দাম্পত্য কলহ
৪ জুন ২০২৫ ১২:০৭
॥ শহীদ সিরাজী ॥
দাম্পত্য নারী-পুরুষের সম্পর্কের নাম। ইংরেজিতে পড়ঁঢ়ষব বলতে যা বোঝায়, বাংলায় তাকেই দম্পতি বলে। দম্পতি শব্দের অর্থ স্বামী-স্ত্রী। বিবাহিত নারী ও পুরুষ মিলে তৈরি হয় দাম্পত্য সম্পর্ক। দম্পতিদের জীবনযাপনই হচ্ছে দাম্পত্য জীবন। দাম্পত্য খুবই সংবেদনশীল সম্পর্ক। হৃদয়ঘটিতও বটে। শুধু হৃদয় নয়, এর সঙ্গে রয়েছে পারস্পরিক বোঝাপড়া বা কর্মকাণ্ডে সম্পর্ক।
নারী সম্পর্কিত চমৎকার হাদিস- আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার নবীজি সা. তাঁর কতক স্ত্রীর কাছে এলেন। তখন তাঁদের সঙ্গে সাহাবা উম্মু সুলাইমও ছিলেন। নবীজি বলেলেন, ‘সর্বনাশ, হে আনজাশাহ, তুমি উট ধীরে চালাও। কেননা তুমি কাচপাত্র (মহিলা) নিয়ে চলেছ।
এভাবেই নবীজি স্ত্রীদের কাচের সাথে তুলনা করেছেন। মায়ার বাঁধনে আগলে রাখতে বলেছেন। ঠিক কাচের জিনিসপত্র যেমন নিরাপদ জায়গায় রাখতে হয়, তেমনি। একটু বেশি যত্ন নিতে বলেছেন। সতর্কতার সাথে ব্যবহার করতে বলেছেন; না হলে কাচের জিনিসের মতো সহজে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারে। নারীদের হৃদয় কোমল। একটুতেই তারা ভীষণ আঘাত পায়! এ কারণেই নারীদের সাথে কোমল আচরণ করাই এ হাদিসের শিক্ষা। এটাই বাস্তবতা।
দাম্পত্য জীবনের শুরু যেভাবে
এখানে যে দাম্পত্য জীবনের কথা বলা হচ্ছে, তা শুরু হয়েছে সৃষ্টির শুরু থেকেই। পৃথিবীতে আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধি পাঠানোর পরিকল্পনা থেকে আদমকে আ. সৃষ্টি করছিলেন। প্রথম মানব আদম বাস করতেন জান্নাতে। সেখানে ছিল না কোনো অশান্তি, অভাব-অনটন, দুশ্চিন্তা। চারদিকে ছড়ানো ছিল কেবল প্রশান্তি। ছিল রকমারি খাবার, হরেক রঙের ফুল, নানা স্বাদের ফল।
চাইতেও হতো না; মনের খেয়ালই যথেষ্ট। সাথে সাথে হাজির হয়ে যেত সবকিছু। হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে যেত অসংখ্য প্রাপ্তিতে। এতকিছুর ভেতরে বাস করেও আদম হৃদয়ে অনুভব করত এক শূন্যতা। তাঁর ছিল না কোনো বন্ধু। ছিল না কোনো সাথী যার কাছে প্রশান্তি পেতে পারেন। সবসময় নিজেকে বড় একলা একলা লাগতো।
একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলেন মাথার কাছে বসে আছেন এক নারী। তারই মতো অবয়ব। খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন এ নারীর আগমন তাঁর একাকিত্ব ঘোচাতে। প্রশান্তির জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর আল্লাহর আদেশে তাঁরা পরস্পরে বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীতে পরিণত হলেন। অপরিসীম আনন্দে বাস করতে লাগলেন জান্নাতে। সুখেই দিন কাটছিল তাঁদের। এরপর জীবনের নেমে এলো এক পরীক্ষা। আল্লাহ আদমকে বললেন, ‘তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে থাকো। যা ইচ্ছা খাও। (এরপর বিশেষ একটি গাছ দেখিয়ে বললেন) তোমরা এর কাছেও যাবে না। অন্যথায় জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (বাকারা : ৩৫)।
এদিকে ইবলিস তাঁদের ধোঁকায় ফেলতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো। শেষে ইবলিসের কুমন্ত্রণার ফাঁদে পড়ে আল্লাহর আদেশ ভুলে গিয়ে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে ফেললেন তাঁরা। জান্নাত থেকে বের করে তাঁদের পৃথিবীতে পাঠানো হলো। আদম-হাওয়া নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে বেশ অনুতপ্ত হলেন। ক্ষমা চাইলেন মহান রবের কাছে। আল্লাহ মেহেরবান। তিনি ক্ষমা করলেন। বিশেষ দোয়া শিখিয়ে দিলেন।
‘রাব্বানা জালামনা, আনফুসানা ওয়াইন-লাম তাগফিরলানা, ওয়াতারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খাসিরিন।’ ‘হে আমাদের রব, আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন, আমাদের দয়া না করেন, তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব।’ (আ’রাফ : ২৩)।
আল্লাহ ক্ষমা করলেন। তবে পাঠিয়ে দিলেন পৃথিবীতে। এভাবেই তাঁরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পৃথিবীর দাম্পত্য জীবন শুরু করলেন। আদম-হাওয়ার যে দাম্পত্য জীবন শুরু হয়েছে, তা এখনো চলছে শতাব্দী-যুগ-বংশ পরম্পরায়। আদি পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে মানবসমাজে পৃথিবীর ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত এটা চলতেই থাকবে।
মহান রাব্বুল আলামিনের পরিকল্পনায় গঠিত হয়েছে পরিবার। স্বামী-স্ত্রী মিলে দাম্পত্য জীবন প্রতিনিয়তই গঠন করছে নতুন নতুন পরিবার। এভাবেই চলে আসছে তা বংশ পরম্পরা। বেঁচেও আছে দাম্পত্য জীবন পরম প্রশান্তিতে। স্বামী-স্ত্রী প্রেম, ভালোবাসা, ধৈর্য, ত্যাগ ও পরস্পরের প্রতি নিঃসীম মমতায়। এভাবেই পৃথিবীর মানুষ পরিবার নামের নৌকায় চড়ে পাড়ি দিচ্ছে জীবনটা।
অশান্তির কারণ
যে দাম্পত্য জীবন রয়েছে প্রশান্তি; বিস্ময়করভাবে তা কখনো কখনো হয়ে পড়ছে অশান্তির কারণ। কোনো না কোনোভাবে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দেখা দিচ্ছে দাম্পত্য কলহ। এর কারণ কি?
মানুষ তো কেউ ঋষি-মনীষী বা দুনিয়াত্যাগী নয়। তাদের মধ্যে রয়েছে ষড়রিপুর বাস। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। অনেকেই তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে আবার অনেকে হয়ে পড়ে এ ষড়রিপুর দাস।
চায় অর্থবিত্ত, চায় খ্যাতি-সম্মান প্রতিপত্তি। তবে যারা অল্পে তুষ্ট, যাদের রয়েছে আল্লাহর প্রতি ভয় তাদের কোনো সমস্যা নাই। লোভ যাদের লাগামছাড়া, যারা পরকাল ছেড়ে দুনিয়ার উন্নতিই একমাত্র উদ্দেশ্য করে নেয়, তাদের সংসারে ঘটে অঘটন। দাম্পত্য জীবন চলে না সরলপথে। বিভিন্ন কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দেখা যায় দ্বন্দ্ব। হারায় স্বাভাবিক ছন্দ। আস্তে আস্তে তা কলহে রূপ নিতে থাকে। মনের ভেতরে প্রশান্তির বেহেশত, হয়ে পড়ে অশান্তির জাহান্নাম।
দাম্পত্য কলহের মৌলিক কারণ
আদম-হাওয়ার দাম্পত্যের উত্তরাধিকার যারা, তাদের ভেতর কেন সৃষ্টি হয় দাম্পত্য কলহ। অবশ্য এর রয়েছে অনেক কারণ। মোটাদাগে তার কিছু উল্লেখ করা হচ্ছে-
– স্বামী-স্ত্রীর ভুল বোঝাবুঝি, মান-অভিমান,
– ছোট-খাটো বিষয়েও তর্ক-বিতর্ক করা,
– ধৈর্যহীন হওয়া,
– পরস্পরকে সময় না দেয়া,
– সম্মানবোধের অভাব,
– পরস্পরের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়া,
– পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা,
– অযথা বা অকারণে রাগ দেখানো,
– পরস্পরকে অবমূল্যায়ন করা,
– অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়া,
– মন খুলে কথা বলতে না পারা,
– বিরক্তি থেকে কলহের সৃষ্টি,
– মান-অভিমান থেকে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া,
-পরস্পর আত্মীয়-স্বজনকে সম্মান না দেখানো,
– অর্থের প্রতি অধিক মোহ বা লোভ,
– নিজের মধ্যে অহমবোধ,
– হৃদয়বৃত্তিতে বা স্বভাবগত নির্মম হওয়া,
– স্বামী বা স্ত্রীকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করা,
– একজন অন্যের পরিবার নিয়ে বিদ্রুপ করা,
– মতপার্থক্যকে ছাড় না দেওয়া,
– ধৈর্য ও ত্যাগের অভাব,
– আল্লাহভীতির অভাব হলে।
দাম্পত্য কলহের অন্যতম কারণ এগুলো। এর অভাব হলে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। দেখা দেয় দাম্পত্য কলহ।
দাম্পত্য কলহ থাকা অস্বাভাবিক নয়
বাস্তবতা হচ্ছে দাম্পত্য কলহ সব দম্পতির মধ্যেই কমবেশি হতে পারে। তবে তা যদি হয় ছোট-খাটো কলহ কিংবা স্বল্প সময়ের মান-অভিমান পর্যায়ের, তাহলে তা দাম্পত্য সম্পর্ককে আরও শক্ত ও মজবুত করে। তবে অতিরিক্ত বা ক্রনিক ঝগড়ার প্রবণতা সৃষ্টি হলে অবশ্যই তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এ সম্পর্কে বিচ্ছেদের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। এছাড়া মনোবৈকল্যের সৃষ্টি হতে পারে। কঠিন হৃদরোগ হয়ে মৃত্যুঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
দাম্পত্য কলহের প্রভাব
দাম্পত্য কলহ কি শুধু মাত্র দম্পতির ক্ষতি করে? না, বরং পুরোপুরি পরিবেশেরই ক্ষতি করে। এটা হঠাৎ ঝড়ের মতো। ভূমিকম্পের সাথেও তুলনা করা যেতে পারে। প্রভাব পড়ে আশপাশে মানুষের ওপর। পরিবেশের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমনকি আপন সন্তানদের ওপরেও ভয়ানক নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসে।
নিজেদের সমস্যা : দাম্পত্য কলহে শুধু মানসিক সমস্যা নয়, শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। ‘সাইকোলজি টুডে’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দাম্পত্য কলহ একটি বিষাক্ত বা টক্সিক সম্পর্ক। এতে দম্পতির শুধু ভয়ানক শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিই নয়, বরং বহুমাত্রিক ক্ষতি করতে পারে। যেমন- মনোবৈকল্য সৃষ্টি হতে পারে দাম্পত্য সম্পর্ক বিষাক্ত হলে তা মানসিক স্ট্রেসের কারণ হয়। তা আবার দীর্ঘস্থায়ী হলে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। ইমিউন সিস্টেমের স্বাস্থ্য, থাইরয়েড ও মেজাজের ব্যাধির ঝুঁকি বাড়ায়।
উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি : ২০১৬ সালের এক সমীক্ষায় মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখেন, বিবাহিতদের মধ্যে দাম্পত্য রেষারেষি ও নিত্যকলহের কারণে পুরুষ নারী উভয়ের মধ্যকার মানসিক চাপের ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। এ চাপ দীর্ঘমেয়াদের হলে তা উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়।
শারীরিক প্রদাহ বাড়ে : হার্ভার্ড হেলথের মতে, মানসিক উত্তেজনার কারণে শরীরে প্রদাহের মাত্রা বাড়তে পারে, যা ক্রমেই গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার দিকে নিয়ে যায়। সাইকোলজিক্যাল বুলেটিন জার্নালে প্রকাশিত ২০১৪ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, স্ট্রেস উল্লেখযোগ্যভাবে ইমিউন সিস্টেমকে পরিবর্তন করে ও প্রদাহ বাড়ায়।
বিষণ্নতা বাড়ে : দাম্পত্য লাইফ ভালো না থাকলে বিষণ্নতা সৃষ্টি হয়, যা জীবনের ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণা বলছে, সামাজিকভাবে কোনো মানুষকে দীর্ঘসময় ধরে অবহেলা করলে তার মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার (এমডিডি) এর ঝুঁকি বেড়ে যায়। এমন দাম্পত্যে অশান্তির কারণে যে কেউই মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারেন।
আয়ুও কমে যেতে পারে : দীর্ঘমেয়াদের দাম্পত্য অশান্তি আয়ুও কমিয়ে দিতে পারে। দাম্পত্যে সুখ থাকলে যেমন আয়ু বাড়ে, তেমনি একটি বিষাক্ত সম্পর্কের মধ্য দিয়ে জীবন কাটালে আয়ু কমে যেতে পারে।
এছাড়া মানসিক চাপ জীবনধারা পরিবর্তন করে দেয়। ফলে কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। কারও ঘুম কমে যায়, মানসিক চাপ বাড়ে। এসবের কারণে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
২০১৬ সালে ‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস’র রিপোর্ট করা এক সমীক্ষায় জানা যায়, সামাজিক সম্পর্ক ও মৃত্যুহারের মধ্যে সম্পর্ক আছে।
হৃদরোগ ঝুঁকি বাড়তে পারে : দাম্পত্য জীবন বিষাক্ত হওয়ার কারণে হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ে। দ্য জার্নাল অব জেরোন্টোলজি সিরিজ বি’তে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, মানসিক চাপ রক্তচাপ বাড়ায় যা অনেক গবেষণায় দেখা গেছে। দীর্ঘদিন এ সমস্যায় ভুগলে তা হৃদরোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষতি করতে পারে । এছাড়া আরও কিছু সমস্যা দেখা যায়। যেমনÑ মাথা ঘোরা, শরীর ব্যথা ও যন্ত্রণা, মাথাব্যথা, পেশিতে টান, ঘুমের সমস্যা, হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, চরম ক্লান্তি, পেট খারাপ কিংবা কাঁপুনি।
‘দাম্পত্য জীবন’ সম্পর্কে কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতামত
১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘একটা চিরায়ত সমাজ থেকে আধুনিক সমাজের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যে কারণে সমাজের এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। প্রযুক্তির নানামুখী প্রভাবে পাশ্চাত্যের অনেক মূল্যবোধ এ সমাজেও ঢুকেছে। এগুলো আমাদের জীবনযাপনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়ায়ও বড় পরিবর্তন আনছে।’ বস্তুত এ কারণে দাম্পত্য জীবনে প্রভাব পড়ছে, দাম্পত্য কলহ বাড়ছে।
২. সমাজবিজ্ঞানী ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, আমরা এখন ফিউডাল সোসাইটি বা সামন্ত সমাজ থেকে নিউলিবারাল ক্যাপিটালিজম সোসাইটি বা নব উদার পুঁজিবাদী সমাজের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এতে সমাজে ভাঙন দেখা যাচ্ছে। আমরাও একটা যুদ্ধে রয়েছি। যুদ্ধে নারী ও শিশুই বেশি শিকার হচ্ছে।
৩. সামাজিক অস্থিরতাকে দায়ী মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের চেয়ারম্যান সাইফুদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, ‘সমাজে অস্থিরতা বেড়ে গেছে। প্রযুক্তির কারণে মানুষ তার নিজস্ব পরিমণ্ডলের বাইরে যোগাযোগের অনেক সুযোগ পাচ্ছে। স্বামী বা স্ত্রীর নানারকম সংযোগ তৈরি হওয়া অস্থিরতার একটা কারণ। এছাড়া মুহূর্তেই ক্লিক করে নতুন নতুন জগৎ দেখতে পাচ্ছে। সামনে নতুন বলে কিছু নাই। ফলে বেঁচে থাকার যে আগ্রহটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জীবনের যে তাৎপর্য বা বেঁচে থাকার যে আনন্দ সেটা উপভোগ করার আগ্রহ তৈরি হয় না।’
৪. দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতি প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের চেয়ারম্যান সাইফুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বিয়ে একটি ধর্মীয় চুক্তি। সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রেখে যার সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তাকে হত্যা করতে গেলে ভয় পাওয়ার কথা। কারণ যদি মেরে ফেলা হয়, তবে তার শাস্তি অবধারিত। কিন্তু ধর্মের প্রতি বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে গেলে হত্যার মতো অপরাধের সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করে না মানুষ। তাই বিয়েকে শুধু আইন এবং প্রথার জায়গা থেকে না দেখে ধর্মকে নিজের মধ্যে ধারণ করলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে।’ প্রযুক্তির নানামুখী সুযোগের হাতছানি দাম্পত্য জীবনে প্রভাব ফেলে বলে তিনি মনে করেন। কখন কখন একজন আরেকজনকে প্রতিপক্ষ মনে করে। এটি বর্তমানে মারাত্মক আকার ধারণ করছে।
৫. স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কগুলো পরস্পর ভালোবাসা মমতার মাধ্যমে এগোয়। তবে কোনো কারণে যখনই মতবিরোধ হয়, সেখানে একে অন্যকে গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকে না। সম্পর্কের প্রতি সহনশীলতা কমে যাওয়া বা একে অন্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। মেনে নেয়ার জীবনমুখী বিদ্যার অভাবও দেখা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মনোবিদ ‘মেখলা সরকার’ বলেন, ‘অল্পতেই উদ্বেগবোধ করা, মানসিক চাপ মোকাবিলা করার ক্ষমতা কম, নানা ধরনের অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে ভোগা- এমন সমস্যা যেসব দম্পতির রয়েছে তারা যদি সমস্যায় পড়েন, তাহলে তারা এত বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেন, যা অনেকক্ষেত্রেই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ফলে সঙ্গীর সঙ্গে অনাকাক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটিয়ে থাকে।’
উপরে উল্লেখিত বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণগুলো দাম্পত্য জীবনের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। সকল দম্পতিকেই এ ব্যাপারে জানতে হবে, জীবনে অনুশীলন করতে হবে, কোনো স্খলনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
দাম্পত্য কলহে সন্তানদের ওপর প্রভাব
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে, শিশুদের আদর্শ হলো তাদের বাবা-মা। যখন সে তাদের ঝগড়া করতে দেখে, তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার প্রভাব পড়ে। কচিমনের এ প্রভাব খুবই নেতিবাচক হয়। বাবা-মায়ের প্রকাশ্য ঝগড়া-ঝাঁটি ও সংঘর্ষ তারা দেখতে পায়। এছাড়া যদি তারা একে অপরের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন, একজন আরেকজন অবহেলা করতে থাকেন, উপেক্ষা করে কথা বলেন তখনো কিন্তু শিশুদের ওপর বড় রকমের প্রভাব পড়ে। শিশুর মানসিক, আবেগ অনুভূতি, আচরণ এবং সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রেও তখন সমস্যা হতে পারে।
বাবা-মায়ের এ দ্বন্দ্ব শিশুমনে দাগ কাটে। শিশু গবেষকদের মত, শিশু ছয় মাস বয়স থেকেই পারিবারিক অশান্তি অনুভব করতে পারে, বুঝতে পারে তার ওপরের ছায়া নড়বড়ে। একবার ভাবুন, এ ছোট্ট সোনামণি তখন তার বেড়ে ওঠার মানসিক শক্তিটুকু কোথায় পাবে?
শিশু বিশেষজ্ঞের মতামত, ‘বাবা-মায়ের কলহ শিশুদের মনে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তাতে তাদের ঘুমেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে, মস্তিষ্কের প্রাথমিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা তৈরি হতে পারে, স্কুলে তার আচার-আচরণে সমস্যা হতে পারে। এছাড়া শিশু বিষণ্নতায় ভুগতে পারে, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা দেখা যেতে পারে। আর যখন ওরা একটু বড় হয়, তখন হতাশা থেকে তাদের মধ্যে নিজের ক্ষতি নিজে করার প্রবণতা দেখা যায়।’
সমাজ জীবনে অনেক প্রমাণ রয়েছে, পারিবারিক কলহের মধ্য দিয়ে যে ছেলেসন্তান বড় হয়; কিছুটা বড় হওয়ার পর তাদের মাদকাসক্তি, অবাধ্যতা, মারামারি করার প্রবণতা বেশি থাকে।
দাম্পত্য কলহের কারণে উপরে যে ভয়ানক সমস্যার কথাগুলো জানলাম, তা কিন্তু ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। নিজেদের ভুল বোঝাবুঝি, অসহনশীলতার অভাব, না মেনে নেয়ার প্রবণতা টুকিটাকি বিষয় নিয়ে ঝগড়াই লিপ্ত হয়ে একজন দম্পতি কীভাবে তার দাম্পত্য জীবনকে ধ্বংস করতে পারে? তারা কি একবারও ভাবতে পারে না, তাদের সন্তানের কথা তারা কতটা অসহায়। অন্তত আদরের সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও দম্পতিদের সতর্ক হওয়া উচিত।
কেস স্টাডি
দাম্পত্য কলহের কিছু ভয়াবহ চিত্র
ঘটনা ১
নোয়াখালীর চাটখিলের ভাওর গ্রামের আবদুর রহিমের সঙ্গে একই উপজেলার বানসা গ্রামের সামছুল আলমের মেয়ে ফাতেমার বিয়ে হয়। আবদুর রহিম পেশায় নির্মাণশ্রমিক। তাঁদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। বিয়ের পর থেকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ চলছিল। সেদিন সন্ধ্যার দিকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ঝগড়ার জেরে স্ত্রী ফাতেমা আক্তার বিষপান করেন। স্ত্রী বিষ পান করার পর রাগে-ক্ষোভে স্বামী আবদুর রহিমও বিষ পান করেন। বাড়ির অন্যান্য লোকজন বিষয়টি টের পেয়ে সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাঁদের দুজনকে উদ্ধার করে পার্শ্ববর্তী সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক স্ত্রীকে মৃত ঘোষণা করেন। (প্রথম আলো ২৪ এপ্রিল ২৫ রিপোর্ট)।
ঘটনা ২
জানা গেছে, দাম্পত্য কলহের জেরে সকাল ১০টার দিকে সুলেখা বেগম ও রব মিয়ার মধ্যে ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে রব মিয়া উত্তেজিত হয়ে ঘরে থাকা ধারালো ছুরি দিয়ে স্ত্রী সুলেখার গলা কেটে তাকে হত্যা করেন। এ সময় আশপাশের লোকজন চিৎকার শুনে এসে ঘরে সুলেখার রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন এবং থানা পুলিশকে জানান। খবর পেয়ে পুলিশ নিহতের মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য জেলা সদরের নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতাল মর্গে পাঠান।
(আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ ২৩ এপ্রিল ২৫)।
ঘটনা ৩
ঝালকাঠিতে আদালতের কক্ষে পরনের শাড়িতে কেরোসিন ঢালার পর আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন এক নারী। তবে আদালতে উপস্থিত পুলিশ ও বিচারপ্রার্থীরা তাৎক্ষণিক ছুটে এসে আগুন দেওয়া থেকে তাঁকে নিবৃত্ত করলে কোনো অঘটন ঘটেনি।
জানা গেছে, নলছিটি উপজেলার দপদিপয়া ইউনিয়নের কয়া গ্রামের এইচ এম শাহ আলমের মেয়ে নুসরাত জাহান তাঁর স্বামী আল আমিনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। মামলাটির ধার্য তারিখে বাদী নুসরাত জাহান তাঁর স্বামী আল আমিনের সঙ্গে পুনরায় সংসার করার জন্য জামিনের আবেদন করেন। কিন্তু স্বামী আল আমিন নুসরাতের সঙ্গে সংসার করতে চান না।
আদালতের এজলাসে মামলা ওঠার আগে সংসার করা নিয়ে কাঠগড়ার সামনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বাদানুবাদ হয়। একপর্যায়ে কাঠগড়ার সামনে নিজের পরনের শাড়িতে কেরোসিন ঢালেন নুসরাত জাহান। এরপর তিনি ম্যাচ বের করে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে আদালতে উপস্থিত পুলিশ ও বিচারপ্রার্থীরা তাৎক্ষণিক তাঁকে নিবৃত্ত করেন। (ঘটনা: ২৫ মে ২৫)।
প্রশ্ন হলো, যে ঘটনাগুলো এখানে উল্লেখ করা হয়েছে তার দায়ভার কার? কার ভুল আর কে তার মাশুল দেবে? বাবা কিংবা মায়ের মৃত্যু সন্তানের জন্য কতটুকু ভয়াবহ সেটা কি বাবা-মা বুঝবে না? তাদের ভুলের কারণে যে অঘটন ঘটেছে যার ফলে তাদের জীবন দিতে হয়েছে এর পাপ কে বহন করবে। সে তার ইহকাল দেবো নষ্ট করেছে তখন পরকালও। কী ভয়ানক দুর্ভাগ্য এমন দম্পতির!
শেষ কথা
পুনশ্চ আমাদের ভাবতে হবে; যে ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো যেমন ভয়াবহ, তেমনি বেদনাদায়ক। এসবই আমাদের অবক্ষয়ের ভয়ানক চিত্র। এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়তই সমাজে ঘটছে। এ থেকে বাঁচার উপায় কী?
আসলে দম্পতিরাই হচ্ছে সমাজ বিনির্মাণের মূল কুশীলব। তাদেরই সতর্কতার সাথে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। ক্রোধ, অহমিকা থেকে দূরে থাকতে হবে।
স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, পরস্পরকে সম্মান দেখানো, একটু সহানুভূতি, একটু মমতা, পরের প্রতি যত্নবান হওয়া, ধৈর্য ও ক্ষমা, কম্প্রোমাইজিং দৃষ্টিভঙ্গিই সুরক্ষা দিতে পারে দাম্পত্য জীবনকে। মনো বিয়াবান হয়ে উঠতে পারে সুখের জান্নাত।