ডাকাতদের অভয়াশ্রম কুষ্টিয়া

কুদরতে খোদা সবুজ, কুষ্টিয়া : কুষ্টিয়ায় আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে ডাকাতির ঘটনা। ডাকাতদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে কুষ্টিয়া। জেলায় ডাকাতদের এতটাই আধিক্য যে সড়ক-মহাসড়কে এমনকি নিজ বাড়িতেও নিরাপদ নয় মানুষ। দিনে যেমন তেমন রাত নামলেই ডাকাতদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় কুষ্টিয়া। কুষ্টিয়ায় সন্ধ্যা নামলেই শুধুমাত্র ডাকাতির ভয়ে বিভিন্ন সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে  যায়। বিশেষ করে রাতে কুষ্টিয়া-মেহেরপুর মহাসড়ক সম্পূর্ণভাবে অরক্ষিত থাকে। রাতভর এ সড়কটি নিয়ন্ত্রণে থাকে ডাকাতদের। আবার অবাক করা বিষয় হলো- কুষ্টিয়ায় ডাকাতির অবাধ বিচরণের ক্ষেত্র হাওয়ায় মিরপুর উপজেলায় ডাকাতির পুষকুনি নামে একটি স্থানের নামকরণও রয়েছে। এদিকে সড়ক পথের মতো নিজ বাড়িতেও নিরাপদ নয় মানুষ। ডাকাতরা বিভিন্ন সময় বাড়ির লোকজনকে আহত বা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে লুটে নেয় নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল ফোন সেটসহ দামি জিনিসপত্র। ডাকাতের হামলায় নিহতের ঘটনাও ঘটেছে কুষ্টিয়ায়। তবে ডাকাতি প্রতিরোধে প্রশাসন তেমন কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দিন দিন বেড়েই চলেছে। দুর্র্ধর্ষ এসব ডাকাতির ফলে সব সময় ভয় ভীতির মধ্যে থাকে এ অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ। সর্বশেষ গত ৩০ আগস্ট শনিবার রাত ৯টার দিকে কুষ্টিয়া-মেহেরপুর মহাসড়কের খলিসাকুণ্ডি মাঠের মধ্যে একদল ডাকাত যাত্রীবাহী বাসে বোমা হামলা চালায়। এতে বাসের ১০ যাত্রী আহত হয়।

জানা যায়, মেহেরপুর অভিমুখী একটি যাত্রীবাহী বাস ওই মাঠের মধ্যে পৌঁছালে ডাকাত দল (সিলেট-জ-১১-০৭-৫৫) পর পর চারটি বোমা হামলা চালায়। এতে বাসের গ্লাস ভেঙ্গে যায় এবং পুড়ে যায়। এতে অন্তত ১০ জন আহত হয়। গত ৩০ আগস্ট একইদিন শনিবার রাত ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত ঘণ্টাব্যাপী কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী মহাসড়কের পাকশী লালন শাহ সেতুর পশ্চিম প্রান্তে গাছ ফেলে বিভিন্ন যানবাহনে গণডাকাতির ঘটনা ঘটে। লালন শাহ সেতুর টোল প্লাজার অ্যাপ্রোচ সড়কে এ ঘটনা ঘটে। ডাকাতদল প্রকাশ্যে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে যানবাহনের যাত্রীদের কাছ থেকে নগদ টাকাসহ বিভিন্ন মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। গত ২৫ আগস্ট সোমবার সকালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের শেহালা মাঠ থেকে আন্তঃজেলা ডাকাত দলের সদস্য শহিদুল ইসলাম ফিদার (৪০) গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের শেহালা মাঠের মধ্যে আন্ত:জেলা ডাকাত দলের অন্যতম সদস্য শহিদুল ইসলাম ফিদারের লাশ পড়ে থাকতে দেখে এলাকাবাসী পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। শহিদুল ইসলাম উপজেলার ফিদা শেহালা গ্রামের পচার ছেলে। উল্লেখ্য, ফিদার মৃত্যুর প্রায় এক সপ্তাহ পূর্বে সে গাংনী উপজেলায় ডাকাতি করতে গিয়ে নিজের কাছে রাখা বোমা বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয় বলে পুলিশ জানায়। তার বিরুদ্ধে দৌলতপুর ও গাংনী থানাসহ বিভিন্ন থানায় ডাকাতি, সন্ত্রাসী হামলা ও চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধে একাধিক মামলা ছিল। গত ৪ জুলাই বুধবার রাত পৌনে ২টার দিকে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুণ্ডি দর্গাপড়া এলাকার মাসুম  আলী নামে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে ডাকাতরা বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। দুর্বৃত্তরা দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। গত ২৩ জুলাই বুধবার ভোরে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুণ্ডি বাজার এলাকায় এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাঁদার দাবিতে ৪টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় একদল ডাকাত। গত ৩ জুন রোববার রাত ২টার দিকে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুণ্ডি শ্যামপুর সড়কে সংস্কার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের ওপর মুখোশধারী ডাকাতদল  বোমা হামলা চালায়। এ  সময় মারধরে ১০ শ্রমিক আহত হন। ওইদিন রাতে ২৫-৩০ জন মুখোশধারী ডাকাত দল খলিসাকুণ্ডি বাসস্ট্যান্ড বাজারে শ্রমিকদের লক্ষ্য করে ৭টি বোমা ছুঁড়ে মারে। বোমার আঘাতে ১০ শ্রমিক আহত হন।

গত ১০ মে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় বিদেশী পিস্তলসহ আন্তঃজেলা ডাকাত মোফাজ্জেল হোসেন মোফাকে (৩৮) আটক করে পুলিশ। উপজেলার চাঁদগ্রাম এলাকার সোনাউল্লাহর মোড় এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতির সময় তাকে আটক করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে আমেরিকান তৈরি সেভেন পয়েন্ট সিক্সফাইভ উদ্ধার করা হয়। সে দৌলতপুর উপজেলার গরুরা ঠাকুরপাড়া গ্রামের মসের মণ্ডলের ছেলে। গত ১২ মে সোমবার ভোর ৪টার দিকে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুণ্ডি গ্রামে বিএনপি নেতার বাড়িতে ডাকাতরা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। উপজেলার খলিসাকুণ্ডি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সার ব্যবসায়ী মহসিন আলীর বাড়িতে ২টি ককটেলের বিষ্ফোরন ঘটায়। গত ২৯ মে বুধবার রাত ২টার দিকে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ৪টি বাড়িতে দুর্র্ধর্ষ ডাকাতি সঙ্ঘটিত হয়। এসময় পরিবারের সদস্যদের ডাকাতদল অস্ত্রের মুখে আটক রেখে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুট করে নিয়ে যায়। ডাকাতদের হামলায় আজম আলী ও বাবলু শেখ নামে দুই গৃহকর্তা আহত হয়। ওই ৪টি বাড়ির গৃহকর্তারা দাবি করেন নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে ৪ লাখ টাকার মালামাল ডাকাতি করে নিয়ে যায় ডাকাত দল। গত ১৩ মার্চ বৃহস্পতিবার রাত ৯ টার দিকে কুষ্টিয়ার মিরপুরে মিলন কুমার কর (৪২) নামে এক কাপড় ব্যবসায়ী হত্যা করে ডাকাতরা। উপজেলার মিরপুর-দৌলতপুর সড়কের ডাকাতি পুস্কুনী  এলাকায় তামাক ক্ষেতের মধ্যে মিলনকে হত্যা শেষে তার মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা ডাকাতি করে নিয়ে যায়। নিহত মিলন কর কুষ্টিয়া মিলপাড়ার বাসিন্দা ও শহরের বড় বাজারের মডার্ণ ক্লথ স্টোরের মালিক। গত ৮ মার্চ শনিবার দিবাগত রাত সোয়া ১২টার দিকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার মহারাজপুর গ্রামের পাশাপাশি ৪টি বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সশস্ত্র ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে ওইসব বাড়ি থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কারসহ ৩ লক্ষেরও বেশি টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ সময় ডাকাতদের অস্ত্রের আঘাতে ১জন আহত হয়। গত ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার ভোরে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ডাকাতরা বোমা হামলা, বাড়ি-ঘর ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এ ঘটনায় ৩ জন আহত হয়। উপজেলার কামালপুর ও চরসাদীপুর গ্রামে পৃথক  এসব ঘটনা ঘটে। গত ১৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার ভোরে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে সশস্ত্র ডাকাত দল হামলা চালিয়ে আজিজুল বক্স (৫৫) নামে এক কৃষককে হত্যা করে। নিহত কৃষক আজিজুল বক্স একই গ্রামের মৃত খেদের বক্সের ছেলে। এসময় তার স্ত্রী রমেনা খাতুন (৪৫) ও বোন জাইমা খাতুনকে (৫২) আহত করে হাল চাষের একজোড়া গরুসহ ৩টি গরু লুট করে নিয়ে যায়। একের পর এক ডাকাতির ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে এলাকাবাসী। অথচ পুলিশ এসব ডাকাতির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করতে পারছে না। মাঝে মধ্যে ২-১জন গ্রেফতার হলেও আইনের দুর্বল ধারার কারণে দ্রুত ছাড়া পেয়ে আবারও ডাকাতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।  বিভিন্ন সময়ে এসব ডাকাতের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান চালানো হলেও খুব বেশি ফল আসছে না।