॥ হারুন ইবনে শাহাদাত ॥
ঈদ উপলক্ষে বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনকে ঈদকার্ড পাঠানোর রীতি এ তথ্য-প্রযুক্তির যুগে অনেকটাই কমে গেছে। সেই স্থান দখল করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মোবাইল ফোনের খুদেবার্তা। কিন্তু কোনো কোনো ঈদকার্ড কোনো দিন হারিয়ে যাবে না। আজ এমনই একটি ঈদকার্ড ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে তুলে ধরা হলো। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর মকবুল আহমাদ (রাহ.) এ ঈদকার্ড তুলে ধরে তার কনিষ্ঠ সন্তান ঈসমাইল মুহাম্মাদ নোমানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া মন্তব্য পড়ার পর মনে হলো সাপ্তাহিক সোনার বাংলার পাঠকদের সাথে তা শেয়ার করলে তারা উপকৃত হবেন। দাওয়াতি কাজ এবং মানুষের মনে বিপ্লব সৃষ্টির যে হিকমত তিনি অবলম্বন করেছেন, তা আজও আমাদের আলোড়িত করে। বর্তমানে করছেন এবং ভবিষ্যতে যারা দাঈ ইল্লাহর মহান দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের জন্য এতে অনেক শিক্ষণীয় দিক আছে মনে করে তা তুলে ধরা হলো।
জনাব ঈসমাইল মুহাম্মাদ নোমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য কলামে লিখেছেন, তার হাতে মকবুল আহমাদ (রাহ.) কয়েকটি ঈদকার্ড দিয়ে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে তাকে পাঠান বিতরণের জন্য। তিনি তখন তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বাজারে কত সুন্দর সুন্দর ঈদকার্ড পাওয়া যায় তা না দিয়ে এটি কেন তিনি দিচ্ছেন। তখন তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘এ ঈদকার্ডের বক্তব্যগুলো পড়লে পাঠকের মনে যে বিপ্লব সৃষ্টি হবে, বাজারে ঈদকার্ডে কি তা হবে?
তার বিতরণ করা ঈদকার্ডে কী বক্তব্য থাকতো তা তুলে ধরা হলো-
কুরআন ও আপনার ঘর উপশিরোনাম দিয়ে তিনি কিছু প্রশ্ন করেছেন: ‘১. আপনার এ ঘরে কি রীতিমতো কুরআন পড়া হয়? ২. এ ঘরে বয়স্কদের কয়জন আছে যারা কুরআন পড়ে? ৩. এ ঘরে ছেলেমেয়েদের কি কুরআনের গল্প ও ঘটনা মাঝে মাঝে পড়ে শোনানো হয়? ৪. এ ঘরে কি কুরআনের আয়াত এবং এর বিধিনিষেধ সম্পর্কে কথাবার্তা হয়? ৫. এ ঘরের বয়স্ক ও ছেলেমেয়েদের কুরআনের কি পরিমাণ অংশ মুখস্থ আছে? ৬. এ ঘরের বয়স্ক ও ছেলেমেয়েদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে, যে কুরআনের অর্থ বোঝে? ৭. এ ঘরের দেয়ালে কুরআনের আয়াত ও অর্থসংবলিত কোনো পোস্টার কি লাগানো আছে? ৮. এ ঘরের পুরুষ কিংবা নারী কি কোনো দরসে কুরআনের মাহফিলে শরীক হয়? তারপর লিখেছেন, প্রশ্নগুলো একান্ত আপনার জন্য।
এরপর ‘যাদের হাতে ইসলামী সমাজ বিপ্লব হবে’ উপশিরোনাম দিয়ে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ.)-এর বক্তব্য তুলে ধরেছেন, ‘এ কাজের জন্য এমন একদল দুঃসাহসী মুমিনের প্রয়োজন, যারা সত্যের প্রতি ঈমান এনে তার ওপর পাহাড়ের মতো অটল হয়ে থাকবে। অন্য কোনো দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে না। পৃথিবীতে যাই ঘটুক না কেন, তারা নিজেদের লক্ষ্য-উদ্দেশের পথ থেকে এক ইঞ্চিও বিচ্যুত হবে না। পার্থিব জীবনে নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নতির সকল সম্ভাবনাকে অকাতরে কুরবানি করে দেবে। স্বীয় সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা ও আপনজনদের স্বপ্ন-সাধ বিচূর্ণ করতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের বিচ্ছেদ-বিরাগে চিন্তিত হবে না। সমাজ, রাষ্ট্র, আইন, জাতি, স্বদেশ যা কিছুই তাদের উদ্দেশ্য পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে তারই বিরুদ্ধে লড়ে যাবে। অতীতেও এ ধরনের লোকেরাই আল্লাহর কালেমাকে বিজয়ী করেছে। আজো এ ধরনের লোকেরাই আল্লাহর কালেমাকে বিজয়ী করবে। এ মহান বিপ্লব কেবল এ ধরনের লোকের দ্বারাই সংঘটিত হতে হবে।’
তারপর মিশকাত শরীফের একটি হাদীস উপস্থাপন করেছেন, আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার প্রতিপালক আমাকে ৯টি কাজের হুকুম দিয়েছেনÑ ১. প্রকাশ ও গোপনে সর্বাবস্থায় যেন আমি আল্লাহকে ভয় করি। ২. ক্রোধ ও সন্তুষ্টি সর্বাবস্থায় ইনসাফের কথা বলি। ৩. দারিদ্র্য ও বিত্তশালীতা যেকোনো অবস্থায়ই যেন আমি সততা ও মধ্যপন্থার ওপর থাকি। ৪. যে আমার থেকে কেটে গেছে তাকে যেন আমি জুড়ে নিই। ৫. যে আমাকে বঞ্চিত করে তাকে যেন আমি দান করি। ৬. আমার ওপর যে জুলুম করে তাকে যেন আমি মাফ করি। ৭. আমার নীরবতা যেন চিন্তায় পরিপূর্ণ হয়। ৮. আমার কথাবার্তা যেন খোদার স্মরণমূলক হয়। ৯. এবং আমার দৃষ্টি যেন শিক্ষার দৃষ্টি হয়।’
এরপর আল বাছায়ের পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আল-কুরআন ও আমরা’ শিরোনামে একটি লেখা অনুবাদ করে তুলে ধরেছেন, ‘ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্হিংহ্যাম। আমার এক বন্ধু এ শহরে বাস করেন বহুদিন ধরে। গত বছরের শুরুর দিকে লন্ডনের এক বৈঠকে তিনি একটি সুন্দর অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন। আমার বন্ধু শিক্ষকতা করেন স্থানীয় একটি সেকেন্ডারি স্কুলে। একবার তিনি তার একজন মহিলা সহকর্মীকে একখণ্ড কুরআন দিয়েছিলেন পড়ার জন্য। সপ্তাহ খানিক পর যখন ভদ্র মহিলা বন্ধুকে কুরআন মাজীদের ইংরেজি তরজমা ফেরত দিলেন, তখন এদের উভয়ের মধ্যে কুরআনের ব্যাপারে কিছু কথাবার্তা হয়েছিলÑ
বন্ধুটির তার সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলেন, গ্রন্থটি কেমন লেগেছে বলুন? ভদ্র মহিলা জবাব দিলেন, ‘চমৎকার’। নিঃসন্দেহে একটি উৎকৃষ্ট বই। বন্ধুটি মনে মনে খুশি হচ্ছিলেন, ভাবছিলেন হয়তো মহিলা এবার ইসলাম গ্রহণ করবে, এমন ধরনের একটি জিজ্ঞাসা তার সামনে পেশ করতে যাবেন এমন সময় মহিলাটি তাকে বলল, আপনাদের অন্য কুরআনটি কোথায়? আমাকে তাও একটু পড়তে দেবেন! আমার বন্ধু এবার একটু আশ্চর্যই হলেন। বললেন, ‘এ কি বলছেন আপনি! আমাদের কুরআন তো একটিই। খ্রিস্টান ও ইহুদিদের মতো, আমরা তো কুরআনকে বিকৃত করিনি। কুরআন আমাদের কাছে ‘অরিজিনাল ফর্মেই’ মজুদ রয়েছে। বুঝতে পারলাম না আপনি আরেক কুরআন বলে কী বোঝাতে চাইলেন।’
এবার ভদ্র মহিলা বললেন, ‘না আসলে তেমন কিছু নয়, প্লিজ আপনি অসন্তুষ্ট হবে না। আপনাদের এ কুরআনের কোনো বিকৃতি ঘটেছে তেমন কিছু আমি বলিনি। আসলে আমি যা বলছিলাম তা হচ্ছে, আপনি আমাকে যে কুরআন পড়তে দিয়েছেন, তা তো নিঃসন্দেহে একটি সুন্দর কিতাব, কিন্তু আমি আপনাদের সেই কুরআনটি দেখতে চাই যা আপনারা প্রাত্যহিক জীবনে ‘প্র্যাকটিস’ করেন। যে কুরআন আপনি আমাকে দিয়েছেন তা তো আপনাদের কাউকেই আমি মেনে চলতে দেখি না। আমার মুসলিম প্রতিবেশী আর খ্রিস্টান প্রতিবেশীর বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবনে কোনো তফাৎ আমি দেখতে পাইনি। এরা উভয়েই সুদের ভিত্তিতে বাড়ি কেনে। এরা উভয়েই সুদের ওপর ব্যবসা করে, মিথ্যা কথা উভয়েই পাল্লা দিয়ে বলে। জুয়ার আড্ডায় উভয়ে একত্রেই হারে-জেতে। নামায-রোজার কথা বলবেন? তাতেও এরা দু’জন সমান। কেউই মসক চার্চ এর ধারেকাছে যায় না। আপনিই বলুন, এ অবস্থায় আমার মতো একজন অমুসলিম ব্যক্তি বুঝবে কি করে যে, আপনাদের আসল কুরআন কোনটি। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম, তা নিঃসন্দেহে ভিন্ন কিছু। সে ধরনের কিছু চেয়ে আমি যদি আপনার মনে কষ্ট দিয়ে থাকি, তাহলে আমি দুঃখিত।
আমার বন্ধুটি তো এ কথা শুনে রীতিমতো হতবাক হয়ে গেলেন। কী বলবেন, ভাষায়ই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিলেতের বার্মিংহ্যাম আমাদের এখান থেকে ৭ হাজার মাইল দূরে হলেও এ কথাটি মনে হয় আমাদের অন্তরের অনুভূতি থেকে খুব দূরে নয়। আপাদমস্তক আয়নার সামনে একবার নিজেকে দাঁড় করালে অজান্তেই আমাদের মনই বলে উঠবে, আসলে আমাদের সেই ব্যবহারিক কুরআনটি কোথায়?
তাকের ওপর গিলাপে মোড়ানে কুরআন মজিদ আর ব্যবহারিক জীবনের কুরআন মাজীদ মুসলমানদের কাছে এ দুটি আলাদা নয়। মুসলমানদের কুরআন একটাই। ‘তাক’ থেকে ‘তাজ’ পর্যন্ত কুরআন একটিই। এ বিষয়টি একবার ভেবে দেখার মতো কি আমাদের সময় হবে? মনে রাখতে হবে আমাদের সবাইকে একদিন আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হবে।’
এ ঈদকার্ড বিতরণের আগে জনাব ইসমাইল মুহাম্মাদ নোমানের মনে যে দ্বীধা ছিল, তা কাটতে খুব একটা সময় লাগতো না। কারণ যাদের কাছে তিনি কার্ড পৌঁছিয়েছেন, পরদিন সবাই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতেন। তার দেয়া ঈদকার্ডটি শুধু একটি কার্ড নয়, অনেক জীবন পরিবর্তনের মতো একটি দলিল। তাদের অনেকেই তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আলোর পথের সন্ধান পেয়েছেন। আলোকিত জীবনযাপনের চেষ্টা করেছেন।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- শাওয়াল মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
- আল্লাহর লানত থেকে বাঁচতে রমাদানে গুনাহ মাফ করাতেই হবে
- ঈদের দিনে করণীয়
- লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও মর্যাদা
- যাকাত-ফিতরা কী এবং কার জন্য
- নূহের জাহাজ
- ফিলিস্তিন
- আশরাফ জামান-এর দুটি কবিতা
- জাকির আবু জাফর-এর কবিতা
- অফুরন্ত শান্তির ঈদ
- সোনার বাংলা
- সরল পথ
- লাহাব
- জেগে ওঠো ঐক্যবলে
- আত্মবিশ্লেষণে সামাজিক উৎসব ঈদুল ফিতর
- দৃষ্টিভঙ্গি বদলান : জীবনও বদলে যাবে
- সাদকাতুল ফিতর ও ঈদ উৎসব
- সারপ্রাইজ ডে
- সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি যাকাত
- আনন্দের বারতা নিয়ে আসে ঈদুল ফিতর
- ঈদ আনন্দ আজ