বিভিন্ন দেশে ঈদুল আজহা পালন ও কিছু তথ্য
৪ জুন ২০২৫ ১২:৪২
পাতাবাহার ডেস্ক : ‘ইসলাম’ অর্থাৎ মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা। ‘মুসলিম’ অর্থাৎ যারা আত্মসমর্পণ করে। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের সবকিছু সঁপে দেওয়ার তেমনি একটি ঘটনার হাত ধরে আসে ঈদুল আজহা তথা কুরবানি। এটি বলতে শুধুমাত্র পশু জবাই করা বোঝায় না। এর জন্য রয়েছে কিছু বিধিবিধান। প্রতি বছর একটি নিদিষ্ট সময়ে, নিদিষ্ট মাসে, নিয়ম মেনে এটি পালন করতে হয়। এটি ছিল হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য বিশ্বাসের একটি পরীক্ষা। তিনি স্বপ্নে প্রিয় সন্তানকে কুরবানি দেওয়ার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশপ্রাপ্ত হওয়ার কোনো কিছু না ভেবে নির্দেশ অনুসারে যখন সন্তানকে কুরবানি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, পিতার কষ্ট হবে জেনে প্রিয় পুত্র ইসমাইল পিতার চোখ বেঁধে দিয়েছিলেন এবং কুরবানির পর চোখ খুলে তিনি দেখতে পেলেন পুত্রের জায়গায় একটি দুম্বা কুরবানি হয়ে গেছে। অর্থাৎ তিনি বিশ্বাসের পরীক্ষায় পাস করেছেন।
‘কুরবানি’ এবং ‘হজ’ একই সময় পালিত হয়। ‘হজ’ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। যার শক্তি ও সামর্থ্য আছে তার জন্য জীবনে একবার হজ ফরজ। আরবি পঞ্জিকার দ্বাদশ ও শেষ মাসের (জিলহজ) আট তারিখে শুরু হয়ে বার তারিখে হজ পালন শেষ হয়। এই পাঁচ দিনের বিধিমালার তৃতীয় দিনে বিধি মোতাবেক হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর ঘটনাকে স্মরণ করে শয়তানকে পাথর ছুড়ে মারার পর হালাল পশু কুরবানি দেওয়া হয় (চতুর্থ ও পঞ্চম দিনেও করা যায়)। সমর্পণের এ উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের প্রেক্ষাপটে এভাবে সারা বিশ্বের মুসলিমরা ঈদুল আজহা উদযাপন করে থাকে। পশুর গোশত কিংবা রক্ত কোনো কিছুই মহান আল্লাহর কাছে যায় না। এখানে বিশ্বাসটাই হলো আসল।
বিশ্বে মুসলিম দেশগুলোয় এ উপলক্ষে ছুটি প্রদান করা হয় এবং পুরুষ, মহিলা শিশু-কিশোর সকলে নতুন কিংবা ভালো পরিষ্কার কাপড় পরিধান করে। সকলে সমবেত হয়ে সালাত আদায় করে। তারপর হালাল পশু কুরবানি দিয়ে, তার গোশত তিনভাগে ভাগ করা হয়। নিজের জন্য, আত্মীয়-স্বজনের জন্য, গরিবদের জন্য। এভাবে একে-অপরের মাঝে গোশত বণ্টন করে দিয়ে থাকে। এতে করে সামাজিক সম্পর্কগুলো যেমন শক্ত হয়, তেমনি সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিও বাড়ে। ঈদুল আজহা মুসলমানদের দুটি ঈদের একটি। এভাবে প্রতিটি ঈদ খুশি আর আনন্দের ভেতর দিয়ে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা দিয়ে যায়।
এ পর্যায়ে আমরা জানবো পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কীভাবে এ বিশেষ দিনটি পালিত হয়। জানবো পৃথিবীর কোন প্রান্তে কে কীভাবে পালন করছে তাদের ঐতিহ্য, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছেদ, রীতি-নীতি ইত্যাদি। সেইসাথে প্রধানত অমুসলিম দেশসমূহে মুসলিমরা কীভাবে পালন করে, সেটাও তুলে ধরা হচ্ছে।
কানাডা : অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মতো কানাডার মুসলিম সম্প্রদায় ঈদুল আজহা পালন করে। বন্ধু পরিবার-পরিজনের সাথে সাক্ষাৎ করে, উপহার বিনিময় করে এবং সেই সাথে গরিবদের জন্য ডোনেশনও করে থাকে। ‘ম্যাক’ মুসলিম এসোসিয়েশন অব কানাডা এ উপলক্ষে ঈদ উৎসবের আয়োজন করে থাকে। যেখানে থাকে খেলাধুলা, বিভিন্ন শো, মজার রাইড, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির ব্যবস্থা। এ ধরনের ইভেন্টে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়, অনেক নেতা, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা উপস্থিত থেকে মুসলিম কমিউনিটিকে শুভেচ্ছা জানান।
কানাডায় এ উপলক্ষে পাবলিক ছুটির কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে কিছু ইসলামী সংগঠন নির্দিষ্ট দিনে বন্ধ থাকে কিংবা কাজের সময় কমিয়ে দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্র : যুক্তরাষ্ট্রে খোলাখুলিভাবে (যেভাবে বাংলাদেশসহ মুসলিম দেশে হয়) কুরবানি দেওয়ার সুযোগ-ব্যবস্থা নেই। এখানে কয়েকজন একত্র হয়ে কসাইখানা থেকে একটি সম্পূর্ণ গরু ক্রয় করে, পরে তা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। সেই ভাগ থেকে আবার অল্প অল্প করে পরিচিত পরিবার যারা কাজের ছুটির অভাবে বা অন্য কোনো কারণে কুরবানি দিচ্ছে না তাদের বণ্টন করে থাকে। তবে কয়েকটি স্টেটে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা কসাইখানার তথা পশু বিক্রির ব্যবসার সাথে যুক্ত হওয়ায় নিদিষ্ট ফার্মে গিয়ে সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হচ্ছে। এর জন্য অনেক সময় গোশত পেতে অনেক দূরে কোথাও যেতে হয় কিংবা এক-দুই দিন অপেক্ষা করতে হয়। এক্ষেত্রে কুরবানির পশুর গোশত তৈরি হলে ব্যবসায়ীরা ফোন করে নির্ধারিত স্থান থেকে তা নিয়ে যেতে বলে। অনেক সময় কুরবানিদাতা, নিজের কুরবানির পশুকে এক নজর দেখতেও পারেন না। নিউইয়র্কে এ উপলক্ষে এ ব্যবসার সাথে জড়িতরা দোকানের বাইরে লিখে রাখেন ‘এখানে কুরবানির অর্ডার নেওয়া হয়।’
অনেক মুসলিম শুধু সালাত আদায়ের মাধ্যমে এবং সামাজিক সমাবেশের ভেতর দিয়ে ঈদুল আজহা উদযাপন করে থাকে। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলিমরা নিজ নিজ ঐতিহ্যগত পোশাক পরিধান করে এবং খাবার পরিবেশনের মাধ্যমে এ দিনটি পালন করে। এক্ষেত্রে খাবারে গরু-ছাগল, ভেড়ার ক্রয়কৃত গোশতের নানারকম পদ রান্না হয়। আস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ডসহ যেসব দেশে পশু কুরবানির বৈধতা নেই, সেখানে এভাবেই দিনটি পালন করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রেও ফেডারেল বা সরকারি কোনো ছুটি নেই। তবে নিউইয়র্কে পাবলিক স্কুলগুলো একদিন বন্ধ দেওয়া হয়।
তুরস্ক : তুরষ্কে ঈদুল আজহা উপলক্ষে চার দিনের সরকারি ছুটি বরাদ্দ। এ সময় অফিস, স্কুল, ব্যাংক, পোস্ট অফিস সব কিছু বন্ধ থাকে। তাছাড়া আগের দিনও ‘অফিসিয়াল হাফ ডে’ ছুটি দেওয়া হয়। এ সময় প্রশাসনিক অফিস এবং স্কুলও বন্ধ থাকে। এ উপলক্ষে তারা নতুন কাপড় ক্রয় করে থাকে এবং ঘরে বিভিন্ন পদের খাবার ব্যবস্থা করে থাকে। অনেকে ঘরকে পরিপাটি করে সাজায় এবং ঈদের প্রস্তুতি স্বরূপ কোনো অতিথি যদি রাত্রিযাপনের প্রয়োজন পড়ে, সেই ব্যবস্থাও করা হয়। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে আত্মীয়-স্বজনরা বেড়াতে আসে। অনেকে কবরস্থান পরিদর্শন করে থাকে। অনেকে পরিবারের মরহুম সদস্যদের স্মরণ করে আগের দিন একটি পশু কুরবানি করে নিজেদের জন্য না রেখে তা সম্পূর্ণ গরিব-দুঃখীদের মাঝে দিয়ে দেয়।
তুরস্কে যথা নিয়মে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে দিনটি শুরু হয়। পশু জবাইয়ের আগেও প্রার্থনা করা হয়। অনেকে কুরবানি পশুকে মেহেদি, ফিতা দিয়ে সাজিয়ে থাকেন। অনেকে কুরবানির প্রথম দিন আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাতের জন্য বরাদ্দ রাখে। এ সময় ছোটরা বড়দের হাতে চুমু খেয়ে সম্মান ও অভিবাদন প্রদর্শন করে থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করা শুরু করেছেন। অনেকে দরিদ্রদের বিশেষ সাহায্য করে থাকেন। এ দিনসমূহে যাতায়াত ভাড়া কম করে দেওয়া হয়।
ইউরোপ : যারা ইউরোপে বসবাস করে, কোনো সন্দেহ নেই তাদের দেশের ঈদের উৎসব ও পারিবারিক আমেজ রয়েছে। তবে তার মানে এই নয় যে, ঈদের আনন্দটা একেবারে নীরস হয়ে যায়। এসব দেশে বসবাসরতরা যারা খামার বাড়িতে গিয়ে কুরবানি করার অর্ডার দেয়। দেখা যায় ঈদের দিন সকালের নাশতা সেরে, না সেরে নামাজ পড়ে টোকেনের সময় অনুয়ায়ী জবাইয়ের জন্য নির্ধারিত জায়গায় চলে যায়, আর যারা করে না তারা নামাজ ও ধর্মীয় বক্তৃতা শুনা শেষ করে সেখানে পরিচিত-পরিজন নিয়ে বড় পরিসরে ভোজের আয়োজন করে ঈদের আনন্দে শামিল হয়। যেহেতু অমুসলিম অঞ্চল সেহেতু বিশেষ সুবিধাও নেই। তাছাড়া সেখানে কাজকে আগে প্রাধান্য দিতে হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে অনেককে আবার নামাজ শেষ করে সরাসরি কাজে বা স্কুলে চলে যেতে দেখা যায়। সাপ্তাহিক ছুটিতে তারা একত্র হয়ে ঈদের আমেজে মেতে ওঠেন।
উদাহরণ, জার্মানিতে কয়েকজন কুরবানিদাতা একত্র হয়ে নিদিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট খামারবাড়িতে গিয়ে নিয়ম অনুসারে নির্দিষ্ট পোশাক পরে পশু কুরবানি দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে তারা নিজের পছন্দ ও সাইজ মতো পশু পছন্দ করতে পারেন, খামার কর্তৃপক্ষ গ্রাহককে গরুর গায়ে ঝোলানো নাম্বারের একটি টোকেন দিয়ে সময় জানিয়ে দেন এবং মুসলিম কসাই দ্বারা জবাইয়ের কাজটি করাতে পারেন। বাকি কাটাকুটির কাজ মেশিনে হয়ে থাকে। এ পেশায় মরক্কো ও তুর্কিরা এগিয়ে থাকে।
যেমন- একটি গরুর জন্য দাম আসে জনপ্রতি ৩০০-৩৬৫ ইউরো। অর্থৎ সাত জনে মিলে করলে ২১০০-২৫৫৫ ইউরো হচ্ছে সেই গরুর দাম। প্রতি ভাগে গোশত আসে ৬০-৬৫ কেজি।
চীন : ‘The world Facbook’-এর তথ্যানুসারে চীনে মুসলিমের সংখ্যা ২০মিলিয়ন। আর বড় মুসলিম সম্প্রদায়ের নাম ‘হুই’। ২০১১ সালের শুমারি অনুসারে এদের সংখ্যা ১০.৫ মিলিয়ন। চীন সরকার এদেরকে ethnic group হিসেবে না দেখে ইসলাম অনুসারী হিসেবেই দেখে থাকে। এছাড়া রয়েছে ‘উইঘুর’ সম্প্রদায় যারা জিনজিয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের। এরা ছাড়াও চীনে আরো কিছু সম্প্রদায় আছে যারা মুসলিম।
চীনের সবচেয়ে পুরনো মসজিদের নাম- ‘Huaisheng Mosque’ মহানবী (সা.)-এর চাচা এটা নির্মাণ করেছিলেন। অন্যদের মতো চীনের মুসলিমরা যথারীতি ঈদুল আজহা উদযাপন করে। মুসলিমরা প্রধান প্রধান ধর্মীয় উৎসবে ছুটি পেয়ে থাকেন। প্রতিটি ঘরে ঈদের এক দিন আগে কুকিজ, স্ন্যাক ইত্যাদি বানিয়ে রাখে অতিথি আপ্যায়নের জন্য। বেইজিংযের ‘Niujie Mosque’ হাজার হাজার স্থানীয় মুসলিম নামাজ আদায়ের জন্য প্রতি বছর ঈদগাহে সমবেত হয়।
পৃথিবীর সকল মুসলমানরা একই বিধিবিধান অনুসরণ করে যে যার সামর্থ্য অনুসারে গরু, ছাগল, ভেড়া কুরবানি দিয়ে থাকে। তারতম্য যা হয়, তা শুধু খাবার তৈরি ও পরিবেশনে। আর সরকারি ছুটির পার্থক্য যেমন- সৌদি আরবে ১২ দিন, কুয়েত/কাতার/ওমানে ৯ দিন, ফিলিপাইনে ৩ দিন। তাছাড়া অমুসলিম দেশের মুসলিম প্রবাসীরা, অভিবাসীরা দেশের মতো বাড়ির উঠানে কিংবা পাশের রাস্তায় পশু জবাইয়ের বৈধতা না পেলেও তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির চর্চা করানোর জন্য বিভিন্ন হালাল স্টোর থেকে গোশত ক্রয় করে প্রতিবেশী, বন্ধু পরিচিতদের নিয়ে ভোজের আয়োজন করে থাকে।