জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় গণভোটের বিকল্প নেই
২৩ অক্টোবর ২০২৫ ২০:০৫
জুলাই জাতীয় সনদে গত ১৭ অক্টোবর শুক্রবার অধিকাংশ রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করেছে। ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন, বিপ্লবীদের স্বীকৃতি, আওয়ামী লীগ ও তার দোসরদের ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন থেকে জনগণের জান-মাল-সম্মান রক্ষা। মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থনৈতিক মুক্তি ও ধর্মীয় সম্প্রীতিসহ যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, এ স্বাক্ষরের মাধ্যমে তার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে মাত্র। আইনগত ভিত্তি ছাড়া রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার যে সংস্কারের স্বপ্ন নিয়ে বিপ্লবীরা জীবন দিয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন, জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, তা প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব।
ফ্যাসিবাদী সংবিধানের কঙ্কালের ওপরই নতুন মোড়কে রং লাগানোর ষড়যন্ত্র চলছে বলে মনে করছেন বিপ্লবের পক্ষের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতারা। অথচ ফ্যাসিবাদীদের হুমকি বন্ধ হয়নি। বরং বেড়েছে। তারা সশস্ত্র যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছে। তালিকা তৈরি হচ্ছে, হাসিনা ফিরে এসেছে সবাইকে ফাঁসি দেবেন বলে প্রতিদিন হুমকি দিচ্ছেন। নেতা-কর্মীদের উসকে দিচ্ছেন দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য। প্রকাশ্যে ভিডিওবার্তা দিয়ে হত্যা ও জ¦ালাও-পোড়াও চালানোর নির্দেশ দিচ্ছেন। এমনি দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলার ষড়যন্ত্রের খবরও বিভিন্ন মিডিয়ায় এসেছে। এমন অবস্থায় সনদের আইনগত ভিত্তি, সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও তার দোসর ফ্যাসিস্ট দলগুলোর ফিরে আসার পথ বন্ধ করা জরুরি বলে মনে করেন দেশবাসী।
জনগণের এ আকাক্সক্ষার বাস্তবায়নে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) সংসদ নির্বাচন, জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে নভেম্বরে গণভোট আয়োজনসহ পাঁচ দাবিতে গত ১৯ অক্টোবর রোববার নতুন কর্মসূচি দিয়েছে সনদে স্বাক্ষর করা জামায়াতে ইসলামী ও সমমনা সাতটি দল। তারা গত ২০ অক্টোবর সোমবার থেকে দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। আগামী ২৭ অক্টোবর সোমবার পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে। যে চার/পাঁচটি রাজনৈতিক দল ঐকমত্য কমিশনের সাথে বসে জুলাই সনদ প্রণয়ন করেছে অথচ স্বাক্ষর করেনি। তাদের আচরণ ও কথায় অনেকে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। তাদের এ বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার জুলাই সনদে সই করার পরও রাজপথে কর্মসূচি দেওয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, এখনো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি এবং এ সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে গণভোট আয়োজনের কাজ বাকি রয়ে গেছে। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আদেশ ও গণভোট কখন হবে, সে তথ্য উল্লেখ নেই। এজন্য জুলাই সনদে স্বাক্ষরের পরও মাঠের কর্মসূচি দিয়েছেন তাঁরা। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)-এর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। গত ১৯ অক্টোবর এ সাত দলের সাথে যুগপৎ আন্দোলনে দলের যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি। এতে এ সংখ্যা বেড়ে জামায়াতের ইসলামীর আন্দোলনে শরিক দলের সংখ্যা হলো ৮।
আমরাও মনে করি, জুলাই সনদে স্বাক্ষর মানে চূড়ান্ত কিছু নয়, একটি প্রাথমিক ভিত্তি রচনা হলো মাত্র। এ ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে জাতির প্রত্যাশা বাস্তবায়নে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এ সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে গণভোট আয়োজন করতে হবে। সাথে সাথে ফ্যাসিস্টরা যেন রং বদলে রাজনীতিতে প্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। ১৯৭৫ সালে এ জাতিকে একদলীয় ফ্যাসিস্ট বাকশালী দুঃশাসন থেকে যারা মুক্তি দিয়েছিলেন, তাদের রক্ষা করতে সংবিধানে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বা দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু ফ্যাসিস্ট বাকশাল আবার আওয়ামী লীগ নামে ফিরে এসেছিলো। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস, বাকশাল নামেও এদেশে একটি রাজনৈতিক দল ছিল, ১৯৭৫ সালের বিপ্লবের পর বহুদলীয় গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে। কারণ সেই সময়ের নীতিনির্ধারকরা ইতালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট ও নাৎসি পার্টির পরিণতির ইতিহাস ভুলে গিয়েছিলেন। তাদের সেই ভুলের খেসারত জাতিকে দিতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সেই ভুলের কারণেই ১/১১ ও হাসিনার দুঃশাসন ফিরে এসেছিল। ইউরোপের উদাহরণ ও ইতিহাসের শিক্ষা হলো, গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা অব্যাহত রাখতে হলে যাদের ডিএনএতে ফ্যাসিজম আছে, তাদের রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে। চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ঘুষ-দুর্নীতির ওপেন লাইসেন্স পাওয়াই যাদের রাজনীতির লক্ষ্য, তারা ফ্যাসিস্ট হবেই। আদর্শিকভাবে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে তারা সন্ত্রাসের পথে কর্তৃত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অপতৎপরতা চালিয়ে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন আমদানি করবেই। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, মসজিদে পবিত্র কুরআন ক্লাসে হামলার ঘটনা ঘটছে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের দাবি, কুরআন ক্লাসের নামে একটি ছাত্র সংগঠন তাদের সমর্থক সংগ্রহ করছিলো। হ্যাঁ, তাদের রাজনৈতিক দর্শন যদি হয় পবিত্র কুরআন, তারা তা করতেই পারে। এর মোকবিলায় মসজিদে হামলা কোনো রাজনৈতিক কালচারে পড়ে না। হামলা কেন? বিপরীতে তারা তাদের আদর্শ প্রচার করুক। প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় তাদের আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরুক, জনগণ যাকে ভালো মনে করবে, তাকে গ্রহণ করবে। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকলে পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ভুল-শুদ্ধের হিসাব নেবে। এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্যই জুলাই সনদ ও পিআর পদ্ধতির আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে গণভোটের ব্যবস্থা করার বিকল্প নেই।
আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়টি উপলবব্ধি করবে এবং ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লব সফল করতে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ভুল করবে না।