রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ৩য় সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ২২ চৈত্র ১৪৩০ ॥ ২৫ রমজান ১৪৪৫ হিজরী ॥ ৫ এপ্রিল ২০২৪

॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন ॥
বাংলাদেশে ভারতের ‘আগ্রাসন’র প্রতিবাদে ভারত ও ভারতীয় পণ্য বর্জনের লক্ষ্যে গত জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় প্রচারণা। এরই অংশ হিসেবে ‘ইন্ডিয়া আউট’ ও ‘বয়কট ইন্ডিয়ান প্রোডাক্টস’ শিরোনামে ফেসবুক, ইউটিউব ও এক্সে (সাবেক টুইটার) ব্যাপক প্রচারণা চলে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা এ প্রচারণায় দেশের বাজারের খুব একটা প্রভাব পড়েনি। বিশেষ করে দেশের ঈদ বাজারের কোনো প্রভাবই লক্ষ্য করা যায়নি। ক্রেতারা বলছেন, পণ্যের কোয়ালিটি (মান) ভালো হলে কোনো দেশের প্রোডাক্ট তা কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। বিক্রেতারাও প্রায় একই সুরে কথা বলছেন। তাদের ভাষ্য, কাস্টমার ভারতীয় পণ্য বলে তা বয়কট করছেন এমনটা লক্ষ করা যায়নি। তবে যে প্রোডাক্ট ভালো, তা নিতেই বেশি আগ্রহী ক্রেতারা এক্ষেত্রে দাম ও প্রস্তুতকারী দেশ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
রাজধানীর মৌচাক মার্কেটের একাধিক দোকানির সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভারতীয় পণ্য বয়কট করার লক্ষ্যে যে প্রচারাভিযান শুরু হয়েছে, তাতে দোকানে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। মৌচাকের ইশারা ফেব্রিক্সের একজন বিক্রেতা জানান, তারা এখানে সব সময়ই ভারতীয় পোশাক বিক্রি করেন, কিন্তু সম্প্রতি বিক্রি কমেনি। তিনি জানান, তাদের দোকানে ভারতীয় ছাড়াও চীনা পণ্য রয়েছে, কিন্তু দেশি পণ্যের পর ভারতীয় পণ্যই বেশি।  
একই মার্কেটের রিনি ফেব্রিক্সের কর্ণধার জানিয়েছেন, তাদের দোকানে সবসময়ই ভাতীয় পোশাক বিক্রি করা হয়, কিন্তু ভারতীয় পণ্য বর্জনের কথা শোনে কোনো ক্রেতাকে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখেননি তিনি। ‘অবন্তিকা’ নামের একটি দোকানে পণ্য কিনতে আসা একজন ক্রেতা জানিয়েছেন, তারা মূলত পয়সা দিয়ে ভালো কিছু কিনতে চান, সেটি আসলে কোন দেশে থেকে এলো তা জানা খুব জরুরি নয়। তিনি এ-ও জানান, যে পণ্যটি দেশে উৎপাদিত হয় এবং মানে ভালো আমরা আসলে সেটিই কিনতে চাই।
নীলফামারীর ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বেচাকেনা ভালো হচ্ছে। এবার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে ভারতীয় থ্রিপিস। পাশাপাশি ভারতীয় নায়রা, গারারা, সারারা, কাতান ও লেহেঙ্গা বেশি কিনছেন ক্রেতারা। তবে ক্রেতারা বলছেন, কাপড়ের দাম একটু বেশি রাখা হচ্ছে। ফলে কেনাকাটা করতে এসে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের।
তবে ব্যতিক্রমী কথা বলেছেন একই মার্কেটের আল-ফালাহ নামের একটি বিক্রয় কেন্দ্রের কর্ণধার। তিনি বলেছেন, তিনি মূলত প্রসাধনী বিক্রি করে থাকেন। জানান, একসময় ভারতীয় পণ্যের বিক্রি বেশি ছিল, সপ্তাহে ১ থেকে ২ লাখ টাকার অর্ডার পাওয়া যেত, কিন্তু এখন পাওয়া যায় ১০ হাজার টাকার অর্থাৎ ভারতের প্রসাধনীর অর্ডার কমেছে। তবে তিনি জানান, এটি কোনো সাম্প্রতিককালের তথ্য নয়, গত ১০ বছরের ব্যবধানে এ অবস্থা দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, ভালো প্রসাধনী হলে মানুষ এখন দেশের পণ্যই বেশি কিনতে চান। যদি সেটি ভালো হয়। ভারতীয় পণ্যের পাশাপাশি ইউনিলিভারের পণ্যের অর্ডারও কমেছে বলে জানান এ বিক্রেতা। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইল সন্ত্রাসীদের হামলার পর এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে।     
দেশের সবচেয়ে বড় দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতারা সম্প্রতিকালে ভারতীয় পণ্য বয়কটের পক্ষে-বিপক্ষে বক্তৃতা করছেন। ঈদুল ফিতর সামনে রেখে রাজধানীর পোশাকের বাজারে তার খুব একটা প্রভাব নেই। যথারীতিই ঈদের বাজারে যেসব পোশাক বিক্রি হচ্ছে তার উল্লেখযোগ্য একটি বড় অংশই ভারতীয়। ৩ এপ্রিল ডেমরা থানাধীন কোনাপাড়াস্থ নিউজ মার্কেটের এক দোকানীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিশু থেকে ২০ বছরের মেয়েদের পোশাকের ৫০ শতাংশই ভারতীয়, এগুলো অনেকটা ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে।
দোকানিরা বলছেন, ঈদের বাজার সামলানোর মতো পর্যাপ্ত পোশাক দেশে উৎপাদনই হয় না। রাজধানীর দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, নারী, শিশু ও পুরুষের জমকালো নকশার অধিকাংশ পোশাকই ভারতীয়। এমনকি পাকিস্তানি ব্র্যান্ডের অনুকরণে বানানো অনেক পোশাকও আসে ভারত থেকে। আর ঈদের বাজারে এগুলোর চাহিদার কমতি নেই। বিরোধীদলের পক্ষ থেকে এবং সাধারণ মানুষের ভারতীয় পণ্য বর্জন আহ্বানের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি নেতাদের স্ত্রীদের আলমারিতে যেসব ভারতীয় শাড়ি রয়েছে, সেগুলো বিএনপি নেতারা পুড়িয়ে দেখালে তবেই তিনি বিশ^াস করবেন যে, বিএনপি নেতারা ভারতীয় পণ্য সত্যিকার অর্থে বর্জন করছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর লেখালেখি চলছে। অনেকেই এ আহ্বানকে সমর্থন দিচ্ছেন, অন্যদেরও ভারতীয় পণ্য বর্জন করতে বলছেন। বিভিন্ন হ্যাশট্যাগ দিয়ে চলছে ভারতীয় পণ্য বয়কটের প্রচার। কিন্তু বাজারে এর প্রভাব পড়ছে কতটুকু? বিভিন্ন মার্কেট ও শপিংমল ঘুরে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় পোশাকের উপস্থিতি রয়েছে আগের মতোই। বেচাকেনাও কম নয়। শিশু থেকে শুরু করে ছেলে-মেয়ে সবার জন্যই ভারতীয় পোশাক রয়েছে বাজারে।
রাজধানীর কয়েকটি পোশাকের দোকানে দেখা গেল ভারত থেকে আসা ছেলেদের জমকালো নকশার অ্যামব্রয়ডারি করা পাঞ্জাবি। দেশীয় নানা ব্র্যান্ডের নামের লোগো বসালেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো ভারতীয় পোশাক। অনেক ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানই ভারত থেকে পণ্য এনে দেশের নিজেদের মনোগ্রাম লাগিয়ে দেশি ব্র্যান্ড বলেও চালিয়ে দিচ্ছে, অথচ এগুলো আসে তো ভারত থেকেই। ভারত থেকে পোশাক না আসলে আমরা ব্যবসা করব কীভাবে? এমন প্রশ্নও করেন কেউ কেউ।
বিক্রেতারা বলছেন, বয়কটের কোনো প্রভাব ঈদের মার্কেটে বেচাকেনায় নেই। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের তুলনায় সব পোশাকের দামই কিছুটা বেশি। এর প্রভাবে বিক্রি কিছুটা কম। মেয়েদের পোশাকের বাজারেও একই চিত্র। উৎসব সামনে রেখে মেয়েদের জন্য তৈরি ভারতীয় পোশাকের বিক্রি আগে থেকেই বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানি পোশাকও জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু পার্টিতে পরার উপযোগী গাউন, লেহেঙ্গা, থ্রিপিস, ঘারারা, সারারা ও শাড়ির বাজারে বাংলাদেশে ভারতের পোশাকের আধিপত্য একচেটিয়া। অন্যদিকে থ্রিপিসের জন্য অনেক তরুণীর পছন্দ পাকিস্তানি ব্র্যান্ড আগা নূরসহ আরও কিছু পোশাক। এগুলোর প্রথম বা দ্বিতীয় রেপ্লিকায় (হুবহু নকল) বাজার সয়লাব। তবে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এসব রেপ্লিকাও অনেক ক্ষেত্রেই ভারতে তৈরি।
জানা যায়, উৎসবমুখী দেশি শাড়ি ও অন্যান্য পোশাকের দাম তুলনামূলক বেশি। অন্যদিকে ভারতীয় দিল্লি বুটিকসসহ অন্যান্য ব্র্যান্ডের পোশাকের নানা মানের রেপ্লিকা ড্রেস সহজলভ্য, যেগুলোর দামও হাতের নাগালেই। ভারী নকশাসমৃদ্ধ একটি ভারতীয় থ্রিপিস পাঁচ হাজার টাকার কিছু কমবেশিতে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু একই ধরনের ভারী নকশার দেশীয় থ্রিপিসের দাম পড়ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। আবার দেশি সেই পোশাকের কাপড়ের মান নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। ক্রেতাদের অভিমত, সে তুলনায় ভারতীয় জর্জেট ও অন্যান্য সিনথেটিক কাপড় অনেক বেশি টেকসই ও ঝলমলে। সে কারণেই ঈদে ভারতীয় পোশাকই বেছে নেন অনেক ক্রেতা।
রাজধানীর অনেক শাড়ি ও লেহেঙ্গার দোকানে অধিকাংশই ভারতীয় পোশাক। দেশি শাড়ি ও লেহেঙ্গা আছে কিনা- জানতে চাইলে বিক্রেতারা জানান ‘এগুলো দেশে বানায়ই না। দেশের ৯০ শতাংশ কাপড়ই আসে ভারত থেকে। কয়টা মানুষ দেশি কাপড় কেনে? কাস্টমাররা আসে, ১০-১৫ হাজার টাকা দিয়ে জামা কিনে নিয়ে চলে যায়। কোন দেশের, জানতেও চায় না অনেক সময়।’
মিরপুর এক নম্বর মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটে পোশাক ক্রয় করতে আসা এক নারী জানান, তিনি তার ও স্বজনদের সন্তানের জন্য পোশাক ক্রয় করেছেন, ক্রয়কৃত পোশাকের অধিকাংশই ভারতীয়।
মেয়ের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের জন্য পোশাক কয় করতে রাজধানীর শনির আখড়ার আরএস মার্কেটে আসা এক নারী জানান, তিনি যা ক্রয় করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারতীয়, দাম ও মনের সমন্বয় করতে গিয়ে তিনি এসব পণ্য কিনেছেন।
বয়কট নয়, নিজেদের পছন্দেই দেশীয় পোশাক কিনে থাকেন অনেক ক্রেতা। তারা বলছেন, গরমে পরার জন্য দেশি সূতি, সিল্ক ও খাদি কাপড়ই আরামদায়ক। তাদের অনেকে ঝলমলে ও ভারী কাজের নকশাদার পোশাকের বদলে হালকা নকশার পোশাক পছন্দ করেন। রোজার শুরু থেকেই আড়ং, ইয়েলো, ইনফিনিটি, লা রিভের মতো দেশি ব্র্যান্ডের শো-রুমগুলোয়ও যথেষ্ট কাস্টমার আসেন।
নামকরা ভারতীয় পোশাকের প্রতিষ্ঠান রেমন্ডের বাংলাদেশের অন্যতম এজেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সাম্প্রতিককালে ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে প্রচারণা চলছে, এতে করে পণ্য বিক্রি কমেনি। তবে সামগ্রিকভাবে বিক্রি আগের তুলনায় কম। তবে ঠিক কী পরিমাণ পণ্য ঈদ মার্কেটে এসেছে, তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।



অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।