ইতিহাস গড়ে অসাধারণ প্রত্যাবর্তন : ট্রাম্প আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট
৮ নভেম্বর ২০২৪ ০০:০০
॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন ॥
ইতিহাস গড়ে অসাধারণ প্রত্যাবর্তন করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২৭৯টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ট্রাম্প। ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টায় এমন তথ্য জানিয়েছে আমেরিকাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজ। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সব ভোট গণনা শেষের আগেই প্রাথমিক ফলাফল বিশ্লেষণে এ তথ্য জানিয়েছে ওই সংবাদমাধ্যমটি। সর্বশেষ খবরে সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের প্রাপ্ত ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের সংখ্যা ২৭৯। অপরদিকে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ২২৩টি ভোট। দেশটিতে মোট ৫০টি অঙ্গরাজ্যে ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট রয়েছে। জিততে হলে ২৭০টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট দরকার। ইতোমধ্যে ট্রাম্প তা অতিক্রম করে গেছেন।
এদিকে ট্রাম্পের জয়ের খবরে বিভিন্ন রাজ্যে উৎসবে মেতেছেন তার সমর্থকরা। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের প্রধান কার্যালয় থেকে বিবিসি জানিয়েছে, ফক্স নিউজ যখন প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের অনুমান ঘোষণা করছিল, তখন হলরুমে উপস্থিত সমর্থকরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। তাদের কান ফাটানো জয়ধ্বনিতে এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ সময় অনেক সমর্থক আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ট্রাম্পের নামে স্লোগান দিতে থাকেন।
নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় রাখতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিছু রাজ্যে মোতায়েন করা হয়েছে স্নাইপার ইউনিট। রয়েছে কয়েক স্তরের গোয়েন্দা সতর্কতা। ভোট শেষেও বেশ কয়েকদিন এ ধরনের নজরদারি অব্যাহত থাকবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ।
চমৎকার জয়, আমেরিকার স্বর্ণযুগ আসছে ট্রাম্প
জয়ের একটু আগে ট্রাম্প ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচে সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। এ সময়ে মঞ্চে তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প এবং তার রানিংমেট জে ডি ভান্স। ট্রাম্প বলেন, ‘আমেরিকার জনগণের জন্য এটি চমৎকার জয়। এটা আমাদের আমেরিকাকে আবারও মহান করার সুযোগ দেবে।’ এটি আমেরিকার স্বর্ণযুগ হবে বলেন তিনি। ট্রাম্প মেলানিয়ার লেখা বইয়ের প্রশংসা করে বলেন, বইটি ‘আমেরিকার সর্বাধিক বিক্রিত’ বইয়ের একটি। তিনি (মেলানিয়া) দারুণ কাজ করেছেন। তিনি জনগণকে সাহায্য করতে কঠোর পরিশ্রম করেন। নিজের সন্তানদের অভূতপূর্ব বলে উল্লেখ করে তাদের ধন্যবাদ জানান ট্রাম্প। তিনি প্রত্যেক সন্তানের নাম ধরে ডাকেন। তারা মঞ্চে এসে দাঁড়ান। এরপর ট্রাম্প তার রানিংমেট জে ডি ভান্সকে শুভেচ্ছা জানান এবং বলেন, তিনি (ভান্স) যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন।
সমৃদ্ধ আমেরিকা গড়ার অঙ্গীকার
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয় ঘোষণা দিয়ে তাঁর সমর্থকদের বলেন তিনি একটি ‘শক্তিশালী, নিরাপদ এবং সমৃদ্ধ আমেরিকা তৈরি না পর্যন্ত বিশ্রাম নেবেন না। প্রতিটি দিন আমার শরীরের সব শক্তি দিয়ে আপনাদের জন্য লড়াই করবো,’ ট্রাম্প ফ্লোরিডার পাম বিচ কনভেনশন সেন্টারে তার সমর্থকদের সামনে দেয়া এক ভাষণে বলেন। ট্রাম্প যখন ভাষণ দিতে মঞ্চে ওঠেন, তখন দেশের প্রধান টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলো তাকে গুরুত্বপূর্ণ জর্জিয়া, নর্থ ক্যালিফর্নিয়া এবং পেনসিলভানিয়া রাজ্যে বিজয়ী ঘোষণা করে দিয়েছে।
মোদি-নেতানিয়াহুর অভিনন্দন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয় ঘোষণার আগেই ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সামাজিক মাধ্যম এক্সে নরেন্দ্র মোদি লেখেন, ‘ঐতিহাসিক নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আমার বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আন্তরিক অভিনন্দন। আপনার পূর্ববর্তী মেয়াদের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে আমি ভারত-মার্কিন ব্যাপক বৈশ্বিক এবং কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও শক্তিশালী করার জন্য উন্মুখ। আসুন, একসাথে আমাদের জনগণের উন্নতির জন্য এবং বিশ্ব শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির জন্য কাজ করি’। এদিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রপ্রধান ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানান।
ইলন মাস্ককে রিপাবলিকান পার্টির ‘নতুন তারকা’
বিশ্বের অন্যতম ধনী ও প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ককে রিপাবলিকান পার্টির ‘নতুন তারকা’ হিসেবে পরিচয় করিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত ৬ নভেম্বর বুধবার ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচে বক্তব্য রাখার সময় এ মন্তব্য করেন তিনি। এ সময় মাস্ককে ‘বিস্ময়কর’ ব্যক্তি হিসেবেও উল্লেখ করেন তিনি। বক্তব্যে ইলন মাস্ককে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন ট্রাম্প। তিনি জানান, একবার স্পেসএক্স রকেটের একটি ভিডিও দেখার সময় তিনি মাস্ককে ৪০ মিনিটের জন্য আটকে রেখেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট পদে জয় কীভাবে?
সাধারণত নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই জয়লাভ করেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে একজন প্রার্থী বেশিসংখ্যক ভোটারের ভোট (পপুলার ভোট) পাওয়ার পরও বিজয়ী নাও হতে পারেন। এর কারণ দেশটিতে ভোটাররা সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন না। সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয় ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ নামে বিশেষ একটি ব্যবস্থায়। এক্ষেত্রে জাতীয় স্তরের নির্বাচনী লড়াইয়ের বদলে প্রার্থীদের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে স্থানীয়ভাবে, তথা প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী লড়াইয়ের মাধ্যমে। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের একটিতে জয়ী হওয়ার অর্থ হলো একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সবকটি ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ ভোট পেয়ে যাবেন। দেশটিতে ইলেক্টোরাল কলেজের মোট ভোটের সংখ্যা ৫৩৮টি। মাইন ও নেব্রাসকাÑ এ দুটি অঙ্গরাজ্য বাদে বাকি ৪৮টি অঙ্গরাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোট যোগ দিয়ে যে প্রার্থী ২৭০টি বা তারও বেশি ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ ভোট পাবেন, তিনিই হবেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আর বিজয়ী প্রার্থীর রানিং মেট হবেন দেশটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট। সাধারণ ভোটারদের ভোটে পিছিয়ে থেকেও ইলেক্টোরাল ভোটে যুক্তরাষ্ট্রের এখন পর্যন্ত পাঁচজন ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, যার মধ্যে রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জর্জ ডব্লিউ বুশও রয়েছেন।
‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ আসলে কী?
‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ব্যবহৃত রাষ্ট্র ও কেন্দ্রীয় আইনের একটি জটিল ব্যবস্থা, যা দেশটির সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত। ‘কলেজ’ শব্দটির অর্থ এখানে সেই ব্যক্তিদের বোঝানো হয়, যারা একটি অঙ্গরাজ্যের ভোট দেওয়ার অধিকারী। ‘ইলেক্টোরাল কলেজ হচ্ছে কর্মকর্তাদের একটি প্যানেল, যাদের ‘ইলেকটরস’ বলা হয়। এরা এককথায় নির্বাচকমণ্ডলো। প্রতি চার বছর পরপর এটি গঠন করা হয় এবং এরাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট বাছাই করেন। কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে প্রতিটি স্টেট বা অঙ্গরাজ্যে ইলেক্টোরসের সংখ্যা নির্ধারিত হয়, যা নির্ধারিত হয় স্টেটে সিনেটরের সংখ্যা (প্রত্যেক স্টেটে দুইজন) এবং প্রতিনিধি পরিষদে প্রতিনিধির (যা জনসংখ্যার অনুপাতে) যোগফল মিলে। ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি অনুযায়ী যেসব রাজ্যে জনসংখ্যা বেশি, সেসব রাজ্যে ইলেক্টোরাল ভোটও বেশি। সবচেয়ে বড় ছয়টি স্টেট হলো ক্যালিফোর্নিয়া (৫৫), টেক্সাস (৪০), নিউইয়র্ক (২৯), ফ্লোরিডা (২৯), ইলিনয় (২০) এবং পেনসিলভেনিয়া (২০)। এ পদ্ধতির ফলে ছোট রাজ্যগুলোকে আরো বেশি গুরুত্ব দেয়, যার অর্থ হচ্ছে একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে অবশ্যই দেশজুড়ে ভোট পেতে হবে। সাধারণত অঙ্গরাজ্যগুলো তাদের হাতে থাকা ইলেক্টোরাল ভোট সেই প্রার্থীকেই দেয়, যিনি ওই অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের সরাসরি ভোটে জয়ী হয়েছেন।
ধরা যাক, টেক্সাসে একজন প্রার্থী ভোটারদের সরাসরি ভোটের ৫০.১% পেয়েছেন, তাকে ওই অঙ্গরাজ্যের হাতে থাকা ৪০টি ইলেক্টোরাল ভোটের সবগুলোই সেই প্রার্থী পেয়ে যাবেন। একটি অঙ্গরাজ্যে জয়ের ব্যবধান যদি বিরাট হয়ও, তাহলেও বিজয়ীপ্রার্থী ওই নির্দিষ্টসংখ্যক ইলেক্টোরাল ভোটই পাবেন। ফলে সবগুলো অঙ্গরাজ্য মিলিয়ে একজন প্রার্থী ভোটারদের ভোট বেশি পাওয়ার পরেও ইলেক্টোরাল ভোট কম পাওয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে যেতে পারেন। ২০০০ সালে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী আলগোর এবং ২০১৬ সালে আরেক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটেছিল।