খুররম, খুরশিদ, জাফর : স্বপ্নীল অভিযাত্রী
৮ মে ২০২৫ ১৪:৫৪
॥ মুহাম্মদ আবু সুফিয়ান ॥
তারা ছিলেন তিন বন্ধু। খুররম, খুরশিদ, জাফর। করাচির তিন তরুণ।
তিনজনই এসেছেন সদ্য স্বাধীন হওয়া পাকিস্তানে উদ্বাস্তু হিসেবে। ভারতের তিন প্রদেশ থেকে এসেছেন তিনজন। তারপর এক স্বপ্নীল অভিযাত্রা শুরু করেন তারা। সমাজকে পালটে দেয়ার অদম্য স্বপ্ন তাদের বুকে, আর ইসলামের জন্য কাজ করার জযবা প্রাণে। এ স্বপ্ন ও জযবাই তাদের সমাজের তিন প্রান্ত থেকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছিল।
খুররম এসেছেন ভুপাল থেকে মুহাজির হয়ে। জমিজমা, ঘরবাড়ি ছেড়ে এসে তার পরিবার করাচিতে হতদরিদ্র জীবন শুরু করে। ছাত্র হিসেবে ছিলেন গড়পড়তা।
খুরশিদ মেধাবী; মধ্যবিত্ত কিন্তু অমশহুর পরিবারের সন্তান। তিনি এসেছেন দিল্লি থেকে। আর জাফর মুহাজির হয়ে এসেছেন ভারতের এলাহাবাদ থেকে। সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক ও আলেম পরিবারের ছেলে।
জাফরের বাবা সিনিয়র জাফর। পুত্র জাফর ইসহাক আনসারি। পিতা জাফর আহমাদ আনসারি।
জাফর আহমাদ আনসারি মুসলিম লীগের প্রখ্যাত নেতা, আলেম ও জাদরেল পার্লামেন্টারিয়ান।
খুররম, খুরশিদ ও জাফরের জীবন লক্ষ্যের মিল তাদের একত্রিত করে একটি ফ্ল্যাটফর্মে। জমিয়তে তালাবা পাকিস্তান। ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানে কাজ করছে এ সংগঠন। আরও বহু তরুণের ভিড়ে এ তিনজন হয়ে ওঠেন জিগরি দোস্ত। তিনজনের বাড়ির তিনটি কামরা হয়ে ওঠে তাদের পড়ার রুম ও সংগঠনের অফিস।
খুররম ভর্তি হন এনইডি কলেজের (করাচির বুয়েট বলা যায়) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। খুররমের কঠোর পরিশ্রম তাকে গড়পড়তার সারি মাড়িয়ে মেধাবী ছাত্র বানিয়ে দেয়। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে বিএসসি শেষ হয় তার।
খুরশিদ করাচি ইউনিভার্সিটির ইকোনমিকসের ছাত্র।
আর জাফরও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিকাল সায়েন্সের ছাত্র।
তিনজন মিলে করাচির সংগঠনকে গড়ে তোলেন তারা। জমিয়ত তখনো সদ্য প্রতিষ্ঠিত সংগঠন। তাই সেন্ট্রাল নিয়ন্ত্রণ খুব বেশি না; শিথিল। যে যার মতো কাজ করেন অনেকটা। কিছু মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কেন্দ্রের। সেই দৃষ্টিভঙ্গি ও মূলনীতিকে সামনে রেখে বিভিন্ন প্রদেশ ও শহর নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিত নিজেদের স্থানীয় সংগঠনকে। বলা যায় স্বায়ত্তশাষিত শাখা ছিল প্রদেশ ও বড় শহরগুলো।
সৌভাগ্যক্রমে করাচি জমিয়ত তখন মুরশিদ হিসেবে পায় এক আরব যুবককে। সাঈদ রমাদান।
ইমাম হাসান আল বান্নার জামাতা এবং ইখওয়ানুল মুসলিমিনের বিখ্যাত যুবনেতা সাঈদ রমাদান (ড. তারিক রমাদানের পিতা)। সাঈদ তখন মিশর থেকে প্রাণ নিয়ে হিজরত করে এসেছেন পাকিস্তানে। করাচিতে যাপন করছেন মুহাজিরি জীবন।
খুররম, খুরশিদ, জাফর তিন বন্ধু সাঈদ রমাদানের কাছে তারবিয়াতের সুযোগ পেয়ে যান। ইখওয়ানের অভিজ্ঞতা তাদের ঋদ্ধ করে। তারা করাচি জমিয়তকে সাজাতে থাকেন জামায়াত, জমিয়ত ও ইখওয়ানকে ব্লেন্ড করে। ফলে করাচি জমিয়ত হয়ে ওঠে কিছুটা স্বতন্ত্র, কিন্তু মানসম্মত, আলোচিত ও পুরো দেশের মধ্যে রোলমডেল।
তারা তিনজনই ক্রমান্বয়ে করাচি জমিয়তের নাজিমের দায়িত্ব পালন করলেন।
তারপর খুররম মুরাদ ও খুরশিদ আহমদ একসময় জমিয়তে তালাবার কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হলেন। এমনকি এখন পর্যন্ত তারা জমিয়তের সবচেয়ে আলোচিত সভাপতিদের শীর্ষস্থানীয়।
তারা ছিলেন প্রত্যেকে চিন্তায় ও পরিকল্পনায় পরস্পর শরিক। ফলে তাদের জীবন প্রায়ই হেঁটেছে একই রেখা ধরে। জমিয়তে দায়িত্ব পালন ও করাচিতে পড়াশোনা শেষ করে তিনজনই পাড়ি জমান পাশ্চাত্যে উচ্চশিক্ষার জন্য।
খুররম আমেরিকার মিনেসোটা ইউনিভার্সিটি থেকে সিভিলে এমএসসি করেন।
খুরশিদ যান ইংল্যান্ডের লিচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে। আর জাফর কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে।
তারপর তারা একসময় থিতু হন লন্ডনে। সেখানে গড়ে তোলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন ইউকে। ইউরোপে ইসলাম প্রচার-প্রসারে যাদের অবদান অনস্বীকার্য, তারা তাদের অন্যতম শুধু নয়, শীর্ষতমও।
পেশাগত জীবনে তিনজনই নিজ নিজ অঙ্গনে উজ্বল হয়ে ওঠেন।
খুররম জাহ মুরাদ হয়ে ওঠেন জগদ্বিখ্যাত প্রকৌশলী। এমনকি তিনি দায়িত্ব পালন করেন কাবাঘরের মসজিদুল হারাম সম্প্রসারণের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে।
খুরশিদ আহমদ ইসলামী অর্থনীতিবিদ হিসেবে হয়ে ওঠেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়। ইসলামী অর্থনীতিতে অবদানের জন্য লাভ করেন মুসলিম বিশ্বের নোবেলখ্যাত বাদশাহ ফয়সাল অ্যাওয়ার্ড।
জাফর ইসহাক আনসারি ইসলামাবাদ ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটিকে গড়ে তোলায় জীবনব্রত করেন।
তিন বন্ধুই লেখক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধাদি ও বইপত্র লিখেছেন।
খুররম মুরাদ আন্দোলনী সাহিত্যে বিশাল ভাণ্ডার রেখে গেছেন।
খুরশিদ আহমদ লিখেছেন ইসলামী অর্থনীতির ওপর মূল্যবান গবেষণা গ্রন্থাদি।
জাফর ইসহাক লিখেছেন ইসলামিক স্টাডিজের বিভিন্ন দিক ও শিক্ষাব্যবস্থার ওপর।
খুররম মুরাদ ও খুরশিদ আহমদ জামায়াতে ইসলামীতেও শীর্ষস্থানীয় দায়িত্ব পালন করেন। দুজনই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পাকিস্তান জামায়াতের নায়েবে আমীর ছিলেন।
তিন বন্ধুর মহাকাব্যিক জীবন সফরের শেষ মুসাফির ছিলেন খুরশিদ আহমদ। তিনি ২০২৫ সালের ১৩ এপ্রিল জীবনসফর শেষ করেছেন।
এর আগে খুররম মুরাদ ইন্তেকাল করেছেন ১৯৯৬ সালে। জাফর ইসহাক আনসারি ইন্তেকাল করেছেন ২০১৬ সালে।
আল্লাহ তায়ালা তিন বন্ধুকে জান্নাতে একত্রিত করুন। আমাদের এমন বন্ধু নির্বাচনের সুযোগ দিন, যারা দুনিয়ায় বিলিয়ে যায় ফুলেল সুবাস, আর আখিরাতেও যাদের সম্মানিত হওয়ার সম্ভাবনা হয়ে ওঠে প্রবল।