সুরমা সদর অংশে নদীভাঙনের তীব্র ছোবল


৪ জুন ২০২৫ ১২:৫৪

সিলেট সংবাদদাতা : শুষ্ক ও বর্ষা- দুই মৌসুমেই ভাঙে নদীর তীর। দফায় দফায় ভাঙনে দিশেহারা সিলেটের সুরমাপাড়ের বাসিন্দারা। দীর্ঘতম এ নদীর জায়গায় জায়গায় ভাঙন প্রকট হচ্ছে। এতে নদীতীরবর্তী বিভিন্ন গ্রাম বিলীন হতে চলছে। ভাঙন অব্যাহত থাকলে এ বর্ষার পানি নামার সাথে সাথে সুরমা নদীর সিলেট সদর উপজেলা অংশের মোগলগাঁও ও কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, সিলেট সদর উপজেলার মোগলগাঁও ইউনিয়নের, চানপুর, যোগীরগাঁও, লালারগাঁও, তালুকপাড়া, খালপাড়, মিরেরগাঁও, ফতেহপুর, ফুলকুচি, পিরেরগাঁও, আঁকিলপুর ও নোয়াগাঁওয়ের একাংশে সুরমা নদীর তীরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ঝুঁকিতে পড়েছে সংশ্লিষ্ট গ্রামের ঘরবাড়ি, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা। দফায় দফায় ভাঙনে চানপুর গ্রামের ঘরবাড়ি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। কান্দিগাঁও ইউনিয়নের ধনপুর ও পশ্চিম দর্শা গ্রামেও নদীভাঙন প্রকট আকার ধারণ করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চানপুর গ্রাম একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম ছিল। সুরমার ভাঙনে ধীরে ধীরে গ্রামটি নিশ্চিহ্ন হতে চলছে। নদীভাঙন রোধে ব্লক বা বিকল্প ব্যবস্থা নিতে ঘুরছেন জনপ্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। কোনো কাজে আসছে না। মর্যাদাপূর্ণ সিলেট-১ আসনভুক্ত নদীভাঙন প্রবণ গ্রামগুলোর দিকে নজর দিচ্ছে না কেউ।
চানপুর গ্রামের বাসিন্দারা বৃদ্ধ মহিলা বলেন, ২ লাখ টাকা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আধাপাকা ঘর বানিয়েছিলেন। একটি বছরও বসবাস করতে পারেননি। কয়েক মাসের মধ্যেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আরো একটু ভাঙলে পুরো ভিটা নদীতে চলে যাবে। সরকার যদি দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেয়, তবে আমাদের অর্ধেক ঘরটা রক্ষা পাবে।
৭৫ বছর বয়সি সুফিয়ান বেগম বলেন, এ নিয়ে কয়েক দফা বসতি বদল করেছেন। শেষ একটি ঝুপড়ি ঘর আছে। সেটিও যদি চলে যায়, আর মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকবে না।
চানপুর গ্রামের অপর বাসিন্দা জানান, চানপুর গ্রামের নদীর পাশে একটি রাস্তা, কবরস্থান ও খেলার মাঠ ছিল। সব নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বিগত সরকারের আমলে আমরা শুনেছিলাম চানপুর নদীভাঙনে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, গ্রাম রক্ষায় ব্লক বসানো হবে। বাস্তবে এর কোনো আলামত দেখা যায়নি। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এবারের বর্ষার পানি কমার সাথে সাথে নতুন নতুন ঘর বাড়ি ভাঙবে। চানপুর গ্রামের বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি না রক্ষা করলে অনেককে বাস্তুহারা হতে হবে।
মোগলগাঁও ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান একে এম আব্দুল্লাহ জানান, চানপুর গ্রাম অর্ধেক নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। ছোটবেলায় নদীর পাড়ে খেলার মাঠে আমরা ফুটবল খেলেছি। এখন সেই মাঠটি সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে চলে গেছে। এই ভাঙন রোধ করতে না পারলে পুরো গ্রামটি রক্ষা করা যাবে না।
নয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা সাগর আহমদ বাপ্পি নামে এক শ্রমিক নেতা বলেন, আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। নদীর পানি যত বাড়ছে, তত পানির সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি আমাদের নিতে হচ্ছে। আমাদের শিশুরা বন্যার পানিতে মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকেন। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সুরমার পানি নামার সাথে সাথে ভাঙনও বাড়বে। আমাদের অনেক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানের চেষ্টায় পশ্চিম দর্শা এলাকায় এক কিলোমিটার ব্লক স্থাপন করা হয়েছে। ওই এলাকা রক্ষা পেলেও বাকি এলাকা এখনো ভাঙনকবলিত। দিন দিন ভাঙন বেড়েই চলেছে। স্থানীয় জনগণ বলেন, শুনেছি জরুরি ভিত্তিতে ব্লক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে বাস্তবে কাজ শুরু হলে আমরা উপকৃত হবো।
বরইকান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মামুন বলেন, গ্রামের মানুষ হতদরিদ্র। এ এলাকাগুলোর অনেক ঘরবাড়ি এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। বতর্মানে ব্লক বসানোর একটা কাজ চলমান রয়েছে। দেখা যাক কতটা এর সফল মিলে।
এদিকে ভাঙনে মোগলগাঁও ইউনিয়নের যোগীরগাঁও অংশে নদীভাঙনে বেশিকিছু পরিবার গত বছর নিঃস্ব হয়ে হয়েছে। নদীভাঙনে গ্রামের মো. আব্দুর রুফ, মোহম্মদ আজির উদ্দিন, বাবুল মিয়া ও আব্দুল আলিমকে আশ্রয় নিতে হয়েছে অন্যগ্রামে গিয়ে।
অপরদিকে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার সমর্থক হওয়ায় মোগলগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এখন পলাতক। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চেয়ারম্যান তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলেও ১৫-১৬ বছরে কিছুই হয়নি।
কান্দিগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মনাফ জানান, তার ইউনিয়নের বেশকিছু গ্রাম সুরমা তীরবর্তী। হেলাখলায় প্রতিরোধমূলক কাজ চলছে। ধনপুর ও ঘোপাল ঢাকাইয়াঘাট এলাকায় নদীভাঙন প্রকট আকার ধারণ করেছে। গ্রামের মানুষের পক্ষ থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে আমিও যাচ্ছি। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আরো আন্তরিক হতে হবে। না হয় এবারের বর্ষার পর আরো ঘরবাড়ি ভাঙতে পারে।
বিগত সরকারের সময় এ গ্রামবাসীকে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। পুরো গ্রামটি ধীরে ধীরে বিলীন হতে চললেও কারো দৃষ্টি পড়েনি সে গ্রামগুলোয়। অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, দ্রুত সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে গুরুত্ব সহকারে ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, সুরমা নদীর সিলেট সদর অংশে ভাঙনের খবর পুরনো। আমরা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। যেসব জায়গা বেশি ভাঙন প্রবণ, সেখানে আমরা বন্যার আগে জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন রোধ করার চেষ্টা করছি। আশা করছি, কিছুটা রক্ষা করা যাবে।