ঈদুল আজহার শিক্ষা ও তাৎপর্য


৪ জুন ২০২৫ ১২:৩৬

॥ প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী ॥
মুসলমানদের জীবনে দুটি উৎসব। এক. ঈদুল ফিতর এবং দুই. ঈদুল আজহা। অন্যান্য ধর্মের উৎসবসমূহ সাধারণত তাদের ধর্মগুরুদের সাথে সংশ্লিষ্ট। যিশু খ্রিষ্টের জন্ম উপলক্ষে খ্রিষ্টানরা পালন করে বড়দিন, গৌতম বুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধরা পালন করে বুদ্ধপূর্ণিমা এবং শ্রীকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে হিন্দুরা পালন করে জন্মাষ্টমী। কিন্তু আমাদের দুটি উৎসবের সাথে প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কোনোরূপ সংশ্লিষ্টতা নেই। আল্লাহপাক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন মানুষের সম্মুখে তাঁর পরিচয় তুলে ধরে কেবল তাঁরই আনুগত্য শিক্ষা দেয়ার জন্য। ঈদুল ফিতর হলো রোজা ভাঙার আনন্দ। বান্দা তাঁর রবের হুকুম পালনের দীর্ঘস্থায়ী এক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে সার্বক্ষণিক আল্লাহকে ভয় করে চলার এক শিক্ষা ও প্রেরণা লাভ করে রমজান মাসে সিয়াম পালনের মাধ্যমে। সুষ্ঠুভাবে আল্লাহপাকের হুকুম অর্থাৎ রোজা পালনের মধ্য দিয়ে বান্দা অতীতের সকল গুনাহ থেকে মুক্তিলাভের ফলে উদযাপন করে রোজা ভাঙার আনন্দ ঈদুল ফিতর। আর ঈদুল আজহা হলো পিতা ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগের স্মরণ। মুসলমান আল্লাহর জন্য নিজের জীবন, অর্থ-সম্পদ এবং সন্তান ও পরিবার সবকিছু উৎসর্গ করার প্রেরণা লাভ করে পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগ ও কুরবানির দৃষ্টান্ত থেকে।
আমরা আল্লাহপাকের সার্বক্ষণিক গোলাম। ইসলামের মৌল শিক্ষা তাওহিদ- তা আমাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-ফূর্তি সকল ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়। দুটি আনন্দোৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় তাকবির পাঠ অন্যতম আনুষ্ঠানিকতা। ঈদুল ফিতরে চাঁদ দেখার পর থেকে ঈদের জামাত পর্যন্ত পুরুষের জোরে জোরে এবং মেয়েদের আস্তে আস্তে তাকবির পড়া (আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ) সুন্নত। আর জিলহজের মাসের চাঁদ ওঠার পর থেকেই তাকবির পড়তে হয় এবং ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজ শেষে একবার তাকবির পড়া ওয়াজিব। ইসলামে ব্যক্তিপূজার কোনো অবকাশ নেই। পৃথিবীতে নবী-রাসূলদের আগমন ঘটেছে তাঁদেরকে নয়, বরং আল্লাহর গোলামি করার নিয়মকানুন শিক্ষা দেয়ার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য, নবীদের অবর্তমানে তাঁর অনুসারীরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নবী ও নেক বান্দাদের পূজা শুরু করে দেয় এবং এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে মুসলমানদের মাঝেও ব্যক্তিপূজা লক্ষণীয়। ফলে আল্লাহপাকের জয়ধ্বনি কমই শ্রুতিগোচর হয়। সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে যাতে বাড়াবাড়ি না হয়, সেজন্য তিনি খুবই সতর্ক ছিলেন। তাই তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কখনো সুবহানাল্লাহ, কখনো আলহামদুলিল্লাহ, কখনো আল্লাহু আকবার আবার কখনো ইন্না লিল্লাহ বলতে। উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে সকল অবস্থাতে কেবল আল্লাহরই স্মরণ এবং আল্লাহরই প্রশংসা ও তাঁরই শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা। ঈদ মুসলমানদের জীবনে খুশির বারতা নিয়ে আসে। শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, ধনি-দরিদ্র, মালিক-ভৃত্য সবার মাঝে ঈদ এক অপার আনন্দ নিয়ে ধরা দেয়। নতুন পোশাকে সবাই সজ্জিত হয় এবং ঈদের দিন উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করা হয়। আর এ আনন্দ ভাগা-ভাগি করে নেয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। ঈদের আনন্দে সবাই যাতে শরিক হতে পারে, তার জন্য ঈদুল ফিতরে রয়েছে সাদকাতুল ফিতর এবং ঈদুল আজহায় রয়েছে কুরবানি। এ কুরবানির গোশত নিজেরা খাবে, আত্মীয়-স্বজন ও ফকির-মিসকিনকে দেবে। দুটি ঈদে বেচা-কেনা অনেক বেড়ে যায় এবং দেশের অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়।
ঈদের দিনের অত্যাবশ্যকীয় কাজ হলো দু’রাকাত নামাজ আদায়। আনন্দ-ফূর্তির মাঝেও আল্লাহকে বিস্মৃত হতে মুসলমানরা পারে না। তাই সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ব্যস্ততা শুরু হয় ঈদগাহে নামাজ আদায়ের প্রস্তুতিতে। গোসল সেরে পরিপূর্ণ পাক-সাফ হয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও নতুন পোশাকে সজ্জিত হয়ে পরিবারের সকল সদস্যসহ তাকবির পড়তে পড়তে এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে উপস্থিত হয়। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। ছোট-বড়, ধনি-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, দলমত সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই কাতারবদ্ধ হয়ে আল্লাহর সমীপে নিজেকে লুটিয়ে দেয়। একটিই পরিচয়Ñ তা হলো আমরা সবাই মুসলমান আমাদের আল্লাহ এক, নবী এক, ধর্ম এক, কিবলা এক, গন্তব্যও এক। কোনো হিংসা-বিদ্বেষ নেই, অপরের কোনো অকল্যাণ কামনা নেই, চিন্তাও নেই, পরম করুণাময়ের কাছে নিজের ও অপরের শুধুই কল্যাণ কামনা। নামাজ শেষে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গভীর ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পরস্পরের কল্যাণ কামনা করে ঈদগাহ হতে ভিন্ন পথে গৃহে ফেরেন।
ঈদুল আজহার বড় অনুষঙ্গ হলো কুরবানি করা। হযরত আদম আ.-এর দু’সন্তান হাবিল ও কাবিল কুরবানি করেছিলেন। হাবিল ঐকান্তিক আগ্রহ ও নিষ্ঠার সাথে উৎকৃষ্ট জিনিস কুরবানি করলে তা আল্লাহর দরবারে গৃহিত হয়। পক্ষান্তরে কাবিল অনাগ্রহ ও নিকৃষ্ট জিনিস উৎসর্গ করলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। তাই আমাদের কুরবানি হাবিলের মতো হওয়া উচিত, কাবিলের মতো নয়। কুরবানি মানবসমাজে সবসময়ই কোনো না কোনোভাবে চালু ছিল। বর্তমান মুসলিম সমাজে প্রচলিত কুরবানি মূলত হযরত ইবরাহিম আ. ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগের স্মরণ। হযরত ইবরাহিম আ. যখন আদরের সন্তানের গলায় ছুরি চালাচ্ছিলেন সেসময় আল্লাহপাক এক জন্তুর বিনিময়ে হযরত ইসমাঈল আ.-কে ছাড়িয়ে নেন। এ দৃশ্য ছিল অভাবনীয় এবং আল্লাহর কাছে ছিল খুবই প্রীতিপূর্ণ। স্মরণ হিসেবে কিয়ামত পর্যন্ত তিনি পশু কুরবানি জারি করে দেন। তাঁর ভাষায়, ‘অনাগত মানুষদের জন্য এ বিধান চালু রেখে তার স্মরণ আমি অব্যাহত রাখলাম। শান্তি বর্ষিত হোক ইবরাহিমের প্রতি’-আস সাফফাত: ১০৮-১০৯। কুরবানি সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছিলেন, ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিম আ.-এর সুন্নত’।
আমরা যে পশু কুরবানি করি, তা মূলত প্রতীকী। আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে বর্তমান ইরাকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হযরত ইবরাহিম আ.। তিনি এক পুরোহিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে চতুর্দিকে মূর্তিপূজার সয়লাব লক্ষ করেন এবং তাঁর পিতা স্বৈরশাসক নমরূদের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। মূর্তির অসারতা প্রমাণের জন্য একদিন মন্দিরে প্রবেশ করে তিনি মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলেন। যেহেতু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মূর্তিপূজা, তাই ইবরাহিম আ.-এর এ আচরণকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বিবেচনা করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ভবিষ্যতে কেউ যাতে এ জাতীয় আচরণ করার দুঃসাহস দেখাতে না পারে, তজ্জন্য প্রকাশ্যে আগুনে পোড়ায়ে এ দণ্ড কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেখান থেকে রক্ষা পাওয়ার পর তাঁর জাতির মধ্যে হিদায়াতপ্রাপ্তির কোনো সম্ভাবনা না দেখে দীনের দাওয়াতের লক্ষ্যে দেশত্যাগ করে অজানা পথে তিনি রওনা হন। নিজের রুটি-রুজির কোনো চিন্তা ছিল না, ছিল না কোনো আশ্রয়ের; কেবল আল্লাহরই ওপর ভরসা করে তাঁরই সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাঁর এ যাত্রা। এরপর আল্লাহরই নির্দেশে বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া দুগ্ধপোষ্য শিশু ও স্ত্রীকে নির্জন স্থানে রেখে আসেন। পরীক্ষার পর পরীক্ষা। ছেলে দৌড়াদৌড়ি করার বয়সে উপনীত হলে সে সময় আল্লাহপাক নির্দেশ দেন প্রিয় জিনিসকে কুরবানি করতে। তিনি পশু কুরবানি করেন, কিন্তু একই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু তাঁর ছেলে। তাই তাঁর স্বপ্নের কথা স্ত্রী ও সন্তানকে জানান। তাঁরাও ছিলেন ইবরাহিম (আ.)-এর মতো মুসলিম। ছেলে বললেন, ‘আব্বা! আপনি তাই করুন যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন’। আস সাফফাত: ১০২। আল্লাহপাক এক বড়ো কুরবানির বিনিময়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে নেন এবং পরবর্তীকালে স্মরণ হিসেবে ঘোষণা করে দেন। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং তাঁর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিজের জীবন, ধন-সম্পদ ও রুটি-রুজির চিন্তা পরিহার, মাতৃভূমি, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মায়া সবকিছু ত্যাগের এক উজ্জ¦ল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন হযরত ইবরাহিম আ.। ত্যাগ ও কুরবানি যত বড়, পুরস্কারও তত বড়। তাঁকে ইমাম ও মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
কুরবানির গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূল সা. বলেন, ‘ঈদের দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই’, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি করবে না, সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে’, ‘কুরবানিদাতাকে তার পশুর শরীরের পশমের সমপরিমাণ সওয়াব দেয়া হয় এবং রক্ত জমিনে পড়ার পূর্বেই তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়’। কুরবানি নিজ হাতে দেয়াটাই উত্তম। একান্ত সম্ভব না হলে কুরবানিদাতা যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। মূলত কুরবানি হলো রক্ত প্রবাহিত করা ও রক্ত দর্শন করা। কুরবানির পশু জবেহ করার সময় কুরবানিদাতা এ ঘোষণাই দিয়ে থাকে- ‘নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার যাবতীয় ইবাদত অনুষ্ঠান এবং আমার জীবন ও মৃত্যু কেবল জগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহরই জন্য’। আল আন’আম : ১৬২। অর্থাৎ আমি আমার নই, আমার পরিবার ও জাতিরও নই। আমি একান্তভাবে আল্লাহর। আমার বেঁচে থাকাটা আল্লাহর জন্য এবং আমার মৃত্যুও হবে আল্লাহরই জন্য। আমি এ পৃথিবীতে আমার, আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও দেশবাসীর জন্য যা করি, তা আল্লাহরই নির্দেশক্রমে।
কুরবানি অর্থ ত্যাগ স্বীকার। এর আর একটি অর্থ নৈকট্যলাভ। অর্থাৎ ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমেই নৈকট্যলাভ সম্ভব বিধায় একে বলা হয় কুরবানি। মানবসমাজেও নৈকট্য মূলত ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। মাতা-পিতার সাথে সন্তানের নৈকট্যের মূলে রয়েছে পরস্পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নৈকট্যের মূলেও রয়েছে ত্যাগের মনোবৃত্তি। আমাদের বৈষয়িক জীবনের সাফল্যও ত্যাগ ও কুরবানির বিনিময়েই কেবল সম্ভব। আল্লাহপাক নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে কাউসার অর্থাৎ সীমাহীন প্রাচুর্যতা (নাম, যশ, খ্যাতি, প্রভাব-প্রতিপত্তি) দান করেছেন এবং তা অর্জন ও ধরে রাখার জন্য তাঁকে সালাত আদায় ও কুরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সূরা কাউসার)। এ ওয়াদা সকল মুসলমানের জন্যও। অর্থাৎ জমিনে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য প্রয়োজন আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক ও ত্যাগ স্বীকার। আল্লাহপাক পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগে উদ্বুদ্ধ হওয়ার তাওফিক আমাদের দান করুন।
লেখক: উপাধ্যক্ষ (অব.), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।