সংবাদ শিরোনামঃ

তুরস্কে জনতার বিজয় ** এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্কের জনগণ রুখে দিল সেনা অভ্যুত্থান ** সঙ্কট নিরসনে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ** ২০ দলীয় জোট ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র ** তুর্কী গণপ্রতিরোধে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান ** রফতানি বাণিজ্যের নতুন চ্যালেঞ্জ : রাজনৈতিক অস্থিরতা ** মানবতাবাদী বিশ্ব ও সন্ত্রাসবাদী বিশ্বের মাঝখানে মুসলমানদের দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে ** সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে সবার ঐক্য : নজরুল ইসলাম খান ** তুর্কী জনগণকে অভিনন্দন ** জাতীয় স্বার্থ বনাম হুকুম তামিল করার দৌড়ঝাঁপ ** এ শিক্ষা আমাদের কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ** দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজেও হরিলুটের অভিযোগ ** দুর্ভোগের আরেক নাম পাইকগাছার কপিলমুনি শহর ** কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক সঙ্কট : সেবা কার্যক্রম ব্যাহত ** কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা ** ইসলামী সংস্কৃতির আলোকেই হোক ঈদ আনন্দ ** বাংলা ভাগের জন্য মুসলমানরা নন হিন্দুরাই দায়ী ** কবির বিশ্বাস ** সানজিদা তাহসিনা বেঁচে থাকবে সবার মাঝে ** জাতির নিকট রেখে গেলেন অনেক প্রশ্ন **

ঢাকা, শুক্রবার, ৭ শ্রাবণ ১৪২৩, ১৬ শাওয়াল ১৪৩৭, ২২ জুলাই ২০১৬

অধ্যাপক মিজানুর রহমান
২৩ জুন উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক দিন। এ বেদনা কেবল পরাজয়ের বেদনা নয়। আজ থেকে ২৫৭ বছর আগে এদিনে উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সূত্রপাত হয়েছিল ব্রিটিশ বেনিয়াদের শাসন শোষণের দীর্ঘ ইতিহাস।

হাজার বছরের স্বাধীনতা পলাশীর আম্রকাননে পদদলিত হয়েছিল সেদিন। প্রায় দু’শ বছরের জিল্লতি ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল স্বাধীন বাংলার জনগণ। অগ্রগতি ও স্বাধীনতর প্রতীক বাংলা, বিহার, উরিষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন সেদিন। পলাশীর পরাজয় কেবল একজন নবাবের পরাজয় নয়, বরং সে পরাজয় গোটা উপমহাদেশের পরাজয়। নবাব সিরাজের পতনের সাথে সাথে পতন হয়েছিল আমাদের ভাগ্যের, সম্মানের, স্বাধীনতার। আমাদের ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। শুরু হয়েছিল শোষণ, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভীষিকাময় ইতিহাস। তাই এ দিনটি মহাশোকের দিন।

পলাশীর আগে

নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য দৌহিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলার মসনদ অলংকৃত করেন (১৭৫৬)। নবাব আলীবর্দী খান তার নবাবী আমলের (১৭৪০-১৭৫৬) শেষ দিকে বার্ধক্য, রোগ ও আহমদ শাহ আবদালীর ভারত আক্রমণের সম্ভাবনা ইত্যাদি কারণে বীরোচিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হন। এমনকি ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানিকে ক্ষুব্ধ করতে চাননি বিধায় তিনি ইংরেজদেরও অনেক অযৌক্তিক দাবি মেনে নিয়েছিলেন।

কিন্তু নবাব সিরাজ ছিলেন দেশপ্রেমিক, স্বাধীনচেতা টগবগে যুবক। তিনি ছিলেন ধিরস্থির চিত্ত, দূরদর্শী এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ত্বরিৎকর্মা। নবাবের চরিত্রের ব্যাপারে কতিপয লেখকের ইতিহাসে যে কদর্যতা দেখা যায় তা তথ্য নির্ভর নয়। বরাবরই বিজিতদের ইতিহাস লেখা হয়েছে বিজয়ীদের পৃষ্ঠপোষকতায়। আর সে ইতিহাসে সব সময়ই দেখা যায় বিজয়ীরা মহানুভব আর বিজিতরা দুরাচারী। নবাব সিরাজের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। শুরুতেই নবাব দক্ষতার সাথে ক্ষিপ্রগতিতে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ নিরসন করেন। ঘষেটি বেগম ও শওকত জং’র বিদ্রোহ দমন করতে তিনি একটুও বিলম্ব করেননি।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময় ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির আচরণ ও ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে যায়। নওয়াজেশ মুহাম্মদের দেওয়ান, অর্থ আত্মসাৎকারী রাজভল্লভকে নবাব যখন তলব করেন তখন রাজভল্লভের পুত্র কৃষ্ণভল্লভ আদায়কৃত রাজস্ব ও অবৈধভবে অর্জিত যাবতীয় ধনসম্পদসহ গঙ্গাস্নানের ভান করে পালিয়ে গিয়ে ১৭৫৬ সালে কোলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয় গ্রহণ করে। সিরাজউদ্দৌলা ধনরতœà¦¸à¦¹ পলাতক কৃষণভল্লভকে তার হাতে অর্পণ করার জন্য কোলকাতার গভর্নর ড্রেককে আদেশ করেন। হিন্দুপ্রধান মাহতাব চাঁদ প্রমুখ অন্যান্য হিন্দু বনিক ও বেনিয়াদের পরামর্শে ড্রেক সিরাজউদ্দৌলার আদেশ পালন করতে অস্বীকার করেন। দেশের আইনে অপরাধীগণ শাস্তি এড়াবার জন্য কোম্পানির জমিদারীর অধীনে আশ্রয় লাভ করতে থাকে। চোরাচালানের অপরাধে দোষী রামকৃষ্ণ শেঠ নামক জনৈক ব্যবসায়িকে কোম্পানি আশ্রয় দান করে এবং কৃষ্ণভল্লভের মতো তাকেও নবাবের হাতে সমর্পণ করতে কোম্পানি অস্বীকার করে। এমনি নবাবের আরো বহু আইনসম্মত নির্দেশ তারা লঙ্ঘন করে।

এভাবে কোম্পানি অপরাধী, চোরাচালানকারী ও দেশদ্রোহীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এবং নবাবের নির্দেশ অমান্য করে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধ করে।

ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি দেশের প্রতিরক্ষা আইন অমান্য করে কোলকাতায় একটি সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করে।

এছাড়া তারা ব্যবসায় চুক্তি ভংগ করে, অসদুপায় অবলম্বন করে এবং ব্যবসা কর ফাঁকি দিয়ে সরকারের প্রভূত আর্থিক ক্ষতি সাধন করে।

উপরোক্ত তিনটি প্রধান কারণে সিরাজউদ্দৌলা উপলব্ধি করলেন ইংরেজদের আর এদেশে থাকার অনুমতি দেয়া যেতে পারে না। হুগলির জনৈক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী খাজা ওয়জেদকে দেয়া পত্র থেকে নবাব সিরাজউদদৌলার এ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।

সিদ্ধান্ত গ্রহণে নবাব এতটুকু বিলম্ব করেননি। ৩ জুন ১৭৫৬ নবাব সিরাজ কাশিম বাজারস্থ ইংরেজদের কারখানা দখল করে একটা মীমাংসায় উপনীত হবার জন্য কোম্পানিকে চাপ দেন। এ অভিযানে নবাব অভূতপূর্ব উদারতা ও সততার পরিচয় দেন। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় আসার জন্য বারবার পত্র লেখেন। ইংরেজরা শান্তির পথ বেছে না নিয়ে যুদ্ধের পথ বেছে নেয়। নবাব যথেষ্ট উদারতা দেখান এবং সময়ক্ষেপণ করেন। পরবর্তী সময়ের এ উদারতা ও সময়ক্ষেপণ নবাবের পরাজয় ত্বরান্বিত করে।

এর পরের ইতিহাস বড়ই করুণ এবং ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতায় ভরপুর। কোলকাতার শাসনভার নবাব পরম বিশ্বাসে যে মানিক চাঁদের উপর অর্পণ করেছিলেন সে মানিক চাঁদ বিশ্বসঘাতকতা করে পর্যায়ক্রমে কোলকাতা ও হুগলী ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়। নবাবকে দেয়া জর্জ পিগটের ঔদ্ধত্যপূর্ণ চিঠিটিও সম্ভবত মানিক চাঁদ পৌঁছায়নি। পৌঁছালে নবাব যথাসময়ে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারতেন। 

১৫ ডিসেম্বর ১৭৫৬ ক্লাইভ কোলকাতায় পৌঁছে মানিক চাঁদকে গাদ্দারির জন্য ধন্যবাদ পত্র প্রদান করেন। উত্তরে মানিক চাঁদও ক্লাইভের আগমনে অভিবাদন ও আনন্দ প্রকাশ করে। উপরন্তু গোপন তথ্য আদান প্রদান করার জন্য সে রাধাকৃষ্ণ নামক এক ব্যক্তিকে ক্লাইভের নিকট প্রেরণ করে। বাংলার বিরুদ্ধে বাঙালির এর চেয়ে অধিকতর বিশ্বাসঘাতকতা আর কি হতে পারে?

এর পরের ইতিহাস আরো বেদনাদায়ক। ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭ নবাব শান্তির প্রত্যাশায় কোম্পানির সাথে এক অসম্মানজনক সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। ইতিহাসে তা ‘আলীনগরের সন্ধি’ বলে খ্যাত। অপরদিকে ধূর্ত ক্লাইভের নিকট এ সন্ধি ছিল একটা সাময়িক প্রয়োজন মাত্র এবং যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য সময়ক্ষেপণ। ফরাসিদের ব্যাপারে ইংরেজদের অন্যায় ও  যৌক্তিক দাবিকে প্রতিহত করার জন্য নবাব সেনাপতি নন্দকুমারকে নির্দেশ দেন। ক্লাইভ দশ-বার হাজার টাকা উৎকোচ দিয়ে নন্দকুমারকে হাত করে। সে  একই পন্থায় গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানকেও বশ করে। হিন্দু শেঠ ও বেনিয়ারা এবং নবাবের নিমকহারাম কর্মচারীরা, যারা মনেপ্রাণে মুসলিম শাসনের অবসান কামনা করে আসছিল, নবাবকে সদাসর্বদা কুপরামর্শই দিতে থাকে। তারা উপদেশ দেয়, ইংরেজদের কিছুতেই রুষ্ট করা ঠিক হবেনা। আহমদ শাহ আবদালির বিহার সীমান্তে উপনীত হবার মিথ্যা সংবাদ দিয়ে তারা নবাবের দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে  প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। এমনকি তারা নবাবকে ইংরেজদের পরিবর্তে বিহার রক্ষার্থে বিরাট সৈন্যবাহিনী প্রেরণেরও কুপরামর্শ দেয়। এভাবে তারা ইংরেজদের অগ্রগতির  পথকে সুগম করে দেয়।  সন্ধি চুক্তিকে উপেক্ষা করে ৫ মার্চ ইংরেজদের যুদ্ধ জাহাজ ’কাম্বারল্যান্ড’ সৈন্য সামন্তসহ কোলকাতা আসে। ৮ মার্চ ক্লাইভ চন্দরনগর অবরোধ করে। এত কিছুর পরও তারা নবাবের উপর আলীনগর চুক্তি লংঘনের অভিযোগ তুলে ২৩ এপ্রিল নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। একটি স্বাধীনদেশে নবাবের অনুমতি নিয়ে ব্যবসা করতে আসা বিদেশী বনিকদের এ কি ঔদ্ধত্য? কতবড় ষড়যন্ত্র !

এ ষড়যন্ত্রে যারা সহযোগিতা করেছিল তারা কারা? তারা বিদেশী নয়, তারা স্বজাতীয়, নবাবের বিশ্বাসভাজন (!)লোক। ক্লাইভ সিরাজউদ্দৌলার তথাকথিত আপন লোক রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ ও জগতশেঠ ভ্রাতৃবৃন্দের সাথে ষড়যন্ত্র করে নবাবের বেতনভোগী কর্মচারী মীর জাফরকে নবাবের স্থলাভিসিক্ত মনোনীত করে। ইংরেজ ও মীর জাফরের মধ্যে দেশ বিক্রির সকল বিষয় চূড়ান্ত হয়। তার সামান্য নমুনা দেখুন- চুক্তিতে মীর জাফর স্বীকৃত হয় ক্ষতিপূরণ বাবদ কোম্পানিকে দিতে হবে এক কোটি টাকা, ইউরোপীয়ানদের  পঞ্চাশ লক্ষ, হিন্দু প্রধানদের বিশ লাখ এবং আরমেনিয়ানদের সাত লাখ টাকা। মীর জাফরের আর ত্বর সইছিল না। সে পরিকল্পিত বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার জন্য ক্লাইভকে আরো বায়ান্ন লাখ টাকা পুরস্কার স্বরূপ দিতে সম্মত হয়। উমিচাঁদ হীনম্মন্যতার আরো এক ধাপ নিচে নামে। সে নবাবের সম্পদের শতকরা পাঁচ ভাগ দাবি করে বসে। অন্যথায় সকল সড়যন্ত্র ফাঁস করে দেবার হুমকি দেয়। ক্লাইভ উমিচাঁদকে খুশি করার জন্য ওয়াটসনের জাল স্বাক্ষরসহ এক দলিল তৈরি করে, এভাবে শঠতার ইতিহাসে ক্লাইভ নিজেকে চিরস্মরণীয় করে রাখে।

ক্লাইভ, নবাবের উপর  আলীনগর চুক্তি  লংঘনের মিথ্যা অভিযোগ তুলে মুর্শিদাবাদ অভিমুখে তার সৈন্য প্রেরণ করে। সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ সৈন্যদের মোকাবেলা করেন। নবাবের সৈন্য পরিচালনার ভার ছিল মীর জাফর, রায়দুর্লভ প্রভৃতির উপর। ইংরেজদের এ কেনা গোলামরা চরম মুহূর্তে সৈন্য পরিচালনা থেকে বিরত থাকে। বিশ্বাসঘাতকতার জন্য নবাবের বিশাল বাহিনীর সুনিশ্চিত জয়, পরাজয়ে রূপান্তরিত হয়। তাই পলাশী যুদ্ধ নয়, পলাশী একটি নাটক, একটি প্রহসন। সিরাজের হত্যার মাধ্যমে নিমকহারামদের অন্তিম ইচ্ছা পূরণ হয়।

পলাশীর পরে

পলাশীর পরের ইতিহাস আরো ভয়াবহ। এ ইতিহাস শোষণ, নির্যাতন আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের। ১৭৭৬ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোক প্রাণ হারায়। দুর্ভিক্ষ যখন চরমে পৌঁছে তখন পূর্বের বছরের তুলনায় ছয় লাখ টাকার অধিক রাজস্ব আদায় করা হয়, বাংলা বিহার থেকে পরবর্তী বছর অতিরিক্ত চৌদ্দ লাখ টাকা আদায় করা হয়। মানবতার প্রতি এর চেয়ে অধিক নির্মমতা ও পৈশাচিকতা আর কি হতে পারে? 

ঐতিহাসিকরা মোটামুটি হিসাব করে বলেছেন, ১৭৫৭ থেকে ১৭৮০ সাল পর্যন্ত মাত্র তেইশ বছরে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে চালান হয়ে গেছে প্রায় তিন কোটি আশি লাখ পাউন্ড অর্থাৎ সমকালীন মূল্যের ষাট কোটি টাকা।

মুসলমানদের সামাজিক অবস্থা হয়ে পড়েছিল আরো শোচনীয়। লাখেরাজ সম্পত্তি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষা মুখ থুবড়ে পড়ে। লাখ লাখ শিক্ষক কর্মচারী বেকার হয়ে পড়ে। ‘সূর্যাস্ত আইনের’ আওতায় ইংরেজ বিদ্বেষী ও ইংরেজি ভাষা না জানা এ দেশের সহজ সরল মানুষেরা পথের ভিখারীতে পরিণত হয়। নীল চাষ ও ম্যানচেস্টারের বস্ত্রশিল্পের সয়লাবে এ দেশের কৃষক ও তাঁতীরা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। তাঁতীদের দুঃখ দুর্দশার করুণ চিত্র এঁকেছেন পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহেরু, তিনি বলেন, “এসব তাঁতীদের পুরানো পেশা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। নতুন কোন পেশার দ্বার উম্মুক্ত ছিলনা, উম্মুক্ত ছিল শুধু মৃত্যুর দ্বার।......ভারতের পথ ঘাট পূর্ণ হয়েছে তাঁতীদের অস্থিতে।”- ( J.Nehru: The Discovery of India, p-352)। হ্যাস্টিংসের ভূমি ইজারা দান নীতি ও কর্নওয়ালেসের চিরস্থায়ী বন্দবস্তের ফলে হিন্দুরা মুসলমান জমিদারদের স্থান দখল করে। ফারসীর পরিবর্তে  ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণায় ইংরেজ  সংস্কৃতি বিদ্বেষী মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষা ও কর্মসংস্থানে একেবারে পিছিয়ে পড়ে। অপরদিকে ইংরেজদের এ দেশীয় দালালচক্র এ শূন্যপদগুলো পূরণ করে। নীলচাষ ও রাজস্ব আদায়ে ইংরেজরা স্মরণাতীতকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি  মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। আমাদের হাজার বছরের লালিত সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদেশী অপসংস্কৃতির ছোঁয়ায় এবং “ভাগ কর ও শাসন কর” নীতির কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। পরনির্ভরশীল আত্মমর্যাদাহীন একটি গোলামের জাতিতে পরিণত হয় বাংলার জনগণ। এ গোলামী থেকে মুক্ত হতে আমাদের লেগে যায় দীর্ঘ ১৯০ বছর। পলাশী নামক প্রহসনই জাতিকে এ গোলামী উপহার(!) দেয়। বিশ্বাসঘাতকতা, পরাধীনতা ও শোষণের ইতিহাসে পলাশী এক নতুন সংযোজন।

বেদনাবিধুর নির্মম পলাশী আমাদের কি শেখায়? আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই বহিঃশত্রুর আক্রমনের পথকে সুগম করে। তাই জাতীয় অনৈক্য ও জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করার চেষ্টা কখনও জাতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। পলাশী আমাদের শত্রু মিত্র চিনতে শেখায়। পলাশী গাদ্দারদের ব্যাপারে সতর্ক হতে শিক্ষা দেয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি, বাণিজ্যনীতি কেমন হওয়া উচিত তাও পলাশী আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তাই নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ও জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী বাণিজ্যচুক্তি সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার কুফল অত্যন্ত সদূরপ্রসারী । এর অভিশাপ হতে মুক্ত হতে  কয়েক শতক লেগে যেতে পারে । বিলীন হতে পারে আপন ভাষা, সংস্কৃতি, তাহযিব ও তমুদ্দুন; ভূলুণ্ঠিত হতে পারে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসতে পারে সাম্রাজ্যবাদ ও নব্য উপনিবেশবাদ। তাই সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের রং মাখানো চোরাবালিতে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দলেরই পা দেয়া উচিত নয়। ইতিহাসের একটি বড় শিক্ষা হলো মানুষ ইতিহাস পড়ে, জানে কিন্তু ইতিহাস হতে শিক্ষা নেয় না। তাই মানব ইতিহাসে বারংবার একই ভুলের পূনরাবৃত্তি দেখা যায়। আমরা আর কোন পলাশী চাই না।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

নির্বাহী সদস্য, বরিশাল সংস্কৃতিকেন্দ্র

e-mail: mizan.econ@gmail.com

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।