পাকিস্তানে ভারতের হামলা : যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দুই দেশ
৮ মে ২০২৫ ১৩:৩৮
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের ওপর হামলার জেরে পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দুই দেশ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা এবার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। পূর্বে কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই গত ৬ মে দিবাগত রাতের অন্ধকারে ভারত পাকিস্তানের ভূখণ্ডে প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অন্তত ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে ভারতের দাবি হামলায় অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছে। এদিকে পাকিস্তান পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানানো শুরু করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার এ দুই দেশের মধ্যে এক বড় ধরনের উত্তেজনার সূচনা করেছে। দুই দেশ সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকেই যাচ্ছে।
আগ্রাসনের জবাব দিতে পাক সেনাবাহিনীকে নির্দেশ : জিও নিউজ জানায়, ভারতের আগ্রাসনের জবাব দিতে সেনাবাহিনীকে অনুমতি দিয়েছে পাকিস্তান। ৭ মে বুধবার জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এ অনুমোদন দেন।
ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে ৩ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত
ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে তিনটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে এগুলো কার, সেটি জানা যায়নি। জম্মু ও কাশ্মীরের স্থানীয় সরকারের চারটি সূত্র রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থাটি বলছে, পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ভারতের হামলার কয়েক ঘণ্টা পরই যুদ্ধবিমানগুলোর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর দাবি, পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। তবে ভারত সরকার এ নিয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
নিহত ৭০ নাকি ২৬
পাকিস্তানি ভূখণ্ডে হামলায় ৭০ জন নিহত হয়েছে বলে দাবি করছে ভারত। তাদের দাবি, নিহত সবাই ‘জঙ্গি’। তারা লস্কর-ই-তৈয়বা ও জেশ-ই-মোহাম্মদের সদস্য। খবর এনডিটিভির। তবে পাকিস্তানের আইএসপিআর ২৬ জন নিহতের কথা স্বীকার করেছে। গত ৭ মে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের আইএসপিআরের মুখপাত্র লে. জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী বলেন, ‘বেসামরিক স্থাপনাকে লক্ষ করেই হামলা চালানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান ভূখণ্ডের ছয় পৃথক স্থানে আকাশপথে ২৪টি হামলা চালিয়েছে ভারত। ভাওয়ালপুরের আহমেদপুর অঞ্চলে হামলায় ১৩ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে তিন বছর বয়সি দুই শিশু, সাত নারী ও চার পুরুষ রয়েছেন। এছাড়া সেখানে ৩৭ জন আহত হয়েছে, যার মধ্যে ৯ নারী ও ২৮ পুরুষ।’ সামরিক এ মুখপাত্র বলেন, মুজাফ্ফারবাদের বিলাল মসজিদে হামলায় তিনজন হতাহত হয়েছে। এর মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। কোটলির আব্বাস মসজিদে হামলায় দুই কিশোর-কিশোরী শহীদ হয়েছে। সেখানে মা ও মেয়ে আহত হয়েছে।’
হামলার যে ব্যাখ্যা দিল ভারত
হামলার পর ৭ মে কথা বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের’ অবকাঠামোয় ভারতের হামলা ঠেকাতে পাকিস্তান ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, একটি রেসিট্যান্স ফ্রন্ট পেহেলগাঁওয়ে হামলার দায় স্বীকার করেছে। এ সংগঠনটির সঙ্গে পাকিস্তানে নিষিদ্ধঘোষিত গোষ্ঠী লঙ্কর-ই-তৈয়বার সম্পর্ক রয়েছে। এর মাধ্যমেই বোঝা যায় কাশ্মীরে হামলায় পাকিস্তানের যোগসূত্র রয়েছে। মিশ্রি বলেন, ‘বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য ও বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ সত্ত্বেও পাকিস্তান তাদের ভূখণ্ড থেকে পরিচালিত সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কগুলোর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পাকিস্তান বিশ্বের কাছে সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে একটি পরিচিতি তৈরি করেছে।’
নেতাদের প্রতিক্রিয়া
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ৭ মে তার এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, বিশ্বের উচিত সন্ত্রাসবাদের প্রতি কোনো সহনশীলতা না দেখানো। ‘অপারেশন সিঁদুর’ লেখা একটি ছবি শেয়ার করেছেন তিনি ওই পোস্টে। এদিকে পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি স্থানে ভারতের সামরিক হামলার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ বলেছেন, প্রতিশোধ নেওয়ার সমস্ত অধিকার পাকিস্তানের রয়েছে। খবর বিবিসি বাংলা। সামরিক হামলার পর প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ ছাড়াও অন্যান্য মন্ত্রী এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা বিলওয়াল ভুট্টো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর সিরাজ-উল-হক এক ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘যুদ্ধ শুরু করেছে ভারত, কিন্তু এর শেষ করবে পাকিস্তান।’
নিয়ন্ত্রণরেখায় পাকিস্তানের গোলাবর্ষণ, ১০ ভারতীয় নিহত
ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগাঁও হামলা নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। পাল্টা জবাবে রাতেই হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। ৭ মে বুধবার সকালে নিয়ন্ত্রণরেখায় গোলাগুলি চলে দুদেশের। এতে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা পিটিআই। ভারতের কয়েকটি পত্রিকা অবশ্য মৃত্যুর সংখ্যা ১০ জন বলে দাবি করছে।
আলোচনা শুরু করার আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছানোর প্রেক্ষাপটে উভয় দেশের প্রতি শান্তিপূর্ণ আলোচনায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। ভারতীয় বিমানবাহিনী সম্প্রতি পাকিস্তানে অভিযান চালানোর পর এ বিবৃতি দিয়েছে হোয়াইট হাউস। ৬ মে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র ব্রায়ান হিউজ বলেন, ‘রুবিও ভারত ও পাকিস্তানের নেতৃত্বের মধ্যে যোগাযোগ পুনরায় চালু করার আহ্বান জানাচ্ছেন, যেন পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই তা প্রশমিত করা যায়।’
ভারত ও পাকিস্তান ইস্যুতে যা বলল চীন
প্রতিবেশী দুদেশের এ যুদ্ধের দামামা নিয়ে এবার মুখ খুলেছে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি চীন। দুদেশকেই সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে তারা। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত ও পাকিস্তানকে সংযম প্রদর্শন এবং শান্তি ও স্থিতিশীল রাখার আহ্বান জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে দুই দেশেরই প্রতিবেশী চীন বলছে, ‘ভারতের সামরিক অভিযানের বিষয়টি আমরা জেনেছি। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’
প্রসঙ্গত, গত ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসীদের হামলায় প্রাণ হারায় ২৬ পর্যটক। এ হামলায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে দাবি করে আসছে দিল্লি। এর জবাবে পাকিস্তানে হামলা চালিয়েছে ভারত। এক বিবৃতিতে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, ‘পেহেলগাঁওয়ে হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, আমরা এ প্রতিশ্রুতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ পাকিস্তানে চালানো হামলাকে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে আখ্যা দিয়েছে ভারত। তাদের দাবি, ‘জঙ্গি’ স্থাপনাকে লক্ষ করে হামলা চালানো হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তান বলছে, বেসামরিক স্থাপনাকে লক্ষ করেই হামলা চালানো হয়েছে। নিজেদের ভূখণ্ডে ভারতের এ হামলাকে ‘অ্যাক্ট অব ওয়ার’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে পাকিস্তান। এক বিবৃতিতে পাকিস্তান সরকার বলছে, ‘এর জবাব ভারতকে দেওয়া হবে।’
বিশ্ব কী বলছে
এই হামলা আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে এবং দুই দেশকে আরও সংঘর্ষ এড়াতে আহ্বান জানানো হচ্ছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ভারতের হামলা নিয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘বিশ্ব এমন সামরিক সংঘাত সহ্য করতে পারবে না।’
যুক্তরাষ্ট্র গত সপ্তাহেই উভয় পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানিয়েছিল। সর্বশেষ হামলার পর জানিয়েছে যে তারা পরিস্থিতি ‘নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।’
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত। তবে এই মুহূর্তে আমাদের কোনো মূল্যায়ন নেই। এটি একটি ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি এবং আমরা তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’
সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন ও জাপানও উভয় পক্ষকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে।
ভারতের এক জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা সিএনএনকে জানিয়েছেন, নয়াদিল্লি যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, রাশিয়াসহ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছে তাদের নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করেছে।