রসায়ন শাস্ত্রে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান


৯ অক্টোবর ২০২৫ ১৬:১৫

॥ মুহাম্মদ নূরে আলম ॥
বিজ্ঞানের প্রধান শাখার নাম রসায়ন। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ কেমিস্ট্রি (Chemistry)। এ শব্দটি আরবী ‘আল-কিমিয়া’ শব্দ থেকে নির্গত। আর আরবী ‘আল-কিমিয়া’ শব্দটি মিশরীয় ‘কামিত’ শব্দ থেকে এসেছে। কারো মতে এটি গ্রীক Chumeia, Chemeia শব্দ থেকে নিষ্পন্ন, যার অর্থ গলিত ধাতু। বিজ্ঞানের ইতিহাসে ‘আল-কিমিয়া’ জ্ঞানের দর্শনভিত্তিক এমন এক শাখাকে বলে, যা জ্ঞানের সকল শাখার সকল উপাদানের সম্মিলনে একটি উচ্চতর শক্তির অস্তিত্বকে বোঝায়। রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি সকল উপদান যে একক উচ্চতর শক্তির অংশ হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে, সেই বিজ্ঞানের নাম ‘আল-কিমিয়া’। সপ্তম শতাব্দী থেকে ‘আল-কিমিয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রসায়নকে আরবীতে ‘আল-কিমিয়া’ ছাড়াও ‘আল-হিকমা আস্ সানাআহ্’ নামেও ডাকা হতো। পদার্থের গঠন, পদার্থের পারস্পরিক ক্রিয়ায় নতুন পদার্থের সৃষ্টি এবং পদার্থের ক্রিয়া-বিক্রিয়া সম্বন্ধে যে শাখায় আলোচিত হয়, রসায়নবিদগণ সে শাখাকে কেমিস্ট্রি নামে অবিহিত করেছেন। বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় রসায়নের অপার অবদান রয়েছে।
ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগে রসায়ন নামক কোনো বিদ্যার প্রচলন ছিল না। সর্বপ্রথম আরবীয়রাই রসায়নকে বিজ্ঞানের একটি আলাদা শাখা হিসেবে পরিচিতি দিয়েছেন। মিশরীয়রা প্রথম এর চর্চা শুরু করলেও ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর বিজ্ঞ মুসলিম জাতি এর চর্চা, বিশ্লেষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাধ্যমে রসায়নের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং রসায়নকে বিজ্ঞানের একটি নতুন অধ্যায় হিসেবে পরিচিতি দেয়। চিকিৎসা শাস্ত্র, ভূগোল শাস্ত্র এবং গণিতের পর মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ অবদান হলো রসায়ন শাস্ত্র। রসায়ন শাস্ত্রকে আরবরা আল কিমিয়া বলত, যা পরে আলকেমি এর রূপ নেয়। আর এই শব্দ থেকেই কেমিস্ট্রি (Chemistr)-এর উদ্ভব।
মিশরে প্রথম রসায়ন চর্চা শুরু হয় তারা কাঠ জোড়া দেয়ার জন্য গদ আবিষ্কার করেন। গাছের আঠা, গম, আর যব ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করল কাগজ। রসায়নের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি করেছিল মুসলমানদের স্বর্ণযুগে। নবী করীম সা.-এর যুগ থেকে হযরত আলী (রা.) হাত ধরে খালেদ বিন ইয়াজিদের সেতুবন্ধ হয়ে জাফর আস সাদিক এর মাধ্যমে জাবির ইবনে হাইয়ানের হাতে মুসলিম রসায়ন বিজ্ঞানে পূর্ণতা লাভ করে। মানুষ জানত যে কথা বাতাসে হারিয়ে যায় কিন্তু কুরআনের মাধ্যমে পশ্চাত্য প্রথম জানলো যে মানুষের উৎক্ষিপ্ত কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এ কারণেই ড. মরিস বুকাইলি তার রচিত বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞানের ১২ পৃষ্ঠায় বলেন ‘কুরআনের এমন একটা বক্তব্য নেই যে বক্তব্যকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিচারে খণ্ডন করা যেতে পারে’। মুসলিম জাতি তাদের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ঘটিয়েছিল আল কুরআনের বদৌলতে। এটাই মুসলিম জাতির বিজ্ঞান চর্চায় উৎকর্ষ সাধনের মূল প্রাণশক্তি। এ কারণে Dr. Hartwing Herschfeld তার গবেষণা গ্রন্থ New research in to the composition and exegesis of Quran তিনি লিখেছেন, we must not be surprised to find the Quran regarded as the fountain of All the Science.
চর্তুদশ শতাব্দীতে মুসলমানদের হাত ধরে রসায়ন তার স্বর্ণযুগ অতিবাহিত করে। দশম ও একাদশ শতকে জাবির ও রাজি প্রমুখের রসায়নগার যখন চলছিল তার শত শত বছর পরেও ইউরোপের জিইফ্রি চসার রসায়নের পুতিগন্ধময় কাণ্ডকারখানা থেকে বাঁচার জন্য তাদের ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছিল। মহাকবি দান্তে তো আলকেমীদের তার দেখানো নরকে সপ্তম স্থানে স্থান দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক আমির আলি বলেন, ‘বিজ্ঞান হিসেবে রসায়ন প্রশ্নাতীত ভাবে মুসলমানদের আবিষ্কার।’ রসায়নশাস্ত্রে অবদান রাখা কয়েকজন মুসলিম মনীষার পরিচয় তুলে ধরা হলো।
জাবির ইবনে হাইয়ান: আধুনিক রসায়নের জনক হলেন জাবের ইবনে হাইয়ান (জন্ম : ৭২১ মৃত্যু : ৮১৫)। খলিফা হারুনুর রশিদের শাসনামলে তার রসায়ন চর্চা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে রসায়ন বিজ্ঞান হিসেবে নতুন পরিচিতি পায়। এর আগে রসায়নের বিজ্ঞান হিসেবে কোনো পরিচয় ছিল না। মিশরীয়রা ও ইউরোপ রসায়ন কে যাদু বিদ্যার প্রতিক মনে করতো। তখন কুফায় হারুন অর রশীদের সময়কালে (৭৮৬-৮০৯) জাবির ইবনে হাইয়ানের গবেষণাগারে সোনা তৈরির ফর্মূলার বাস্তবিক প্রয়োগ করে সোনার তাল উৎপাদন করেছিলেন। তিনি তার গবেষণাগারে গন্ধক ও পারদ আলাদা ধাতুতে পরিণিত করেন। তার রচিত বিখ্যাত বই ‘কিতাবুল ইজহাত’ এ উল্লেখ করেছেন ধাতুসমূহ পারদ ও গন্ধকের সংমিশ্রণ ও সোনালী রংয়ের গন্ধকের সাথে পারদের সংযুক্তি তৈরি হয় সোনা। তার বিখ্যাত রসায়নের গবেষণাগারে সীসাকে বিজ্ঞান সম্মত প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হয়। প্রাচ্য ও পশ্চিমের বিজ্ঞানীদের কাছে তিনি অনুবাদের কারণে এবনবৎ নামে পরিচিত। জাবির ইবনে হাইয়ানের আবিষ্কারসমূহ: ১. ডিস্টিলেশন পদ্ধতি। ২. তরলীকরণ। ৩. স্ফটি করণ। ৪. শুদ্ধকরণ। ৫. অক্সিজেনের সাথে যুক্তকরণ। ৬. বাষ্পীকরণ। ৭. চোলাই যন্ত্র (এ পদ্ধতিতে তৈরী হচ্ছে গাড় গোলাপজল ও বিভিন্ন সুগন্ধি দ্রব্যাদি)।
রসায়ন শাস্ত্রে তার রচিত বিখ্যাত বই হলো- ১. উসলুল কিমিয়া ২. আসরারুল কিমিয়া এবং ৩. আর রাহমা ইত্যাদি। ইবনে হাইয়ান আলকেমিতে পরীক্ষামূলক গবেষণার গোড়াপত্তন করেছেন। এছাড়া ভারসাম্য তত্ত্ব, কৃত্রিম উৎপাদন তত্ত্ব, ধাতুর গন্ধক-পারদ তত্ত্ব, রসায়নের জৈব উপাদান প্রয়োগ তার অন্যতম আবিষ্কার। তিনি একাধারে রসায়ন শাস্ত্রবিদ, দার্শনিক, মহাকাশ বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন। ইবনে ওয়াহশিয়া, ইবনে সিনার মতো বিখ্যাত মুসলিম মনিষীরা তার শিষ্য ছিলেন। ইবনে হাইয়ানের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে তারা রসায়নের শাখাকে আরো প্রশস্ত করেছেন।
জাকারিয়া আর রাজি : আবু বকর মোহাম্মদ ইবন জাকারিয়া আল রাজি (জন্ম : ৮৬৫, মৃত্যু : ৯২৫) পেশায় ছিলেন একজন দক্ষ পারসিক চিকিৎসক ও দার্শনিক। বিজ্ঞানী আল রাজি সর্বপ্রথম হাইড্রোজেন ও সালফেটের বিক্রিয়ার মাধ্যমে সালফিউরিক এসিড আবিষ্কার করেন। যা সার উৎপাদন, রং, বিস্ফোরক, কীটনাশক, ওষুধ ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার হয়। এছাড়া তিনি জৈব ও অজৈব রসায়নে অবদান রেখেছেন। জাকারিয়া আর রাজি এর হাত ধরে বিজ্ঞানের ইতিহাসে আবিষ্কৃত হয় যবক্ষার এসিড। এ যবক্ষার এসিড আবিষ্কারের কারণে ইউরোপীয় বিজ্ঞান সমাজে তাকে নির্ভরযোগ্য রসায়নবিদ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। পৃথিবীর সর্বপ্রথম এনসাইক্লোপিডিয়া রচিত হয় ৯৭৬ সালে বিখ্যাত মুসলিম শিক্ষাবিদ আবু আব্দুল্লাহ রচিত ‘মাফাতিহুল উলুম’র মাধ্যমে। এ বিশ্বকোষের ২য় খণ্ডে আল কেমী অর্থাৎ রসায়ন নিয়ে তিনটি অধ্যায় আলোচনা করা হয়। এ বিশ্বকোষ থেকে আমরা জানতে পারি ইবনে আব্দুল মালেক আল কাছির আবিষ্কার রসায়নকে অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দিয়েছে। নিম্নে তার আবিষ্কারের তালিকা দেয়া হলো: ১. Solution of Sodium Hydrate ২. Solution of Calcium polysulfide ৩. Calcination ৪. দ্রবণ পদ্ধতি ৫. কাশা গন্ধক তৈরীর প্রক্রিয়া। ৬. Coagulation অর্থাৎ ঘনীভূত করার পদ্ধতি ইত্যাদি। আল রাজি রসায়ন বিষয়ের ওপর ১২টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইরানে প্রতিবছর ২৭ আগস্ট ‘রাজি দিবস’ (ফার্মেসি দিবস) পালন করা হয়।
আর হুমায়রী ও আাস সাদিক: আধুনিক রসায়নের জনক ইবনে হাইয়ানের শিক্ষক ছিলেন জাফর আস সাদিক ও হারবী আর হুরাইরী। যারা মিশরের রসায়ন নিয়ে অনেক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। আস সাদিক ৭০০ বা, ৭০২-৭৬৫ সালের লোক ছিলেন। হারবী আর-হুমায়রী সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইয়ামেনে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের রাসায়নিক তত্ত্বগুলো নিয়ে শিষ্য ইবনে হাইয়ান বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
আল-কিন্দি: আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল কিন্দি (জন্ম : আনু ৮০১, মৃত্যু : আনু ৮৭৩) ছিলেন বহুবিদ্যাবিশারদ। তিনি ছিলেন দার্শনিক, গণিতবিদ, যুক্তিবিদ, রসায়নবিদ, মনোবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, সংগীতজ্ঞ। পাশ্চাত্য বিশ্বে তিনি আলকিন্দাস নামে পরিচিত। এরিস্টটল, প্লেটো, ইবনে হাইয়ানের ভাবশিষ্য ছিলেন তিনি।
আল বিরুনি: আবু রায়হান আল বিরুনি (জন্ম : ৯৭৩, মৃত্যু : ১০৫০) ছিলেন গণিত, রসায়ন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে পারদর্শী। তিনি সর্বপ্রথম ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপর মুসলিম মনীষীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অধ্যাপক মাপা বলেছেন, আল বিরুনি শুধু মুসলিম বিশ্বের নয়, বরং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের একজন। তার ওষুধ প্রস্তুত প্রণালি সম্পর্কিত বই, ‘কিতাব আল-সায়দালা ফি আল-তিব্ব।’ এছাড়া তিনি ধাতু ও মূল্যবান পাথরের ঘনত্ব ও বিশুদ্ধতা নির্ধারণ করতে হাইড্রোস্ট্যাটিক ব্যালেন্স ব্যবহার করেছেন। আবু হানিফা দিনাওয়ারী, আল বাত্তানীর মতো প্রখ্যাত ব্যক্তি দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। ওমর খৈয়ামের ভাবগুরু ছিলেন আল বিরুনি।
আন নাবতি: আবু বকর আহমদ ইবনে আলি ইবনে কায়েস আন-নাবতি (জন্ম : ৯৩০) রসায়নের জগতে ইবনে ওয়াইশিয়া নামে অধিক পরিচিত। এই মুসলিম রসায়নবিদের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হলো ‘উসুলুল কাবির’।
ইবনে ফিরনাস: মুসলমান রসায়নবিদদের মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাম হলো আব্বাস ইবনে ফিরনাস (জন্ম : ৮১০ মৃত্যু : ৮৮৭)। তিনি ছিলেন একাধারে আবিষ্কারক, প্রকৌশলী এবং উড্ডয়ন বিশারদ।
ইবনে সিনা: আল শাইখ আল বাইম আবু আলি আল হোসেইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবন সিনা আল বুখারি (জন্ম : ৯৮০ মৃত্যু : ১০৩৭) ছিলেন মুসলিম চারজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর একজন। তার বিখ্যাত বইগুলোতে ইবনে সিনা ওষুধ প্রণালি সম্পর্কে বলেছেন। যেমন: সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড দ্রবণ, ক্যালসিয়াম পলিসালফাইড, কপার ও সোনার ভস্মীকরণ, সালফার ওষুধ, সাদা সালফারের প্রস্তুতি প্রভৃতি। ইবনে সিনার রসায়নবিষয়ক বই ‘ব্যবহারিক রসায়ন’। ইবনে সিনা আল রাজি, আল বিরুনি, এরিস্টটল, আল কিন্দি প্রমুখ ব্যক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। বিশ্বের অনেক বিখ্যাত মনীষী তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে। এছাড়াও আল-তাতিমি, আল-কাসি, আল-মাজরিতি, ইবনে ইয়াজিদ, আব্বাস শাফেঈ প্রমুখসহ আরও অনেক মুসলিম বিজ্ঞানীর অনন্ত অবদানেই আজকের এই আধুনিক রাসায়নিক বিজ্ঞান।
আধুনিক মুসলিম রসায়ন বিজ্ঞানীরা: রসায়ন এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশিষ্ট আধুনিক মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছেন নোবেল বিজয়ী আহমেদ জেওয়াইল, যিনি ফেমটো কেমিস্ট্রির জন্য পরিচিত। মিশরীয় রাসায়নিক পদার্থবিদ মোস্তফা এল-সায়েদ, যিনি ন্যানোসায়েন্সের একজন পথিকৃৎ। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বরা হলেন পাকিস্তানি জৈব রসায়নবিদ আতা-উর-রহমান, যিনি একজন অধ্যাপক এবং প্রযুক্তি টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আহমেদ জেওয়াইল (মিশরীয়-আমেরিকান): ফেমটোকেমিস্ট্রিতে তার কাজের জন্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, পারমাণবিক স্তরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিবিদ্যা অধ্যয়নের জন্য অতি দ্রুত লেজার তৈরি করা।
মোস্তফা এল-সায়েদ (মিশরীয়-আমেরিকান): একজন রাসায়নিক পদার্থবিদ এবং ন্যানোসায়েন্সের পথিকৃৎ যিনি মার্কিন জাতীয় বিজ্ঞান পদক পেয়েছেন।
আজিজ সানকার (তুর্কি) : ডিএনএ মেরামতের প্রক্রিয়া নিয়ে তার কাজের জন্য রসায়নে নোবেল বিজয়ী।
মুঙ্গি বাওয়েন্দি (তিউনিসিয়ান-আমেরিকান): কোয়ান্টাম ডট আবিষ্কার এবং সংশ্লেষণের জন্য নোবেল বিজয়ী।
আতা-উর-রহমান (পাকিস্তানি): একজন শীর্ষস্থানীয় জৈব রসায়নবিদ এবং অধ্যাপক, তিনি পাকিস্তানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক একটি জাতীয় টাস্ক ফোর্সের সভাপতিত্বও করেছেন।
মোহাম্মদ আতাল্লা (মিশরীয়-আমেরিকান): তিনি একজন ভৌত রসায়নবিদ যিনি আধুনিক মাইক্রোইলেকট্রনিক্সের একটি মৌলিক উপাদান, গঙঝঋঊঞ ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের কৃতিত্ব পেয়েছেন
ইউরোপের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে মুসলমানদের রসায়ন চর্চা: চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত রসায়নে মুসলমানদের নব নব আবিষ্কার যখন পৃথিবীকে আলোকিত করেছিল তখন আজকের ইউরোপ অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে মুসলমানদের ক্ষয়িষ্ণ যুগের সূচনা হলে ইউরোপীয়ানরা মুসলমানদের রেখে যাওয়া জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে মেতে উঠে। মুসলমানদের বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ক গ্রন্থাবলি শত শত বছর ধরে ইউরোপে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য হিসেবে পরিগণিত। ইবনে সিনার চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক কালজয়ী ‘আল-কানুন’ গ্রন্থটি ইউরোপের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছয় শত বছর ধরে পড়ানো হয়। অতএব মুসলমানরা কোনো কালেই জ্ঞান-বিজ্ঞানে দরিদ্র ছিল না। বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে দুস্থতার চাদর মুড়ি দিয়ে ইউরোপীয়ানরা যখন অসহায়ত্বের দুয়ারে পড়ে ছিল, তখন মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের আকাশে উজ্জল জ্যোতিষ্ক হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছিল।
আজকের ইউরোপ যে বিজ্ঞান নিয়ে গৌরব করে তা নিঃসন্দেহে মুসলিম মনীষীদের উদার জ্ঞানের অপার দান। আগে মানুষ জানত মানুষের মুখের কথা বাতাসে হারিয়ে যায়। কিন্তু কুরআনের কারণে পাশ্চাত্য জানল কথামালা বিসৃত হয় না। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তোমাদের প্রতিপালকের আদেশে একদিন সবকিছুই প্রকাশিত হয়ে পড়বে।’ (সূরা যিলযাল : ৪-৫)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা দুটি জিনিসের ব্যাপারে সতর্ক থাক। একটি তোমাদের স্ত্রীরা, অন্যটি এই পৃথিবী, যার ওপর তোমরা আস্ফালন করে চলছ।’ (সহীহ মুসলিম)।
ইংল্যান্ডের প্রতিথযশা দার্শনিক ফ্রান্সেস বেকোন বলেন, ‘জাবের বিন হাইয়ান রসায়নের জগতে পণ্ডিত ব্যক্তি, তাকে রসায়নের জনক বলা হয়।’ ফ্রান্সের রাসায়নিক এবং রাজনীতিবিদ মারসিলান বিরতুলুন (গবৎপবষষরহ ইবৎঃযবষড়হ) (১৮৮৩-১৯০০ খ্রি:) বলেন, ‘জাবের বিন হাইয়ান রসায়নশাস্ত্রে অনুরূপ ব্যক্তিত্ব, দর্শনশাস্ত্রে এ্যরিস্টটোল যেমন।’ আল্লামা যারকালী ‘আল-আলাম’ গ্রন্থে তার বিশালায়তনের ৫০০টি গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে নাদিম (মৃ: ১০৪৭ খ্রি:) তার বিখ্যাত ‘ফিহরাসত’ গ্রন্থে ইবনে হাইয়ানের রচনা সম্ভারের বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে বলেন, ‘তার রচিত ছোট বড় কিতাবের সংখ্যা দুই হাজারের অধিক।’ ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, ‘রসায়নবিদদের নিকট জাবের বিন হাইয়ানের রচনা সম্ভার অধিক প্রসিদ্ধ। তার গ্রন্থের সংখ্যা এতই বিপুল, পণ্ডিত ব্যক্তিদের নিকটও যার বিরাট একটি অংশ অজ্ঞাত রয়ে গেছে।’
পরিশেষে রসায়নের শিকড়ে পৌঁছাতে হলে দহনের ইতিহাস খুঁজতে হবে। আগুন আবিষ্কারের পর রসায়নের সূচনা হয়। আগুন এমন এক শক্তি, যা এক বস্তুকে অন্য বস্তুতে রূপান্তরের ক্ষমতা রাখে। মানব সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে আগুনকে নিয়ে মানুষের আগ্রহের অন্ত ছিল না। আগুন থেকে তারা লোহা আবিষ্কার করে। শুরু হয় লৌহ যুগ। তারপর কাচ আবিষ্কার হয়, তারপর সোনা। সোনা সবচেয়ে মূল্যবান ধাতুর মর্যাদা লাভ করলে অনেকেই ধাতুকে সোনায় পরিণত করার চেষ্টা চালায়। ফলে বিজ্ঞানের একটি শাখার উদ্ভব ঘটে, যাকে রসায়ন বলা হয়। সে সময় রসায়নের লক্ষ্য ছিল যে কোনো সাধারণ ধাতুকে স্বর্ণে বা রৌপ্যে রূপান্তরিত করা। তাদের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি ওষুধ আবিষ্কার করা যা সকল রোগের নিরাময় হতে পারে। এছাড়া মুসলিম সোনালী দিনগুলোয় আরো অসংখ্য মুসলিম রসায়নবিদগণ নিজেদের গবেষণা দিয়ে রসায়নের জ্ঞানের জগতকে সমৃদ্ধশীল করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েক জন হলেন, আব্বাস বিন ফিরনাস (৮১০-৮৮৭খৃ:)। তিনি আবিষ্কারক, প্রকৌশলী এবং উড্ডয়ন বিশারদ ছিলেন। আবু বকর আহমদ বিন আলী বিন কায়েস আন-নাবতী (মৃ:৯৩০খৃ:)। তিনি ইবনে ওয়াহশিয়া নামে অধিক পরিচিত। ইরাকে জন্ম গ্রহণকারী এই মুসলমি রসায়নবিদের রসায়ন বিষয়ক শ্রেষ্ঠ রচনা ‘উসূলুল কাবির’। মুহাম্মাদ বিন ইমায়েল আল-তাতিমী (৯০০-৯৬০খৃ:), আল-মাজরেতি (৯৫০-১০০৭খৃ:), আবুল মানসুর মুয়াফফাক হারবী, ইবনে আব্দুল মালেক আল-কাছী, ইবনে জাহিয, ইবনে রাসসাম প্রমুখ।
লেখক: সাংবাদিক, গ্রন্থকার।