সংবাদ শিরোনামঃ

বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ আড়াল করতে নতুন ‘চমক’! ** ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে দেশে কোনো অর্থনৈতিক সমস্যা থাকবে না : নাজির আহমদ ** আওয়ামী বলয়ে অদৃশ্যমান তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ** বিচারের নামে জামায়াত নেতাদের সাথে অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণ করা হচ্ছে ** খোশ আমদেদ মাহে রমজান ** তরুণ প্রজন্মের সুযোগ হয়েছে আওয়ামী লীগকে চেনার ** সৈয়দ আলী আহসান : চেনা কন্ঠস্বরÑঅচেনা জ্যোতিষ্ক ** ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে দেশকে বাঁচাতে মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে আসতে হবে ** ইলিশের দেখা নেই ** দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে দেশব্যাপী ১৮ দলীয় জোটের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত **

ঢাকা, শুক্রবার, ২০ জুলাই ২০১২, ৫ শ্রাবণ ১৪১৯, ২৯ শাবান ১৪৩

অধ্যাপক গোলাম আযমের বিপে দ্বিতীয় সাী মাহবুবের জবানবন্দী

অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অভিযোগ নেই

অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অভিযোগ নেই

সোনার বাংলা রিপোর্ট : মুজিবনগর সরকারের গার্ড অব অনার প্রদানের নেতৃত্বদানের বিশেষ সম্মানের অধিকারী মাহবুব উদ্দিন আহমেদ তার জবানবন্দীতে বলেছেন, বর্তমান জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবং মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর সহায়তায় আমি তাজউদ্দিন আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমির উল ইসলামকে চুয়াডাঙ্গার চ্যাংখালি বিওপির পাশ দিয়ে বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করি। বিএসএফ তাদেরকে নিরাপদে ও সসম্মানে দিল্লি নিয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলায় যে সরকার শপথ নিয়েছিল তা তার আগেই আগরতলায় গঠিত হয়েছিল। তার জবানবন্দীর পুরোটাজুড়েই মুক্তিযুদ্ধে তার নিজের ভূমিকার বর্ণনা আছে। অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অভিযোগ নেই।

মাহবুব উদ্দিন আহমদ গত ১৫ জুলাই রোববার অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপরে দ্বিতীয় সাী হিসেবে জবানবন্দী প্রদান করেন। অধ্যাপক গোলাম আযমের উপস্থিতিতে গতকাল বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত ২ ঘণ্টাব্যাপী তার জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়। জবানবন্দীর পুরো সময়টাতেই অধ্যাপক গোলাম আযম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। বিচারপতি নিজামুল হক, বিচারপতি আনোয়ারুল হক এবং একেএম জহির আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুুনাল-১ এ মাহবুব ২ নং সাী হিসেবে গত ১৫ জুলাই জবানবন্দী দেন। ইতঃপূর্বে প্রথম সাী হিসেবে জবানবন্দী দেন প্রফেসর ড. মুনতাসির মামুন। তার জেরা আংশিক সম্পন্ন হয়েছে। আরও জেরা বাকি রয়েছে। ড. মামুনের সময় সুযোগ মত যে কোনো সময় তার বাকি জেরা হবে। এরই মধ্যে ২য় সাীর জবানবন্দী হলো। 

মাহবুব উদ্দিন আহমদ গত ১৫ জুলাই যে জবানবন্দী দেন তার বিবরণ নিম্নরূপ :

আমার নাম মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, পিতা মৃত আলতাফ উদ্দিন আহমেদ। আমার বয়স ৬৭ বছর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে আমার বয়স ছিল ২৬ বছর। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করি। ১৯৬৭ সালে আমি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশ ক্যাডারে এসএসপি হিসেবে যোগদান করি।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমি চট্টগ্রামের সাতকানিয়াতে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে প্রশিণরত ছিলাম। পরে আমি ঝিনাইদহে এসডিপিও হিসেবে যোগদান করি। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঢাকায় আসি সাতকানিয়া থেকে। কিন্তু ভাষণ শোনা হয়নি। কারণ রেডিও বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে যার যার কর্মস্থলে ফিরে যাই। কেউই ক্যাম্পে ঐ রাতে ফেরত যায়নি। আমি ঢাকায় চলে এসে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে অবস্থান করি এবং ১৭ মার্চ পর্যন্ত সেখানেই ছিলাম। এই ক’দিনে আমি বাংলাদেশের মানুষের তৎকালীন অবস্থা ও আন্দোলনের গতিধারা সম্পর্কে ওয়াকেফহাল হই। ১৭ মার্চ আমার কর্মস্থল ঝিনাইদহে চলে যাই। সেখানে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করি এবং স্থানীয় যুবকদের আনসার ও মুজাহিদ ট্রেনিং এর সাথে সম্পৃক্ত করে দেই। ২২ মার্চ আমার বাসস্থান ঝিনাইদহের ওয়াপদা রেস্ট হাউসে আমার বন্ধু ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী মেহেরপুরের এসডিও, মাগুরার এসডিও ওয়ালিউল ইসলাম, রাজবাড়ীর এসডিও শাহ মোহাম্মদ ফরিদ এবং নড়াইলের এসডিও কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী আসেন। তাদের সঙ্গে দেশের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি। সিদ্ধান্ত হয় যে আমরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঝিনাইদহ থানায় রাজারবাগ পুলিশের ওয়্যারলেস থেকে ভয়েস ম্যাসেজ আসে যে ঢাকা রাজারবাগ পুলিশ লাইন পাকিস্তান আর্মি আক্রমণ করেছে। এই খবর আমাকে একজন কনস্টেবল দেয়। আমি সঙ্গে সঙ্গেই থানায় চলে আসি এবং স্থানীয় জনগণ ও নেতৃবৃন্দকে থানায় ডেকে আনি। ঝিনাইদহের সরকারি কর্মকর্তারাও সে সময় থানায় আসেন। আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেই পাকিস্তানি আর্মির আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করব। তখন আমার ঝিনাইদহ কোতে (অস্ত্রাগারে) ৪শ ৩০৩ রাইফেল ছিল। সেগুলো বের করে দিয়ে দেই এবং সবাইকে নিয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলি। এর মধ্যে টেলিফোনে খবর আসে যে সেনাবাহিনী যশোর ঝিনাইদহ রোড দিয়ে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। খবর পেয়ে আমরা ঝিনাইদহকে ব্লাক আউট করে দেই। এই অবস্থা দেখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝিনাইদহ শহর থেকে ৫ মাইল দেিণ অবস্থান নেয়। আমরা সিদ্ধান্ত নেই পাকিস্তান আর্মির হেভি অস্ত্রের বিরুদ্ধে  আমরা ৩০৩ রাইফেল দিয়ে যুদ্ধ করলে সবাই মারা যাব। এ জন্য আমরা শহরের পাশে কুশর েেত (আখ তে)  আত্মগোপন করি। পাকিস্তান আর্মির একটি জিপ থানায় এসে আমাদের সবাইকে খোঁজাখুঁজি করে। কাউকে না পেয়ে শহরের  ওপর দিয়ে তারা সদলবলে কুষ্টিয়া চলে যায়। আমরা তখন আবার ঝিনাইদহে ফিরে আসি এবং তাৎণিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ঝিনাইদহে প্রবেশের পর সকল রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে এলাকার আবাল বৃদ্ধ-বনিতা ঝাঁপিয়ে পড়ে রাস্তায়। সে সময় ঝিনাইদহ-যশোর, ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ-মাগুরা, ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গার সকল রাস্তা বড় বড় গাছ ফেলে বন্ধ করে দেয়া হয়। ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়াররা ঝিনাইদহ থেকে উত্তরে ৮ মাইল দূরে গাড়াগঞ্জ ব্্িরজ এবং ৫ মাইল দেিণ বিষয়খালী কালভার্ট এই দুইটি রাস্তা পানির সাথে মিশিয়ে ওপরে আলকাতরা ঢেলে মুডি ট্রাপে তৈরি করা হয়। দূর থেকে রাস্তা কাটা বোঝা যাচ্ছিল না। যেখানে এরূপ করা হয়েছিল তার পাশে নদীর পাড়ে বাংকার তৈরি করে মুক্তিবাহিনী অবস্থান নেয়। এরই মধ্যে ২৮ মার্চ তারিখে চুয়াডাঙ্গার ইপিআর-এর ৮নং ব্রিগেডের অফিসার আবু ওসমান চৌধুরী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি আমাকে চুয়াডাঙ্গায় আসতে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে আমার বন্ধু ড. তৌফিক ই ইলাহীর সাথে আবার দেখা হয়। আমাকে ও তৌফিককে আবু ওসমান  ক্যাপ্টেনের ব্যাজ পরিয়ে দেয় যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার জন্য। আসার পর ঝিনাইদহে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সশস্ত্র বাহিনীর বিপরীতে আমাকে যুদ্ধ করার নেতৃত্ব দেয়। ২৯ মার্চ সকাল বেলা ঝিনাইদহে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এমপি এ কে এম এ আজিজ আমাকে খবর দেন যে, ঢাকা থেকে ২ জন মেহমান এসেছে। আপনি আসুন। তার বাসায় অনুমান ১১টার সময় তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজ উদ্দিন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমির উল ইসলামের দেখা হয়। তারা আমাকে সীমান্ত পার করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আমি আমার বন্ধু তৌফিকের সাথে যোগাযোগ করে বিকেলে ঝিনাইদহ থেকে রওয়ানা হয়ে চুয়াডাঙ্গার চ্যাংখালি বিওপির কাছ থেকে তাদেরকে ভারতীয় বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করি। তারা নিরাপদে সসম্মানে দিল্লি নিয়ে যায়।

৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় ৮নং ইপিআর উইং কমান্ডার মেজর আবু ওসমানের নেতৃত্ব কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহের জনগণ কুষ্টিয়ায় পাক বাহিনীকে প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেই। সেই মোতাবেক ৩০ এপ্রিল শেষ রাতে কুষ্টিয়ার জনগণ ও আমাদের তরফ থেকে প্রেরিত ও চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রেরিত এক কোম্পানি সশস্ত্র বাহিনী কুষ্টিয়ায় আক্রমণ করে। কুষ্টিয়ার লাখ লাখ মানুষ সেদিন আমদেরকে সহায়তা করে। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে। পাকিস্তান আর্মি আমাদের আক্রমণের মুখে শহরের ৩ স্থান থেকে বের হয়ে জেলা স্কুলে জড়ো হয়। জনগণ জেলা স্কুলের চারদিকে ঘেরাও করে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পাকিস্তান বাহিনী তখন দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঝিনাইদহের পথে রাতের অন্ধকারে রওয়ানা দেয় ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তবে গাড়াগঞ্জে এসে মুডি ট্রাপে তাদের সামনের গাড়িগুলো পড়ে যায়। এতে তাদের অনেকেরই সলিল সমাধি হয়। নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে অনেকে নিহত হয়। এই অবস্থায় সারারাত তারা কামান বন্দুক দিয়ে ঝিনাইদহের ওপর গুলি চালায়। এই অবস্থায় তারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। সকাল বেলা গ্রামের মানুষ তাদের সবাইকে হত্যা করে এবং সমস্ত গোলা বারুদ উদ্ধার করে ঝিনাইদহ থানায় নিয়ে আসে। লেফট্যানেন্ট আতাউল্লাহ শাহ শৈলকুপায় একটি বন্ধ দালানের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে পাগলের মতো গুলি ছুড়তে থাকে। আমি নিজে মুক্তিযোদ্ধাদের চারদিকে ঘেরাও করে তাকে গুলি ছোড়া বন্ধ করতে আহ্বান করলে সে বন্ধ করে। তাকে আমরা গ্রেফতার করি এবং ঝিনাইদহে পুলিশ বাহিনী এনে পিও ডব্লিউ হিসেবে চুয়াডাঙ্গা হয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেই। আমার জানা মতে সে প্রথম যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানি সামরিক অফিসার।

পাকিস্তানিরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৩১ মার্চ আরেকটি দল পাঠালে তারা বিষয়খালী এসে একইভাবে পর্যুদস্ত হয়। আমাদের রাইফেলধারীরা তাদেরকে প্রতিহত করে এবং তারা পালিয়ে যায়। এই দুই দিনের যুদ্ধে আমাদের ৬ জন মারা যায়। অনেকে আহত হয়। নিহদের মধ্যে ২ জন ছিলেন স্থানীয় এম এন এ ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম সাহেবের ২ পুত্র। এই যুদ্ধে পাকিস্তান আর্মির শতাধিক ৯ এম এল অটোমেটিক রাইফেল কতগুলো অটোমেটিক এলএমজি, এলজি, মর্টার এবং ৬টি ওয়ান ও সিক্স আরসিএল গান সঙ্গে ১৮ পাউন্ডের শতাধিক বোমা এবং কয়েক লাখ গুলি আমরা দখল করি। ফলে আমরা অত্যন্ত শক্তিশালী হই এবং যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করার চিন্তা করি। এই যুদ্ধের ফলে যমুনা নদীর পশ্চিমে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সকল অঞ্চল মুক্ত ও স্বাধীন হয়। আমরা আমাদের সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমানের সাথে শলাপরামর্শ করে যশোর ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হই। ১০ মাইল উত্তরে বারবাজারে আড়াআড়ি রেল লাইনের পাশে ট্রেন্স কেটে অবস্থান গ্রহণ করি। যশোর-ঝিনাইদহ রোড পাকিস্তান আর্মির জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় ১০ এপ্রিল পর্যন্ত চলতে থাকে। পাকিস্তান আর্মি তাদের অবস্থান সংহত করার জন্য আমাদের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ করে গোয়ালন্দ, ঈশ্বরদী ও ঝিনাইদহ অঞ্চলে। প্রথমেই তারা বিমানবাহিনীর সাহায্যে আক্রমণ করে। ১১ এপ্রিল পাকিস্তান আর্মি যশোর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আমাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। আমরা তাদের প্রতিরোধ করি। আমাদের অবস্থান শক্ত দেখে তারা বাদিক থেকে আমাদের বাইপাস করে এবং কালিগঞ্জে আমাদের পেছনে অবস্থান নেয়। ফলে আমরা সামনে ও পেছনে উভয় দিক থেকে আক্রান্ত হই। এতে আমাদের পে আর টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। আমরা সদলবলে উইথড্র করে গ্রামের পথ ধরে ঝিনাইদহ চলে আসি। পাকিস্তান আর্মি অতি ধীর গতিতে অগ্রসর হয়ে ১৪ তারিখে ঝিনাইদহের কাছাকাছি পৌঁছে। ঝিনাইদহে জেনারেল উইথড্রয়ের অর্ডার দিয়ে সাবইকে নিয়ে চুয়াডাঙ্গার পথে রওয়ানা হই। যাওয়ার পথে তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং ২০ কেজি স্বর্ণ নিয়ে যাই। এই টাকা পয়সা পরবর্তীতে ২৫ মে বাংলাদেশ সরকারের কোষাগারে জমা দিই।

এই জমা রশিদটি বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরতি আছে। ১৪ তারিখে রওনা দিয়ে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর হয়ে ভারতে বেতাই ক্যাম্পে পরের দিন সকাল বেলা ১৭ এপ্রিল আমার বন্ধু তৌফিক দুজনই আমাদের সঙ্গে থাকা গাড়ি ও কিছু সৈনিক নিয়ে বর্ডার ক্রস করে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তালায় চলে আসি। সেদিন আমরা সকালেই খবর পাই যে, বৈদ্যনাথ তলায় বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীন সরকার স্বাধীন মাটিতে শপথ গ্রহণ করবে। ১০ এপ্রিল এই সরকার আগরতলায় গঠিত হয়েছিল। ১১টার দিকে বৈদ্যনাথ তলায় কলকাতা থেকে আমাদের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ অনেকেই আসেন।

তাদের সাথে বিবিসি, ভোয়া, সিবিসি, রয়টার প্রভৃতি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নিউজ এবং প্রেস মিডিয়া, টেলিভিশন ক্যামেরাসহ উপস্থিত হয়। ১২টার দিকে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হলে সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী, কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ত্রাণমন্ত্রী, মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মোস্তাককে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে শপথ পড়ানো হয়। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত ছিলেন না। তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয় এবং চিফ হুইপ ইউসুফ আলী তাদেরকে শপথ বাক্য পাঠ করান। তখন এই নবগঠিত সরকারকে একটি চৌকস মুক্তি বাহিনীর সশস্ত্র দল একত্রিত করে আমার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর প থেকে গার্ড অব অনার দেয়। এই গার্ড অব অনার দেয়ার নেতৃত্ব আমার দেয়ায় সৌভাগ্যবান হয়েছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দণি-পশ্চিম রণাঙ্গনে অর্থাৎ যশোর-কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, মাগুরা, বরিশাল, খুলনা, পটুয়াখালী এই বিশাল অঞ্চলের প্রথম পর্যায়ের প্রতিরোধ যুদ্ধের সংপ্তি বিবরণ আমি এখানে দিলাম। এর মধ্যে এই অঞ্চলের সমস্ত মানুষের সুখ-দুঃখ চোখের জল স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রয়াস, প্রত্যাশা এবং সচেষ্ট অংশ গ্রহণ ও সার্বিক জনযুদ্ধের একটি চিত্র দিতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এর পরে দীর্ঘ ৯ মাস যারা আমার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন তাদের নিয়ে বেনাপোলে কাগজপুকুরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। ২৮ মে সাতীরার ভোমরায় যুদ্ধ করে দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টায় ৯ নম্বর পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে নাস্তানাবুদ করেছি, ভয় ভীতির কারণে এই রেজিমেন্টকে পাকিস্তান আর্মি প্রত্যাহার করে নিয়ে যায়। তাদের অনেক ক্যাপ্টেন, মেজর হতাহত হয়। যাদের অনেকের লাশ আমরা উদ্ধার করেছি এবং সাতীরা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ৮নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ করেছি। ১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে কাকডাঙ্গা বিওপি আক্রমণ করতে গিয়ে আমার অনেক সৈনিককে হারিয়েছি এবং আমি নিজেও আহত হয়েছি। ৪ সপ্তাহ ভারতের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। ১৬ অক্টোবর পুনরায় সাব সেক্টরে ফিরে আসি এবং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সাতীরায় কলারোয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে লড়াই অব্যাহত রাখি। এই যুদ্ধের শেষ অংশে ৮ ডিসেম্বর সাতীরা হানাদার মুক্ত হয়। আমি দল বল নিয়ে যশোরের মনিরামপুর প্রাইমারি স্কুলে অবস্থান নেই। এর মধ্যে ১৬ ডিসেম্বর খবর পাই যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং পাকিস্তান আর্মি রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছে।

এই যুদ্ধ চলাবস্থায় আমাদের মুক্তি বাহিনীর হাতে অনেক রাজাকার, আল বদর, আল শামস গ্রেফতার হয়েছে। তাদের কাছে থেকে এবং পাকিস্তান রেডিও ও তৎকালীন পত্র পত্রিকা শুনে ও পড়ে জেনেছি আওয়ামী লীগ ১৯৭০ এর নির্বাচনে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তখন যে দলগুলো তার বিরোধিতা করে পরাজিত হয় তাদের মধ্যে ছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি। এই পরাজিত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে টিক্কা খানের সাথে দেখা করে ২০ মার্চ থেকে তাদের পরিচালিত অপারেশন সার্চ লাইটকে সমর্থন করে এবং সেই পাকিস্তান আর্মিকে সহায়তা করার জন্য শান্তি কমিটি গঠন করতে দেশব্যাপী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আমি শুনেছি যারা টিক্কা খানের সাথে দেখা করেছিল তাদের মধ্যে ছিল গোলাম আযম, খাজা খায়ের উদ্দিন, এম নুরুল আমিন। স্বাধীনতার পরে তাদের দেখা করার ছবি সম্বলিত পত্রিকাও আমি দেখেছি।

জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ। এই ছাত্রসংঘ রাজাকার বাহিনী গঠন করে। তার সঙ্গে তারা আল বদর বাহিনীও গঠন করে। শান্তি কমিটি, আল বদর, রাজাকারদের সশস্ত্র করার জন্য শুনেছি গোলাম আযম সাহেব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথেও দেখা করেছেন। পরে এই বাহিনীগুলো আইনি ভিত্তি দেয়ার জন্য আনসার বাহিনী বিলুপ্ত করে রাজাকার বাহিনী গঠন করে। রাজাকার আল বদর, আল শামসের মাধ্যমে যারা আগ্রহী ছিল তাদেরকে সশস্ত্র করা হয় এবং বেতন ভাতা দেয়া হয়।

আমরা যেখানেই যুদ্ধ করেছি, সেখানেই সশস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে এই সব বাহিনী চলাফেরা করতো। পাকিস্তান আর্মিকে পথ ঘাট দেখিয়ে যেসব বাড়িতে, হাটে, বাজারে, মুক্তিকামী জনগণ ও মুক্তিবাহিনী থাকলে তাদেরকে দেখিয়ে দিত, তাদের হত্যা করতো, গুম করতো এবং এলাকায় সুন্দরী মেয়েদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে পৌঁছে দিতো। আমাদের অঞ্চলে চুকনগরে কয়েক হাজার মানুষকে গণহত্যা করেছিল। এরূপ গণহত্যা বাংলাদেশের সর্বত্র করা হয়েছে বলে আমি শুনেছি। এই গণহত্যা, নারী নির্যাতন, সঙ্গে লুটপাট, বাড়ি ঘরে আগুন দেয়া (আপত্তিসহ), গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া এসবই সংঘটিত  করেছে এই রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী যারা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিপে অবস্থান নিয়েছে। তাদেরকে দেশদ্রোহী বলেছে ও নিজেদেরকে দেশপ্রেমিক বলেছে। সর্বশেষ ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় মিরপুরে বুদ্ধিজীবীদের গণহারে হত্যা করেছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টা করেছে। এই স্বাধীনতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের নেতৃত্ব দিয়েছে সবচেয়ে বড় দল জামায়াতে ইসলামী এবং তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ। বড় দল ও বড় দলের নেতা হিসেবে অধ্যাপক গোলাম আযম ও তার সাথীরা যারা এই পাকিস্তানি সহযোগী তারাই এই মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে এবং তাদের মূল নেতা প্রফেসর গোলাম আযম এর নেতৃত্ব দিয়েছেন।

অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব আজ আদালতে হাজির হয়েছেন। যুদ্ধ শেষে সরকার আমাকে ডাকার পরে আমি দায়িত্ব অধীনস্থদের ওপর দিয়ে ঢাকায় আসি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে যোগদান করি। এই মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। আমি তাকে জবানবন্দী দিয়েছি।

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।