॥ মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন॥
মুসলিম মিল্লাতের দুটি ঈদের একটি ঈদুল ফিতর। সুতরাং ঈদুল ফিতর বিশ্ব মুসলিমের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহোৎসব। এটি আরবি হিজরী সনের দশম মাস তথা শাওয়াল মাসের প্রথম দিন। রমযানের বরকত লাভের জন্য ত্যাগ, কষ্ট-ক্লেশ ও আয়াস সাধ্য-সাধনার পর যে মাসটি সাফল্যের বার্তা নিয়ে আসবে, তা অবশ্যই মহান। সে মাসের প্রথম দিনই ঈদ উৎসব। ঈদুল ফিতর ওই আনন্দ উৎসবকে বলা হয়, যা রমযানের পর আসে। (ড. ইবরাহীম আনীস ও তার সাথীবৃন্দ, আল মুজামুল ওয়াসীত, ইস্তাম্বুল: আল মাকতাবুল ইসলামী তা.বি. ২/৬৯৪)।
ঈদের দিনে করণীয়
১.তাকবীর বলা
রাসূল (সা.) ঈদের দিন বেশি বেশি তাকবীর বলতেন- আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লালাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়াল্লিাহিল হামদ। হাদীসে এসেছে, তিনি ঘর থেকে ঈদগাহ পর্যন্ত তাকবীর দিতে দিতে যেতেন। (হাকিম, তালখীসুল হাবীর, পৃ. ১৪২)।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) বলেছেন, ঈদুল ফিতরের তাকবীর শুরু করবে ঈদের চাঁদ উদিত হওয়ার পর থেকেই। ঈদের সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত রাসূল (সা.) তাকবীর পাঠ করতেন।
২. গোসল করা
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন গোসল করতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৩১৫)।
৩. সুন্দর পোশাক পরিধান করা
রাসূল (সা.) ঈদের দিন সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন পোশাক পরতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বাজারে একটি রেশমী জুব্বা বিক্রি হতে দেখে তা আল্লাহর রাসূল (সা.) -এর নিকট নিয়ে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আপনি এ জুব্বাটি ক্রয় করুন। তাহলে ঈদের সময় এবং প্রতিনিধি দলের সাথে সাক্ষাতের সময় আপনি এটি পরিধান করতে পারবেন। আল্লাহ্র রাসূল (সা.) তাঁকে বললেন, হে ওমর! এ পোশাক তো কেবল তাদের জন্যই, যাদের আখিরাতে কোনো অংশ নেই। এরপর ওমর (রা.) বেশ কিছুদিন অতিবাহিত করলেন। কিছুদিন পর আল্লাহ্র রাসূল (সা.) একটি রেশমী জুব্বা ওমর (রা.) এর নিকট পাঠিয়ে দিলেন। তিনি সেটি নিয়ে আল্লাহ্র রাসূল এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আপনি তো বলেছিলেন, এ রেশমী পোশাক শুধু তাদের জন্যই, যাদের আখিরাতে কোনো অংশ নেই অথচ আপনি এ জুব্বাটি আমার নিকট পাঠিয়েছেন! আল্লাহ্র রাসূল (সা.) তাঁকে বললেন : তুমি এটি বিক্রি করে দাও এবং বিক্রির সে অর্থ দ্বারা নিজের প্রয়োজন পূরণ কর। (সহিহ বুখারী : ৯৪৮)।
৪. সুগন্ধী লাগানো
রাসূল (সা.) ঈদের দিন সর্বোত্তম খুশবু লাগাতেন। (হাকিম, ফতহুল আল্লাম ১/২২১ পৃ.)।
৫. মিষ্টিদ্রব্য বা খেজুর খাওয়া
ঈদুল ফিত্রের দিন ঈদগাহে বের হওয়ার পূর্বে মিষ্টিদ্রব্য বা খেজুর খাওয়া। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ্র রাসূল (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন ভোরবেলা প্রথমে কিছু খেজুর না খেয়ে বের হতেন না। মুরাজ্জা ইবনে রাজা উবাইদুল্লাহ সূত্রে আনাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী (সা.) তা বেজোড়সংখ্যক খেতেন। (সহিহ বুখারী : ৯৫৩)।
তবে তিনি ঈদুল আজহার দিনে সালাত না পড়া পর্যন্ত কিছু খেতেন না। (সুনানে তিরমিযী ১/৭১ পৃ.)।
৬. পায়ে হেঁটে যাওয়া
রাসূল (সা.) পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যেতেন । আলী (রা.) বলেন, সুন্নত হলো ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া। (সুনানে তিরমিযী : ৫৩০)।
৭. সাদাকাতুল ফিতর আদায়
রাসূল (সা.) ঈদের সালাত আদায় করার পূর্বেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সাদাকাতুল ফিতর (রোজার ফিতরা) হিসেবে মুসলিম দাস, স্বাধীন ব্যক্তি, নর নারী এবং বালক ও বৃদ্ধের ওপর ‘এক সা’ খেজুর কিংবা এক সা. যব নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি আরো আদেশ করেন, মানুষেরা ঈদের নামাযে উপস্থিত হওয়ার আগেই যেন তা আদায় করে দেয়। (সহিহ বুখারী : ১৫০৩)।
সালাত আদায়ের পূর্বে হলে তা ফিতরা হিসেবে গণ্য হবে। আর সালাতের পর হলে তা হবে সাধারণ দান। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, সিয়াম পালনকারীর অপ্রয়োজনীয় ও বেফাঁস কথাবার্তা থেকে তাকে পবিত্রকরণ এবং গরিব-মিসকিনদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে রাসূল (সা.) ফিতরা প্রদান করাকে ফরজ করে দিয়েছেন। অতএব যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের আগে তা পরিশোধ করবে সেটা ফিতরা হিসেবে আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে। আর ঈদের সালাতের পর দিলে তা হবে একটা সাধারণ দান খয়রাত। (অর্থাৎ তা ফিতরা হিসেবে গণ্য হবে না)। (আবু দাউদ : ১৬০৯; ইবনে মাজাহ : ১৮২৭)।
৮. এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া অন্য রাস্তা দিয়ে আসা
তিনি এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যেতেন এবং অপর রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরতেন। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা.) ঈদের দিন (বাড়ি ফেরার সময়ে) ভিন্ন পথে আসতেন। (সহিহ বুখারী : ৯৮৬)।
৯. সালাত আদায় করা
‘আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ্র রাসূল (সা.) ঈদুল আজহা এবং ঈদুল ফিতরের দিন প্রথমে সালাত আদায় করতেন, আর সালাতের পর খুতবা দিতেন। (সহিহ বুখারী : ৯৫৭)।
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহের উদ্দেশে বের হন। তারপর খুতবার পূর্বে সালাত শুরু করলেন। (সহিহ বুখারী : ৯৫৮)।
১০. ঈদের খুতবা শোনা
সালাত আদায়ের পরে রাসূল (সা.) খুতবা দিতেন এবং মুসল্লিরা মনযোগ সহকারে শুনতেন। আবদুল্লাহ ইবনে সায়িব (রা.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে ঈদের সালাত আদায় করি। সালাত শেষে তিনি বলেন, আমি এখন খুতবা দেব। যে খুতবা শুনার জন্য বসতে চায় সে বসবে, আর কেউ চলে যেতে চাইলে চলে যাবে। (সুনানে আবু দাউদ : ১১৫৫)।
১১. ঈদের দিনে মুসাফাহা ও কোলাকুলি
ঈদের দিনে ‘খাস করে’ মুসাফাহ এবং কোলাকুলি ও আলিঙ্গন করার ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে কোনো কোনো হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কোন মুসলিম ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ হলেই তাকে সালাম করতে হবে। (সহিহ মুসলিম, মিশকাত ১৩৩ পৃ.)।
মুসাফাহাও করতে পারে। যেমন আনাস (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি একদা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাদের মধ্যকার কোনো ব্যক্তি তার কোনো ভাই অথবা বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করে সে কি তার জন্য ঝুঁকতে পারে? তিনি বললেন, না। লোকটি বলল, সে কি তাকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করবে এবং চুমু দেবে। তিনি বললেন, হ্যাঁ। (তিরমিযী, মিশকাত ৪০১ পৃ.)।
এ হাদীস দ্বারা বোঝা যায় যে, যাদের সাথে সচরাচর দেখা হয়, তাদের সাথে ঈদগাহে দেখা হলে সালাম ও মুসাফাহা করা যেতে পারে। কিন্তু কোলাকুলি প্রয়োজন নেই। তবে হ্যাঁ, কারো সাথে যদি বহুদিন পর ঈদগাহে সাক্ষাৎ হয়, তাহলে তার সাথে কোলাকুলি করা যেতে পারে। যেমন একবার রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পালক ছেলে যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) কোন যুদ্ধ বা সফর থেকে ফিরে বাড়ি ঢুকলে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করেন। (তিরমিযী, মিশকাত ৪০১ পৃ.)
উক্ত সাধারণ ও ব্যাপক ভাব প্রকাশক হাদিসগুলোর ভিত্তিতে অন্যান্য দিনের মতো ঈদের দিনেও সচরাচর সাক্ষাৎকারীদের সাথে সালাম ও মুসাফাহা করা যাবে এবং বহুদিন পর সাক্ষাৎকারীর সাথে মুআনাকা বা কোলাকুলি করা যাবে।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- শাওয়াল মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
- একটি ঐতিহাসিক ঈদকার্ড
- আল্লাহর লানত থেকে বাঁচতে রমাদানে গুনাহ মাফ করাতেই হবে
- লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও মর্যাদা
- যাকাত-ফিতরা কী এবং কার জন্য
- নূহের জাহাজ
- ফিলিস্তিন
- আশরাফ জামান-এর দুটি কবিতা
- জাকির আবু জাফর-এর কবিতা
- অফুরন্ত শান্তির ঈদ
- সোনার বাংলা
- সরল পথ
- লাহাব
- জেগে ওঠো ঐক্যবলে
- আত্মবিশ্লেষণে সামাজিক উৎসব ঈদুল ফিতর
- দৃষ্টিভঙ্গি বদলান : জীবনও বদলে যাবে
- সাদকাতুল ফিতর ও ঈদ উৎসব
- সারপ্রাইজ ডে
- সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি যাকাত
- আনন্দের বারতা নিয়ে আসে ঈদুল ফিতর
- ঈদ আনন্দ আজ