আত্মত্যাগের এক অনুপম নিদর্শন
৪ জুন ২০২৫ ১২:৩৩
॥ ডক্টর মোহাম্মদ ইদ্রিস ॥
হজ বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মহাসম্মেলন। প্রতি বছর জিলহজ মাসে পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে আগত মুসলিম মিল্লাত ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ এ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে খানায়ে কা’বায় সমবেত হন। হজ ও কুরবানিতে মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম আ.-এর স্মৃতির নিদর্শনসমূহ ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগই স্মরণ করা হয়। এর পেছনে রয়েছে এক মর্মস্পর্শী মহৎ ইতিহাস। আল-কুরআনের চল্লিশটি সূরায় মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম আ. ও তাঁর আত্মত্যাগের কথা আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেকোনো সামর্থ্যবান মুমিনের জন্য হজ পালন করা ফরজ। যেমনটি পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘সামর্থ্যবান মানুষের ওপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ করা ফরজ। আর যে কুফরী করে, তবে আল্লাহ তো নিশ্চয়ই বিশ্ববাসী থেকে অমুখাপেক্ষী।’ [সূরা আলে-ইমরান: ৯৭]। ইসলামের মৌলিক ইবাদতসমূহ দুই ধরনের। এক-দৈহিক ইবাদত, যেমন নামায, রোজা। দুই-মালের ইবাদত, যেমন সদকা, জাকাত, দান-খয়রাত ইত্যাদি। কিন্তু হজ এমন একটি মৌলিক ইবাদত, যাতে উভয় বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। অর্থাৎ এটি মালেরও ইবাদত এবং দেহেরও ইবাদত। যদিও এটি মহানবী সা.-এর নবুয়্যতি জীবনের শেষের দিকে ফরজ ইবাদত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়, কিন্তু মক্কী সূরাসমূহেই এ প্রসঙ্গে পূর্ব থেকেই আলোচনা শুরু করা হয়। যেমন- আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘যেন তারা নিজেদের কল্যাণের স্থানসমূহে হাজির হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদজন্তু থেকে যে রিজিক দিয়েছেন, তার ওপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে। অতঃপর তোমরা তা থেকে খাও এবং দুস্থ-দরিদ্রকে খেতে দাও।’ [সূরা আল-হজ: ২৮]।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে বর্তমান ইরাকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম আ.। সে সময়ে মানুষ আল্লাহপাককে ভুলে গিয়ে ব্যক্তি ও সৃষ্টির পূজায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। তৎকালীন শাসক নমরূদ শাসন করছিল এবং দাবি করছিল যে, সে নাম্নার (চন্দ্র) দেবতার প্রতিনিধি, তাকে মেনে চললে দেবতারাও খুশি হবে। শাসক ও পুরোহিত একে অপরের সহযোগী হিসেবে সেদিন মানুষের প্রতি জুলুম করছিল। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহপাকের আনুগত্য করার কোনো সুযোগ সে সমাজে ছিল না। মানুষ কল্পিত দেবদেবী ও নিজেদের হাতে গড়া মূর্তির প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পেশ করতো। পুরোহিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও আল্লাহপাকের অনুগ্রহে হযরত ইবরাহিম (আ.) ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি একে একে তারকা, চন্দ্র ও সূর্য সবকিছু অস্বীকার করে সকল সৃষ্টির স্রষ্টা ও মালিক আল্লাহপাককে উপলব্ধি করে ঘোষণা প্রদান করলেন, ‘আমি সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে নিয়োজিত করলাম, যিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ [সূরা আল-আন’আম: ৭৯]।
তিনি তার জাতিকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন, ‘হে জাতির লোকেরা- তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরিক বলে মনে কর, তাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ [সূরা আল আন’আম: ৭৮]। তিনি তার পুরোহিত পিতাকে বললেন, “আর (স্মরণ কর) যখন ইবরাহিম তার পিতা আযরকে বলেছিল, ‘তুমি কি মূর্তিগুলোকে ইলাহরূপে গ্রহণ করছ? নিশ্চয়ই আমি তোমাকে তোমার কওমকে স্পষ্ট গোমরাহিতে দেখছি’। আর এভাবেই আমি ইবরাহিমকে আসমানসমূহ ও জমিনের রাজত্ব দেখাই এবং যাতে সে দৃঢ় বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। অতঃপর যখন রাত তার ওপর আচ্ছন্ন হলো, সে তারকা দেখল, বলল, ‘এ আমার রব’। অতঃপর যখন তা ডুবে গেল, তখন সে বলল, ‘যারা ডুবে যায় আমি তাদেরকে ভালোবাসি না’। অতঃপর যখন সে চাঁদ উজ্জ্বলরূপে উদীয়মান দেখল, বলল, ‘এ আমার রব’। পরে যখন তা ডুবে গেল, বলল, ‘যদি আমার রব আমাকে হিদায়াত না করেন, নিশ্চয় আমি পথহারা কওমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’। অতঃপর যখন সে সূর্য উজ্জ্বলরূপে উদীয়মান দেখল, বলল, ‘এ আমার রব, এ সবচেয়ে বড়’। পরে যখন তা ডুবে গেল, তখন সে বলল, ‘হে আমার কওম, তোমরা যা শরিক কর, নিশ্চয় আমি তা থেকে মুক্ত’।” [সূরা আল-আন’আম : ৭৪-৭৭]।
হযরত ইবরাহিম (আ.) শুধু ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, তার জাতির ভুল ভাঙার জন্য নিজ হাতে মৃর্তিগুলো ভেঙে এর অসারতা প্রমাণ করলেন হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর দুঃসাহসিক কাজকে নমরূদ ও তার সভাসদবৃন্দ সুস্পষ্ট রাষ্ট্র ও ধর্মদ্রোহিতার অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করল। ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ যেন আর কেউ না করতে পারে, সেজন্য জালিমরা তাঁকে প্রকাশ্যে আগুনে পুড়ে মারার ব্যবস্থা করল। এটা হলো হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর ওপর প্রথম পরীক্ষা। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তিনি যখন তাগুতি শক্তির নিকট আত্মসমর্পণ না করে শাহাদাতের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন, তখন আল্লাহপাক তাঁর বান্দাকে এ কঠিন পরীক্ষা থেকে সাফল্যজনকভাবে উত্তীর্ণ করলেন।
হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনে আসে পরীক্ষার পর পরীক্ষা। আগুন থেকে মুক্তি লাভের পর যখন তিনি দেখলেন তাঁর জাতি দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলো, তখন তিনি স্ত্রী হাজেরা ও ভাইপো লুত (আ.)কে সঙ্গে নিয়ে অজানার উদ্দেশে রওনা হলেন। রুজি-রোজগারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না- কোনো আশ্রয়েরও নিশ্চয়তা ছিল না। একজন মুমিন আয়েশি জীবনযাপনের জন্য দুনিয়ায় আসেনি। সকল প্রতিকূল অবস্থায় একনিষ্ঠভাবে আল্লাহপাকের আনুগত্য এবং মানুষকে তাঁর দিকে আহ্বান জানানোই তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য। এভাবে পথে-প্রান্তরে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর বৃদ্ধ বয়সে তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়লেন যে তাঁর অনুপস্থিতিতে এ মিশন কে অব্যাহত রাখবে। এজন্য তিনি আল্লাহপাকের নিকট সন্তান চাইলেন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি একটি পুত্রসন্তান লাভ করলেন। আবারও পরীক্ষা শুরু হলো। আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো স্ত্রী ও সন্তানকে নির্বাসন দানের। তাঁর নির্দেশে সকল মায়া-মমতাকে উপেক্ষা করে স্ত্রী ও সন্তানকে রেখে এলেন এক নির্জন স্থানে। কোনো অভিযোগ নয় বা অনুরোধও নয়, আল্লাহপাকের নির্দেশের নিকট পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করলেন। তাঁর স্ত্রী শুধু জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি আল্লাহপাকের নির্দেশ? জবাবে বললেন হ্যাঁ। সবাই সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিলেন। মূলত আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলাই বান্দার কর্তব্য।
প্রিয়তম সন্তান যখন দৌড়াদৌড়ি করার বয়সে উপনীত হয়, সে সময় আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে আসে আবারও পরীক্ষা। স্বপ্নে তিনি আদিষ্ট হন তাঁর প্রিয়তম বস্তুকে কুরবানি করতে। তিনি পরপর একশ’ উট জবেহ করার পর একই আদেশ প্রাপ্ত হন। তাঁর সবচেয়ে প্রিয়বস্তু ছিল কলিজার টুকরো সন্তান ইসমাইল (আ.) তাঁর স্বপ্নের কথা স্ত্রী ও ছেলেকে জানালে সন্তুচিত্তে সবাই মেনে নিলেন। মুসলিম (আত্মসমর্পিত) পিতার মুসলিম ছেলে পিতাকে জানালেন- ‘পিতা-আপনি তাই করুন, যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। উভয়ই যখন আনুগত্যের মস্তক অবনত করে দিলেন (অর্থাৎ পিতা জবেহ করতে এবং সন্তান জবেহ হতে), তখন আল্লাহপাক ডাক দিয়ে বললেন হে ইবরাহিম, তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎ লোকদের প্রতিফল দিয়ে থাকি। নিঃসন্দেহে ইহা একটি বড় ধরনের পরীক্ষা ছিল। আর একটি বড় কুরবানির বিনিময়ে আমি ছেলেটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর তার প্রশংসা ও গুণ পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে চালু করে দিলাম।’ [সূরা আস সফ্ফাত : ১০২-১০৮]।
আল্লাহপাকের জন্য সবকিছু উজাড় করে দেয়ার যে দৃষ্টান্ত হযরত ইবরাহিম (আ.) জগদ্বাসীর কাছে উপস্থাপন করলেন। বিশেষ করে নিজ হাতে আপন ছেলেকে জবেহ করার যে দৃষ্টান্ত তা আল্লাহপাকের নিকট ছিল বড়ই প্রীতিকর। তাই বান্দার প্রতি সন্তু হয়ে তাঁকে গোটা বিশ্বের ইমাম নিযুক্ত করে দিলেন এবং পরবর্তীকালে লোকদের জন্য এটাকে স্মরণ হিসেবে জারি করে দিলেন। আমাদের এ কুরবানি মূলত মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগেরই স্মরণ। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ কুরবানিগুলো কী? তিনি জবাবে বললেন ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিমের (আ.) সুন্নত।’ (ইবনে মাজাহ)।
হজের আনুষ্ঠানিকতা ও কুরবানির মধ্যে হযরত ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পরিবারের অনেক স্মৃতিই আমাদের স্মরণ করে দেয়। পশু কুরবানির মাধ্যমে কুরবানি দাতা এ ঘোষণাই প্রদান করে, ‘বল, নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু আল্লাহর জন্য, যিনি সকল বিশ্ব সৃষ্টির রব।’ (সূরা আল-আন’আম : ১৬২)। অর্থাৎ না আমি আমার, আর না পরিবার-পরিজনের জন্য। বরং আমি নিজের বা পরিবার বা মানুষের প্রতি যে দায়িত্ব পালন করি, তা কেবল আল্লাহ তায়ালারই নির্দেশক্রমে- তাঁরই সন্তুষ্টির লক্ষ্যে করি। কুরবানির সময় কুরবানিদাতা আল্লাাহ তায়ালার কাছে এ ওয়াদাই করে থাকে।
হজ বলতে ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান ও পবিত্র কা’বাঘরের জিয়ারতসহ অন্যান্য বিধিবিধান পালনকে বোঝানো হয়। প্রাচীনত্বের বিবেচনায় কা’বা বিশ্বের সর্বপ্রথম গৃহ। আর মর্যাদার বিবেচনায়ও কা’বা অতুলনীয়। কারণ কা’বা ব্যতীত বিশ্বের আর কোনো স্থাপত্য, ইমারত কিংবা গৃহ নাই যার তাওয়াফ করা হয়। এই মর্যাদাপূর্ণ ঘরকে কেন্দ্র করে যেমন হজের শুরু এবং বিদায়ী তাওয়াফ দিয়ে শেষ হয়। ইবরাহিম আ. মানুষের নিকট হজের ঘোষণা দানের পর থেকে মক্কা ও ও তার আশপাশের লোকেরা হজ করা আরম্ভ করেন। আর এ ধারা পরবর্তী যুগে অব্যাহত ছিল। ইবরাহিম আ.-এর পর যত নবীর আগমন হয়েছে তারা প্রত্যেকেই হজ করেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। বায়তুল্লাহ জিয়ারত বা হজ মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম আ.-এর স্মৃতির নির্দশনসমূহ ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগেরই স্মরণ। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাঁর সন্তুষ্টির জন্য হজের মহাসম্মেলনে অংশগ্রহণ ও একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই কুরবানি দানের তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাঁথিয়া মহিলা ডিগ্রি কলেজ ও নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক জীবনকথা, পাবনা।