ভোট দেবেন কাকে?


২৪ অক্টোবর ২০২৫ ১০:১১

॥ প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী ॥
ইদানীং এমন প্রশ্ন প্রায়ই শোনা যায়; বিশেষ করে টকশোগুলোয়। সেক্যুলারিজমে (ধর্মনিরপেক্ষতা) বিশ্বাসী দল বা ব্যক্তি জামায়াত-শিবির ও ইসলামপন্থী দলগুলোর বিপক্ষে এমন কথা প্রায়ই বলে থাকেন। কে জান্নাতে যাবে আর কে জাহান্নামে যাবে- এর সমাধান মহান আল্লাহপাকের হাতে। তবে আল্লাহপাক জান্নাতে যাওয়ার পথ ও জাহান্নামে যাওয়ার পথ তাঁর প্রদত্ত কিতাব আল কুরআন ও প্রেরিত রাসূল মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে সবিস্তারে বলে দিয়েছেন। আল্লাহপাক এখানে কোনো অস্পষ্টতা রাখেননি। আমরা কুরআন-হাদিসের আলোকে বিষয়টি যাচাই করি।
আল্লাহপাক এ পৃথিবীতে মানুষকে তাঁর খলিফা হিসেবে পাঠিয়েছেন। খলিফার দায়িত্ব হলো আল্লাহপাক প্রদত্ত নিয়মকানুন নিজে মেনে চলার সাথে সাথে সকল সৃষ্টি যাতে মানে তার ব্যবস্থা করা। এ পৃথিবীতে আসার সময় আদম (আ.) ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং সেসময়ে আল্লাহপাক তাঁকে অভয়বাণী শুনিয়েছিলেন, ‘আমরা বললাম, তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। এরপর যখন আমার পক্ষ থেকে কোনো হেদায়াত তোমাদের কাছে পৌঁছাবে, তখন যারা আমার সেসব হেদায়াত অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় ও দুঃখ থাকবে না’। সূরা বাকারা : ৩৮। আদম (আ.) ছিলেন প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী এবং যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূলের আগমন ঘটেছে। শেষ নবী হলেন আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ সা.।
আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে এ পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল এসেছেন সকলের দায়িত্ব একই ছিল এবং তা হলো আল্লাহর জমিনে তাঁর দীন প্রতিষ্ঠিত করা। আল্লাহর বাণী, ‘তিনি তোমাদের জন্য দীনের সেসব নিয়মকানুন নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং (হে মুহাম্মদ!) যা এখন আমি তোমার কাছে অহির মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহিম, মূসা ও ঈসাকে। তার সাথে তাগিদ করেছিলাম এই বলে যে, দীন কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে মতপার্থক্য সৃষ্টি করো না’। সূরা আশ শুরা ১৩। দীন কায়েমের প্রশ্নে কোনো মতপার্থক্য আল্লাহপাক মেনে নেবেন না। আল্লাহপাক সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ সা.-কে পাঠিয়েছেন একই নির্দেশ দিয়ে এবং কুরআন মাজিদের তিন জায়গায় তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। সূরা তওবার ৩৩নং আয়াতে বলেছেন, ‘তিনি আপন রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য-সঠিক জীবনব্যবস্থা (দীনে হক) দিয়ে পাঠিয়েছেন- যাতে সকল জীবনব্যবস্থার ওপর একে বিজয়ী করে দিতে পারেন, মুশরিকদের কাছে তা যতই অসহনীয় হোক।’ সূরা ফাতাহর ২৮নং আয়াতে একটু ভিন্নভাবে বলেছেন, ‘তিনি আপন রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য-সঠিক জীবনব্যবস্থা (দীনে হক) দিয়ে পাঠিয়েছেন- যাতে সকল জীবনব্যবস্থার ওপর একে বিজয়ী করে দিতে পারেন, আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট’। আর সূরা সফের ৯নং আয়াতে পুনরাবৃত্তি করেছেন, ‘তিনি আপন রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য-সঠিক জীবনব্যবস্থা (দীনে হক) দিয়ে পাঠিয়েছেন- যাতে সকল জীবনব্যবস্থার ওপর একে বিজয়ী করে দিতে পারেন, মুশরিকদের কাছে তা যতই অসহনীয় হোক।’
কালেমা তাইয়্যেবাকে বুঝে-শুনে বিশ্বাস করলে একজন মুসলিমকে একই সাথে তাগুতকে মানা এবং আল্লাহকেও মানা সম্ভব নয় এবং আল্লাহপাক এ শিরক কখনো ক্ষমা করবেন না, বরং তাগুতকে পরিপূর্ণ অস্বীকার করে কেবল আল্লাহকেই মানতে হবে। আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো’। সূরা নহল : ৩৬। কালেমা তাইয়্যেবা বিশ্বাসী একজন ব্যক্তি বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে ঘাস-লতা-পাতা খেয়ে জীবনধারণ করতে পারে কিন্তু একটি মুহূর্তও সে তাগুতের অধীন সন্তুষ্ট জীবনযাপন করতে পারে না। বসবাস করতে পারে একটি শর্তে, সে তাগুতকে সরিয়ে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাবে। যেমনটি করেছিলেন প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ সা. মক্কায় তেরোটি বছর এবং অতীতের সকল নবী-রাসূল ও তাঁদের সঙ্গী-সাথীরা। নবীদের যা কাজ, তাঁদের অনুসারীদেরও একই কাজ। ঈমান আনার পরে সাহাবায়ে কেরাম নবী মুহাম্মদ সা.-কে জিজ্ঞাসা করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা.! আমাদের কাজ কী? জবাবে তিনি বলেছিলেন, আমার যে কাজ তোমাদেরও তাই। রাসূলুল্লাহ সা. যা করেছেন, বলেছেন ও তাঁর সম্মুখে কোনো কাজ তাঁর সাহাবীরা করেছেন এবং তিনি আপত্তি করেননি, তা সবই সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ সা.-এর সমগ্র জীবন অতিবাহিত হয়েছে দীন কায়েমের চেষ্টায়। দীন কায়েমের চেষ্টা-প্রচেষ্টা অর্থাৎ জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ উম্মতে মুহাম্মদ সা.-এর ওপর ফরজ। দীন কায়েমের ব্যাপারে মতপার্থক্য সৃষ্টি আল্লাহপাক মানবেন না। কিন্তু দীন কায়েমের প্রক্রিয়া ভিন্ন হতে পারে। রাসূলুল্লাহ সা.-এর জীবনকালে একটিই দল ছিল কিন্তু তাঁর অবর্তমানে একাধিক দল থাকতে পারে এবং সকলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জন। একজন মুমিন দীন কায়েমের চেষ্টারত কোনো একটি দলের সাথে সংশ্লিষ্ট হবেন এবং প্রচেষ্টারত কোনো দলকে যদি কারো পছন্দ না হয়, তাহলে অপেক্ষাকৃত কম মন্দ এমন একটি দলকে বাছাই করে নেবে বা নিজেই একটি দল গঠন করবে। মুমিনকে বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ আল্লাহপাক দেননি।
দীন কায়েমের প্রশ্নে আল্লাহপাক বলেছেন, মুশরিকরা তা কখনোই মেনে নেবে না। সূরা ফাতাহর ২৮নং আয়াতে বলেছেন, আল্লাহর সাক্ষ্যই যথেষ্ট। মহান আল্লাহপাকের এমন উক্তির পর আর কারো বক্তব্য বিবেচনাযোগ্য নয়। ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা (নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন হলো ইসলাম- আলে ইমরান : ১৯) এবং আল্লাহপাকের দাবি, তাঁর বান্দারা জীবনের সকল ক্ষেত্রে পরিপূর্ণভাবে ইসলাম মেনে চলবে। তাঁর বাণী, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না; নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন’। সূরা বাকারা : ২০৮। জীবনে পরিপূর্ণ ইসলাম না মানা প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘তোমরা কি দীনের কিছু অংশ মানবে এবং কিছু অংশ অমান্য করবে, তাহলে দুনিয়ার জীবনে রয়েছে জিল্লতি ও আখিরাতে রয়েছে ভয়াবহ আজাব’। সূরা বাকারা : ৮৫। আজকের বিশ্বে মুসলমানদের এ জিল্লতির মূলে রয়েছে দীনকে পরিপূর্ণভাবে না মানা। সেই সাথে বলা যায়, সমাজে দীন প্রতিষ্ঠিত না থাকলে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর শরিয়ত (নিয়মকানুন) মানাও সম্ভব নয়। একজন মুসলমান কখনো ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাকে ধর্ম মেনে চলতে হয় এবং যে মানে তাকেই বলা হয় মুসলিম (অনুগত)। তার কথা হলো, ‘আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম’। সূরা মায়েদা : ৭। যতটুকু না মানে ততটুকু শয়তানকে (তাগুত) অনুসরণ করা হয়। এ আংশিক মেনে চলার নামই শিরক।
দীন কায়েম কোনো একক ব্যক্তি বা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন দলবদ্ধ প্রচেষ্টা। আর আল্লাহপাকও চান দীন কায়েমে ঈমানদাররা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালাবে। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে, তাঁর কাছে ফিরে আসতে হলে অবশ্যই মুসলিম অবস্থায় আসতে হবে। তাঁর বাণী, ‘হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যেভাবে তাঁকে ভয় করা উচিত এবং মুসলিম না হয়ে কখনো মৃত্যুবরণ করো না’। সূরা আলে ইমরান : ১০২। এ আয়াতের পরবর্তী ১০৩নং আয়াতে বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’। এখানে এটাও উপলব্ধি করা যায় যে, জামায়াতবদ্ধ জীবনযাপনের মাঝেই মুসলমান হওয়াটা নির্ভর করে। আল্লাহপাক আরো বলেছেন, যারা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে আল্লাহপাক তাদের পছন্দ করেন। তাঁর বাণী, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরই ভালোবাসেন, যারা আল্লাহর রাস্তায় সিসাঢালা প্রাচীরের মতো জামাতবদ্ধভাবে লড়াই করে’। সূরা আস সফ : ৪। আল্লাহপাক মুমিনদের বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে দেখতে চান, যাতে সকল পাপাচার ও জুলুম-নির্যাতন সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব থেকে দূর হয়ে যায়। তাঁর বাণী, ‘তোমরা সর্বোত্তম দল। তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য। তোমরা ভালো কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজে নিষেধ করবে’। সূরা আলে ইমরান : ১১০। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ছাড়া ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজে নিষেধ করা সম্ভব নয়।
আল্লাহর কাছে শিরকের অপরাধ সবচেয়ে বড়ো। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, শিরক বাদে যে কোনো অপরাধ আল্লাহপাক যাকে খুশি ক্ষমা করে দিবেন। তাঁর বাণী, ‘মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা আল্লাহপাকের শরিক বানিয়ে উপাসনা করে। তাদের মতো হয়ো না যারা দীনে মতভেদ সৃষ্টি করে ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয় আর প্রত্যেক দল উল্লাস করে যে, তারাই সঠিক ও সত্যের পথে আছে’। সূরা রুম : ৩১-৩২। আল্লাহপাক মুমিনের জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করেছেন এবং দুনিয়ায় যত রকমের বিধিবিধান রয়েছে সবার ওপরে ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। ইসলামের বাইরে যা কিছু আছে সবই বাতিল এবং বাতিলের পক্ষাবলম্বন সুস্পষ্ট কুফরি, যা জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে। আল্লাহপাক ঈমান ও কুফর সম্পর্কে বলেছেন, ‘যারা ঈমানের পথ অবলম্বন করে তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে। আর যারা কুফরির পথ অবলম্বন করে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। কাজেই শয়তানের সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে লড়াই করো আর বিশ্বাস রেখো, শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল’। সূরা নেসা : ৭৬। আল্লাহর পথে জিহাদ বলতে বোঝায় জমিনে আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানো। ৫ আগস্টের পর দেশে এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত এবং দীর্ঘ বঞ্চনার পর দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এ সরকারের মৌলিক দায়িত্ব। আমার দৃষ্টিতে আগামীর নির্বাচন হবে ইসলাম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াই। জামায়াত ও অন্য ইসলামী দলগুলো দেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। পক্ষান্তরে সেক্যুলারপন্থী দলগুলোর ইসলাম প্রতিষ্ঠার কোনো লক্ষ্য এবং কর্মসূচি নেই।
দীন কায়েমের লক্ষ্যে মুমিনদের ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপনের জন্য আল্লাহপাক কুরআনে জোর তাগিদ দিয়েছেন এবং কুরআনের পাশাপাশি হাদিসেও জামাতবদ্ধ হওয়ার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। হজরত হারেস আল আশয়ারী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের পাঁচটি কাজের আদেশ করছি (অন্য রেওয়াতে আছে, আমার আল্লাহ আমাকে পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন)Ñ (১) জামাতবদ্ধ হওয়া, (২) নেতার আদেশ মন দিয়ে শোনা, (৩) নেতার আদেশ মেনে চলা, (৪) আল্লাহর পথে হিজরত করা (আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ বর্জন করা), (৫) আল্লাহর পথে জিহাদ করা। আর তোমাদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি সংগঠন থেকে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে যাবে সে নিজের গর্দান থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলবে, তবে যদি সংগঠনে প্রত্যাবর্তন করে তো স্বতন্ত্র কথা। আর যে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের দিকে লোকদের আহ্বান জানাবে সে জাহান্নামে যাবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.), সালাত কায়েম ও ছিয়াম পালন করা সত্ত্বেও? আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, সালাত কায়েম ও ছিয়াম পালন এবং নিজেকে মুসলিম দাবি করা সত্ত্বেও’। আহমদ ও তিরমিযী। তিনি আরো বলেছেন, ‘জামায়াতের ওপর রয়েছে আল্লাহর রহমত। যে ব্যক্তি জামাত ছাড়া একা চলে, সে তো একাকী দোযখের পথেই ধাবিত হয়’। তিরমিযী। রাসূলুল্লাহ (সা.) বড়ো শক্ত কথা বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আনুগত্য পরিত্যাগ করে এবং জামাত থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু’। মুসলিম।
ইসলামের বাইরে যা কিছু সবই জাহেলিয়াত এবং সেটি শয়তানের পথ। আর আল্লাহপাক বলেছেন, শয়তানের ষড়যন্ত্র আসলেই দুর্বল। আল্লাহপাকের প্রতিশ্রুতি, ‘তোমরা নিরাশ হয়ো না ও বিষন্ন হয়ো না এবং তোমরাই জয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও’। আলে ইমরান : ১৩৯। তিনি আরো বলেছেন, ‘আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খেলাফত দান করবেন, যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দীনকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যে দীনটি আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা যেন শুধু আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কাউকে শরিক না করে। আর যারা এরপরও কুফরি করবে তারাই ফাসেক’। সূরা নূর : ৫৫।
সমগ্র বিশ্বজাহানের রাজত্ব আল্লাহর হাতে। মানুষ তাঁর প্রতিনিধি (আব্দুল মালেক) হিসেবে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালালে আল্লাহপাক দয়া করে জমিনে মুমিনদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন এবং রাজত্ব দান একান্তভাবে আল্লাহর মর্জি। কাউকে রাজত্ব দান এবং কারো হাত থেকে কেড়ে নেয়া তাঁরই ইচ্ছাধীন। তাঁর বাণী, ‘বলো, হে আল্লাহ! তুমি রাজত্বের মালিক, যাকে চাও রাজত্ব দান করো, আর যার থেকে চাও রাজত্ব কেড়ে নাও এবং যাকে চাও সম্মান দান করো। আর যাকে চাও অপমানিত করো, তোমার হাতেই কল্যাণ, নিশ্চয়ই তুমি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান’। সূরা আলে ইমরান : ২৬। ইসলামী আন্দোলনের (জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ) মূল লক্ষ্য হলো আখেরাতে ক্ষমা ও জান্নাত। সূরা সফের ১২নং আয়াতে জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী ব্যক্তির গুনাহ ক্ষমা করে জান্নাতে দাখিলের আল্লাহপাকের স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে এবং সূরা সফের ১৩নং আয়াতে ‘তোমাদের জন্য আরো থাকবে আল্লাহর সাহায্য ও নিকটবর্তী বিজয়। মুমিনদের সুসংবাদ দাও।’ ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টদের প্রকৃত লাভ হলো জান্নাতপ্রাপ্তি এবং অতিরিক্ত প্রাপ্তি হলো দুনিয়ায় রাজত্ব লাভ। যারা দীন ইসলাম মেনে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায় তাদেরকে সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। এসব মজলুমদের আল্লাহপাক সুসংবাদ দিয়েছেন, ‘আমি সংকল্প করেছিলাম, পৃথিবীতে যাদের লাঞ্ছিত করে রাখা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবো, তাদের নেতৃত্ব দান করবো, তাদের উত্তরাধিকার করবো এবং পৃথিবীতে তাদের কর্তৃত্ব দান করবো’। সূরা কাসাস : ৫-৬। জুলাই ’২৪ ছাত্র-ছাত্রীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন একপর্যায়ে জনবিস্ফোরণে রূপ নেয় এবং ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিজয় মজলুমের প্রতি আল্লাহপাক প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ ও তাঁর পক্ষ থেকে এক নিদর্শন।
জমিনে যারা ইসলামী আন্দোলন করে মূলত তারা আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের আশায় করে থাকে। আর আল্লাহপাক জান্নাত দানের প্রতিশ্রুতিও দান করেছেন। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের জান-মাল খরিদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে এবং মারে ও মরে। তাদের জন্য জান্নাত দানের ওয়াদা আল্লাহর জিম্মায় একটি পাকাপোক্ত ওয়াদা তওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে। আল্লাহর চেয়ে বেশি ওয়াদা পালনকারী আর কে আছে? কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে যে কেনাবেচা করেছ তার জন্য সন্তুষ্ট হও। এটিই সবচেয়ে বড়ো সাফল্য’। সূরা তওবা : ১১১। জামায়াত-শিবির বা কোনো ইসলামী সংগঠন জান্নাতের টিকেট দেয় না এবং দিতে পারেও না। জান্নাতে যাওয়ার টিকেট একান্তভাবে আল্লাহর হাতে। ইসলামী সংগঠনসমূহ মানুষকে আল্লাহর সাথে মিলিয়ে দেয় যাতে সে আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাত লাভ করতে পারে। জামায়াত-শিবিরের সকল জনশক্তি আখিরাতে আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাত লাভের আশা নিয়ে মাঠে-ময়দানে তৎপর থাকে। সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে সংগঠনকে আঁকড়ে ধরে থাকে। যারা দীন প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায় তারা এ বিশ্বাস নিয়েই করে যে, মহান আল্লাহপাক তাদের ক্ষমা করে জান্নাত দান করবেন। আর জান্নাত দানের ওয়াদা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে স্পষ্ট ওয়াদা। জামায়াত-শিবির ও অন্যান্য ইসলামী দল জান্নাতের প্রত্যাশা নিয়েই মানুষকে দীনের পথে ডাকে এবং তারা যা বিশ্বাস করে দাওয়াত দানের সময় সেটিই বলে থাকে। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসীদের পক্ষে এটা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তবে এটি স্পষ্ট যে, জামায়াত-শিবির ও সকল ইসলামী সংগঠন আখিরাতে জান্নাত লাভের আশায় জান ও মাল দিয়ে সংগ্রাম করে।
রাসূলুল্লাহ সা. যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন সেসময়ে আল্লাহ তাঁকে দোয়া শিখিয়ে দিয়েছিলেন, ‘তুমি বলো, হে আমার রব (যেখানেই নিয়ে যাও), তুমি আমাকে সত্যের সাথে নিয়ে যেও এবং (যেখান থেকেই বের করো) সত্যের সাথে বের করো এবং তোমার কাছ থেকে আমার জন্য একটি সাহায্যকারী রাষ্ট্রশক্তি দান করো’। সূরা বনি ইসরাইল : ৮০। আল্লাহপাক তাঁর নবীকে রাষ্ট্রশক্তি অর্জনের জন্য তাঁরই কাছে দোয়া করতে বলেছেন। প্রাণান্ত প্রচেষ্টা ছাড়া দীন কায়েম সম্ভব নয় এবং দীনের বিজয় একান্তভাবে আল্লাহপাকের মর্জির উপর নির্ভরশীল। তাই প্রচেষ্টার সাথে আল্লাহর কাছে কাতরভাবে দোয়া করতে হবে এবং নামাজ-রোজা, জিকির-আজকার ও আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। জিহাদবিমুখ জীবন মুসলমানের জীবন নয়। নবী মুহাম্মদ সা. জিহাদকে ঈমানের সাথে সম্পর্কিত করে বলেছেন, যে লোক মারা গেল অথচ না জিহাদ করলো আর না জিহাদের বাসনা অন্তরে পোষণ করলো তার মৃত্যু হলো মুনাফিকের মৃত্যু।
আল্লাহর পথে লড়াই করা এত সহজসাধ্য নয়। একজন মুমিন এবং দুনিয়াপূজারি ও ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসীর মাঝে পার্থক্য হলো মুমিন আখিরাতে জান্নাত লাভের আশায় তার সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, পক্ষান্তরে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী একজন ব্যক্তির জন্য দুনিয়ার জীবনই সব এবং আখিরাতে তার কিছু নেই। আল্লাহপাকের বাণী, ‘আল্লাহর পথে লড়াই করা উচিৎ তাদের যারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিক্রি করে দেয়। তারপর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে লড়াই করবে এবং মারা যাবে অথবা বিজয়ী হবে তাকে অবশ্যই আমি মহা পুরস্কার দান করবো’। আন নিসা : ৭৪। কুরআন ও হাদিস থেকে উপলব্ধি করা যায়, যারা জমিনে দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায় তাদের আল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে অর্থাৎ জান্নাতের টিকেট দান করা হয়েছে। আল্লাহপাক নিজেই মুমিনের সাথে কেনাবেচার চুক্তি করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের জান-মাল খরিদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। তারা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করে এবং মারে ও মরে’। সূরা তওবা : ১১১। জান্নাতের টিকেট প্রাপ্তির বিষয়টি একান্তভাবে আল্লাহর। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের নেক আমলসমূহ যদি আল্লাহপাক গ্রহণ না করেন। আল্লাহর পথে জানমাল সবকিছু নিয়ে সংগ্রামের বিনিময়ে জান্নাতদানের ওয়াদা আল্লাহপাক করেছেন। ঈমান ও নেক আমলকারী বান্দাকেও আল্লাহপাক জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আসলে আমলের বিনিময়ে জান্নাত নয়, বরং জান্নাত হবে আল্লাহর ক্ষমাপ্রাপ্তির বিনিময়ে। মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহর রাসূল সা. খুব বেশি বেশি করে তওবা-ইস্তেগফার করতেন। তাঁর এতো পেরেশানির প্রেক্ষিতে সাহাবায়ে কেরাম বড় অস্থির হয়ে পড়তেন এবং বলতেন, আল্লাহপাক আপনার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। সাহাবীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলতেন, আমি কি আল্লাহর শোকরগুজার বান্দাহ হবো না। তিনি আরো বলতেন, আল্লাহপাকের ক্ষমা ছাড়া কেউ জান্নাতে যাবে না। সাহাবায়ে কেরাম বলতেন, আপনিও কি? জবাবে বলতেন, হ্যাঁ, আমিও। তাই ভালো কাজ করার পরও একজন মুমিন সর্বদা মহান আল্লাহপাকের ক্ষমা ও দয়া চাইবে। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের প্রতি রহম করুন।
লেখক : উপাধ্যক্ষ (অব.), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।