ্রেফতারের মাধ্যমে ঐদিনের অভিযানের সমাপ্তি হয় বলে পিটিআই সংবাদ দিয়েছে।
সুরাট থেকে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক হওয়া সুলতান মল্লিকের স্ত্রী সাহিনা বিবি বিবিসিকে জানান, রাত ৩টা নাগাত পুলিশ আমাদের বাসায় আসে। আমার স্বামী ও বাচ্চাদের আধার কার্ড দেখতে চায় আমরা প্রয়োজনীয় সকল কাগজ দেখাই। তারপর তারা আমার স্বামী ও দুই ভাগনেকে নিয়ে যায় এই বলে যে, তাদের কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেয়া হবে। আজ তিন দিন হতে চলেছে, তারা আজও বাসায় ফেরেনি। সুলতান মল্লিক তার পাসপোর্ট ও ১৯৯৩ সালে ক্রয় করা জমির দলিল দেখালেও কোনো কাজ হয়নি। সুলতান মল্লিক ও তার পরিবারের কেউ বাংলাভাষা জানে না, অথচ বাংলাদেশি বলে ধরে নিয়ে গেছে। শুধু মুসলমান হওয়ার করণে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ‘পরিযায়ী ঐক্য মঞ্চ’ ভ্রাম্যমাণ শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা একটি এনজিও এর রাজ্য সম্পাদক আসিফ ফারুক জানান, মুসলমানদের ওপর বাংলাদেশি তকমা দিয়ে এমন ঘটনা ঘটতে পারে আঁচ করতে পেরে গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠিও দিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।
ভারতের পুলিশ ২৮ এপ্রিল সোমবার বিভিন্ন রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তথা মুসলমানদের ওপর হামলা চালায়। বাংলাদেশিদের খোঁজে বরযাত্রীদের ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। ২৫ এপ্রিল শুক্রবার অভিযান শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে আহমেদাবাদ পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়। কনে ফারজানা বিবিসি গুজরাটের সংবাদদাতা তেজস ভৈদের সঙ্গে দেখা করে তার হাতের মেহেদি ও বিয়ের কার্ড দেখিয়ে বলে, বরযাত্রী বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিল। আমাদের ঘর খুবই ছোট তাই তাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছিলাম চান্দোনায় এক আত্মীয়ের বাসায়, সেখান থেকে তাদের ধরে নিয়ে গেছে। জেবুন্নোসা, তার ছেলে ও ভগ্নিপতি এসেছিল মহারাষ্ট্রের আকোলা থেকে। তারাও বিয়েতে যোগ দিতে এসেছিল। তাদের কাছে বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র, জন্মনিবন্ধন ও আধার কার্ড সবই আছে। তারপরও তাদের বাংলাদেশি বলে ধরে নিয়ে গেছে। আসলে তারা কেউ বাংলাভাষা জানে না, তারা মূলত মুসলমান বলেই ধরে নিয়ে গেছে।
ভারতের অনলাইনে ছড়ানো হচ্ছে মুসলিমবিদ্বেষী গান ও কনটেন্ট আর এগুলো সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে ভীতি ছড়ানোর জন্য। আহমেদাবাদের বাসিন্দা আলমআরা ২৩ বছর ধরে থাকেন সৈয়দবাড়ি মোহাম্মদী মসজিদ এলাকায়। তার ছেলে রিয়াজের শ্বশুরবাড়ি চান্দোলা ঝিল এলাকায়। রাতে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে ও তার স্ত্রীকে পুলিশ নিয়ে যায়। তাদের কাছেও আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ভোটার পরিচয়পত্র, আয়কর বিভাগের প্যান কার্ড, বিদ্যুতের বিলসহ সকল নথিপত্রই আছে। তারপরও মুসলিম হওয়ার কারণে তাদের ধরে নিয়ে যায় বলে জানিয়েছেন বিবিসি গুজরাটের সংবাদদাতা তেজস ভৈদের।
মহারাষ্ট্র নাগপুরে ভারতের এক সময়ের মুসলিম শাসক সম্রাট আওরঙ্গজেবের কবর গুঁড়িয়ে দিয়েছে। মহারাষ্ট্রে মার্চ মাসে তারাবির নামাজের সময়ে উগ্রবাদী হিন্দু বিজেপি কর্মীরা প্রশাসনের সহায়তায় মসজিদের গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর হামলা করে। মার্চ ২০২৫ এর (১২-১৭) মাঝামাঝি সময়ে হিন্দুদের হুলি খেলা বা দোলযাত্রার দিনে বিশেষ করে ১৪ মার্চ জুমার দিনে নামাজ চলাকালীন মসজিদে হামলা করে মুসল্লিদের মারধর করে ও মসজিদগুলো ভাঙচুর করে। ঐদিন মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডে এবং পশ্চিমবঙ্গের বীরভুমে হোলির মিছিল থেকে অনেক মসজিদে আক্রমণ করা হয়। তাতে মসজিদের ইমামসহ অনেক মুসল্লি আহত হয়। এসকল এলাকা থেকে পুলিশ ২২ জন মুসলমানকে আটক করে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভুমের সাঁইথিয়া অঞ্চলেও জুমার নামাজে উগ্রবাদী বিজেপির কর্মীরা মসজিদে আক্রমণ করে এসময়ে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। মসজিদের ইমামসহ অনেক মুসল্লি আহত হয়। পুলিশ এখান থেকেও ২১ জন মুসলমানকে আটক করে। বিবিসি এমন সংবাদ প্রচার করেছে।
উত্তরপ্রদেশে মুসলিম নির্যাতন : ভারতের উত্তরপ্রদেশে মারধর করে ‘জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করছে। মার্চ মাসে দিল্লির কাছে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে বার-তের বছরের একটি ছেলে মন্দিরে ঢুকে পানি পান করেছিল। ছেলেটির নাম আসিফ, পিতার নাম হাবিব, এটা শোনার পর দু’তিন জন হিন্দু যুবক তাকে মাটিতে ফেলে নৃশংসভাবে মারধর করে তার হাত-পা ভেঙে দেয় ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। বিবিসি বলছে, হিন্দু যুবকরা প্রথমে আসিফকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাটিতে ফেলে তার হাত পা মুচড়ে দিয়ে লাথি মারতে থাকে।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে গাজিয়াবাদের কাছে লোনিতে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ আবদুস সামাদকে একটি নির্জন জায়গায় টেনে নিয়ে যায়, তাকে প্রচণ্ড মারধর করে জোর করে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করে ও তার দাড়ি কেটে দেয়। এ ঘটনার ভিডিও ধারণ করে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয় যাতে মুসলমানরা আতঙ্কিত হয়।
শিক্ষা-সংস্কৃতি বদলে দিচ্ছে নারীদের হেনস্তা করছে : উত্তরপ্রদেশের অনেক প্রাচীন মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ভারতের মাদরাসাগুলোয় হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। মুসলমানদের মন্দিরে চাঁদা দিতে বাধ্য করছে। ইতোপূর্বে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মুজাফফরনগর ও শামলি থেকে শত শত মুসলিম পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ‘মকতুর’ নামের একটি এনজিও সেখানে কাজ করছে। এখনো ঐ এলাকায় মুসলমান যুবকদের মারধর করছে, জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করছে আর মুসলিম মেয়েদের হেনস্তা করছে ও তাদের বোরকা খুলে নিচ্ছে। মুসলিম মেয়েরা আতঙ্কিত, তাদের কোন ভবিষ্যৎ নেই, যে কোনো সময় তাদের হত্যা করতে পারে, ধর্ষণ করে ভিডিও ধারণ করে তা ছড়িয়ে দিতে পারে বা তাদের জীবন্ত জ¦ালিয়ে দিতে পারে বলে নারীরা আশঙ্কা করছে।
মুসলমানদের হত্যা করছে ও গণহত্যার হুমকি দিচ্ছে : মুসলিম প্রধান লাক্ষাদ্বীপেও চলছে মুসলিম নির্যাতন। ত্রিপুরায় গরু নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তিন মুসলিম যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হরিয়ানায় স্বয়ং বিজেপি ও আরএসএস কট্টরপন্থী হিন্দু নেতারা মুসলমানদের হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। ঐসব এলাকায় গ্রামে গ্রামে হিন্দুরা বড় বড় জমায়েত করে বা মহাপঞ্চায়েত ডেকে মুসলিম নির্যাতন উদযাপন করছে আর প্রকাশ্যে মুসলমানদের হত্যার হুমকি দিচ্ছে। হাজার হাজার হিন্দু জড়ো হয়ে মুসলিমদের হত্যা করাকে সমর্থন করছে! ভাবা যায়! এতো গণহত্যার প্রথম ধাপ।
গত জুলাই ২৪-এ কাজিন আহমদ নামের এক প্রবীণ মুসলাম রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। লম্বা দাড়ি আর টুপি দেখে তাকে সহজেই মুসলিম বুঝা যায়। তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে গাড়িতে তুলে নেয় অচেনা কয়েকজন যুবক। কিছুদূর যাওয়ার পর তাকে মেরে অজ্ঞান করে রাস্তায় ফেলে যায়। এ ঘটনাটি ঘটেছে উত্তরপ্রদেশের নয়াডাতে। হামলাকারীরা তাকেও ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করে। কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন ডালভাতের মতো এটা কোনো ব্যাপারই না। মিডিয়ায় এসব খবর প্রচার করা হয় না।
রাষ্ট্রীয়ভাবে ছড়ানো ঘৃণা-বিদ্বেষ সামাজিক রূপ নিয়েছে : এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেয়া ভাষণে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। মোদির দেয়া ভাষণে রাষ্ট্রীয়ভাবে ছড়ানো ঘৃণা এখন সামাজিক ও পারিবারিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রশ্ন উঠেছেÑ ‘হিন্দু-মুসলিম’ ইস্যু এনে কি মেরুকরণের চেনা রাজনীতিতে ফিরছেন মোদি? ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের ২০ কোটিরও বেশি মুসলমানের জীবন অশান্ত হয়ে পড়েছে। উগ্র হিন্দু গোষ্ঠী মুসলিম সন্দেহভাজন গরু ব্যবসায়ীদের গণধোলাই দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মুসলমান ব্যবসায়ীদের টার্গেট করা হচ্ছে, তাদের দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাট করা হচ্ছে। ওয়াক্ফ আইনের বাতিলের পর মসজিদ, মাদরাসা ও কবরস্থানগুলোকে টার্গেট করে ভেঙে দেয়া হচ্ছে।
ইন্টারনেট ব্যবহার করে মুসলিমবিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে : মুসলিম নারীদের অনলাইন ‘নিলাম’ করা নিয়ে ইন্টারনেটে ট্রল করা হচ্ছে। হিন্দুরা এবং মূলধারার কিছু গণমাধ্যম ‘জিহাদ’- ‘লাভজিহাদ’-এর অভিযোগ এনে ইসলামফোবিয়াকে উসকে দিচ্ছে। মুসলিমবিরোধী বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বৃদ্ধি পেয়েছে যে সকল অঞ্চলে তার তিন-চতুর্থাংশই বিজেপি শাসিত অঞ্চলগুলোকে ঘটছে।
হিন্দু-মুসলিম পারিবারিক ঘৃণা বৃদ্ধি পাচ্ছে : আগ্রার শহরে সুপরিচিত একটি স্কুলে হিন্দু ছাত্ররা তাদের মুসলিম সহপাঠীদের ‘পাকিস্তানি সন্ত্রাসী’ বলে উপহাস করছে। এমনকি মুসলিম ছাত্রদের তাদের সহপাঠী হিন্দু ছাত্ররা নর্দমার কীট বলেও কটাক্ষ করছে বলে বিবিসি এমন সংবাদ দিয়েছে। আগ্রার পঞ্চম প্রজন্মের বাসিন্দা পরিবেশবাদী কর্মী মিসেস ইরাম স্থানীয় একটি স্কুলে কাজ করার সময় শহরের শিশুদের মধ্যে কথোপকথনে পরিবর্তন লক্ষ করেছেন। “আমার সাথে কথা বলবে না, আমার মা বারণ করেছে” মিসেস ইরাম এ কথাটি একটি শিশুকে তার একজন মুসলিম সহপাঠীকে উদ্দেশ করে বলতে শুনেছেন। তিনি মন্তব্য করে বলেন, হিন্দু-মুসলিমবিদ্বেষ (ফোবিয়া) এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা সহজে নিরাময় করা সম্ভব না।
ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া : এপ্রিল মাসে নরেন্দ্র মোদির দেয়া ভাষণে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে। উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের মুখপাত্র সাক্ষী দিবাকর বিবিসিকে বলেছে, ‘আমাদের সরকার সবার পাশে আছে, সবার উন্নয়নের জন্য কাজ করছে, ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বিভেদ করার প্রশ্নই ওঠে না।’ সাক্ষী দিবাকরের এ বক্তব্য দিবালোকের ন্যায় মিথ্যা বলে সাধারণ জনতা মন্তব্য করেছে।
সুশীল সমাজের প্রতিক্রিয়া : ভারতের সমাজ কর্মী আফরিন ফাতিমা বলেন, উত্তরপ্রদেশে মুসলমানদের মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, আর তার পুরোটাই হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। ভোটের আগে যোগী আদিত্যনাথ মুসলমানদের কোণঠাসা করে ফেলছে। রুটি-রুজির প্রয়োজনেও মুসলমানরা ঘর থেকে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। উত্তরপ্রদেশের প্রতিটি মুসলমান নারী-পুরুষ জানে বাড়ির বাইরে পা ফেললেই জীবনের ঝুঁকি আছে। উত্তরপ্রদেশে মুসলমানরা ধারাবাহিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পুলিশ প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন মদদেই মুসলমানরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
দীর্ঘদিন উত্তরপ্রদেশে দায়িত্ব পালন করা পুলিশের সাবেক মহাপরিচালক ডক্টর বিক্রম সিং বলছেন ভিন্ন কথা। মিস্টার সিং বিবিসিকে বলেন, ‘যে কোনো সভ্য সমাজে এরকম মেরুকরণের চেষ্টা করা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, হতাশার ও নিন্দনীয়, এগুলো কখনোই কাম্য হতে পারে না।’ উত্তরপ্রদেশে শতাব্দীর পর শতাব্দী হিন্দু-মুসলিম শান্তিতে বসবাস করে আসছে আর আজ সেখানে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ডক্টর সিং আরো বলেন, ভারতের ট্র্যাজেডি হলো নির্বাচন আর হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ। ডক্টর সিং মনে করেন, মানবাধিকার কমিশন থেকে শুরু করে দেশের নানা ওয়াচডক ও এনজিওগুলো কিছুতেই এহেন কর্মকাণ্ড হতে দেবে না। উত্তর প্রদেশে প্রায় সাড়ে চার কোটি মুসলমান, তারা কি নীরবে এ অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করবে! না, এটা হতে পারে না। মি. সিং আরো বলেন, ভারতের মুসলমানদের কোনো মতেই সংখ্যালঘু বলা যাবে না। বরং বলা যেতে পারে, ‘এদেশে দুটি প্রধান সম্প্রদায় আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হিন্দু তারপরই মুসলিম।’
ভারতের সুপরিচিত লেখিকা ও অ্যাকটিভিস্ট ফারাহ নাকভি বলেন, আমার বিন্দু মাত্র সংশয় নেই, উত্তরপ্রদেশে যা ঘটছে, সেটা করা হচ্ছে আসন্ন নির্বাচনকে মাথায় রেখে। এখানে চার কোটিরও বেশি মুসলমান বসবাস করছে। ফারাহ নাকভি বিবিসিকে বলেন, ‘উত্তরপ্রদেশে ভোটের আগে বিজেপি তাদের পুরনো খেলায় ফিরেছে। কারণ এ রাজ্যে সুশাসন দিতে তারা চরম ব্যর্থ।’ মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য অতি সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদীনিপুর জেলার রেলস্টেশনে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ফিলিস্তিনের পতাকা রাস্তায় একে পদদলিত করা হচ্ছে।
‘বিয়িং মুসলিম ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ের লেখক জিয়া উস সালাম বলেন, ‘ভারতের মুসলমান জনগোষ্ঠী যেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে পড়েছে, তারা নিজের দেশেই অদৃশ্য সংখ্যালঘু।’
ভারতের মুসলিম নির্যাতন সম্পর্কে বাংলাদেশের সকল আলেম-ওলামা ও রাজনৈতিক দলগুলো পৃথক বিবৃতি দিয়েছে। ৩ মে হেফাজতে ইসলাম ভারতে মুসলিম নির্যাতনের প্রতিবাদে সমাবেশ করেছে। বাংলাদেশের জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা, ইসলামিক স্কলার শায়েখ ডক্টর আবুল কালাম আজাদ বাশার বলেন, “ভারত বিভক্তির পর থেকেই মুসলমানরা সেখানে নির্যাতিত। ভারত স্বাধীনের পর মুসলিম অধ্যুষিত হায়দরাবাদ দখলের জন্য প্রায় লক্ষাধিক মুসলমান হত্যা করেছে। কাশ্মীরকে জোর করে দখলে রাখার জন্য অনেক মুসলমানকে হত্যা করেছে, এখনো করছে। জুনাগড়ের শাসক হিন্দু হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে প্রতিবাদী অনেক মুসলমানকে হত্যা করে জুনাগড় দখলে নিয়েছে। বর্তমান মোদি সরকারের আমলে ভারতের সর্বত্র মুসলিমদের হত্যা নির্যাতন ও নিপীড়ন চলছে। এ নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশের ইসলামিক স্কলার জনপ্রিয় মিডিয়াব্যক্তিত্ব ডক্টর প্রফেসর মুক্তার আহমদ বলেন, “ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি অবদান থাকা সত্ত্বেও গুজরাটের কসাই মোদি মুসলমানদের নির্যাতনের টার্গেট বানিয়েছে। এটা মোদির ফ্যাসিবাদের বহিঃপ্রকাশ। মোদি ভাবছে, ইসরাইল গাজায় মুসলমানদের যেভাবে হত্যা করছে, সেভাবে ভারতও মুসলমানদের হত্যা করে শেষ করে দেবে। এটা কখনোই সম্ভব হবে না। কারণ গাজা আর ভারত এক নয়। ভারতের পাশেই আরো মুসলিম দেশ আছে। প্রয়োজনে মুসলমানরা তাদের ভাইদের রক্ষা করতে যা করা লাগে তাই করবে, ইনশাআল্লাহ।