দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র শক্ত হাতে রুখতে হবে
৪ জুন ২০২৫ ১১:৫৩
॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
সবার উপরে বাংলাদেশ। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার চিন্তা রাখতে হবে- বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়া। আওয়ামী লুটকারী টাকার লোভে এবং বৈদেশিক প্রভুদের আশ্বাসে ক্ষমতার মোহে কিছু এ দেশীয় দালাল জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। বিপ্লবের শহীদ, আহতদের যারা সম্মুখসমরে গুলি করে হত্যা করল, আহত করল, তাদের বিচার না করেই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে নির্বাচন নির্বাচন জিগির তুলেছে। বিএনপির নেতারা যেমন- নির্বাচনের জিগির করছে। তাদের ছেলে, আত্মীয়, কর্মীরা কতজন এ বিপ্লবে শহীদ ও আহত হয়েছে, আমার জানা নেই। যারা মায়ের কোল খালি করল, যারা হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে আহত ও পঙ্গু করল তাদের বিচারের আওতায় না এনেই দ্রুত নির্বাচনের দাবি করছেন, আমরা তাদের সমর্থন করতে পারি না। গত কয়েক মাস ধরে বড় দলের নেতা-কর্মীদের একটা অংশ দেশজুড়ে যেভাবে চাঁদাবাজি করছে, তা পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলনামাকে অতিক্রম করছে। এতে আর যাই হোক না কেন, ভোটের জনমত সৃষ্টিতে মারাত্মক বাধার সৃষ্টি করবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার চেষ্টা করছে তাদের ক্ষমতানুযায়ী দেশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার। দেশের আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করার। চোর-বাটপারদের লুট করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার। আমরা এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়াতে চাই। ইতোমধ্যেই ইউনূস সরকার বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার কাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। জাতিসংঘসহ আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, জাপান সবাই ড. ইউনূস সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পতিত সরকারের অনেক ঋণ পরিশোধ করেছে সরকার। রিজার্ভের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এগিয়ে চলছে। সম্প্রতি বাণিজ্য উপদেষ্টা জানালেন, শিল্প কারখানায় গ্যাস পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। মালয়েশিয়ায় গত সরকারের সিন্ডিকেটের কারণে কয়েক হাজার কর্মী যাওয়া বন্ধ হয়েছিল, তা আবার চালু হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম কমতে শুরু করেছে।
এসব দেখে স্বৈরাচারের দোসররা এবং নব্য বিএনপির কিছু নেতা, যারা ভারতের হয়ে এবং লুট করা টাকার ভাগ পেয়ে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে তারা। সংস্কার, বিচার ছাড়াই আগের মতো যেনতেনভাবে নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে মেতে উঠেছে। নিজেরাই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার অলীক কল্পনায় মেতে উঠেছে। জনগণ যে ইতোমধ্যে এসব নেতার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে, তা কয়েকদিনের মধ্যেই টের পাবে নেতারা।
জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দল ও দেশদরদি রাজনৈতিক নেতারা সংস্কার ও বিচারকাজ দ্রুত সেরে যৌক্তিক সময়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে। ঐকমত্য সংস্কারের কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। দ্রুতই শেষ করে সনদের ওপর গণভোট করে জনগণের ম্যান্ডেট নিতে হবে। সব ষড়যন্ত্রের দাঁত ভেঙে দিতে হবে জনগণের ভোট নিয়েই। শহীদ জিয়াউর রহমানের সময়ও গণভোট হয়েছিল। বর্তমানেও জনগণের প্রায় সবাই দেশের ভালো চায়- স্বৈরাচারের দোসরসহ বর্তমানের দেশদ্রোহীদের বিচার করেই আমরা জনতার ইচ্ছানুযায়ী গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। নির্বাচন কমিশন আশা করি, ভালো নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারবে। আগেই বলেছি, স্থানীয় নির্বাচন আগে দিতে হবে। স্থানীয় প্রতিনিধিরা সব পালিয়ে গেছে। স্থানীয় প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। তাই স্থানীয় নির্বাচন আগে করলে স্থানীয় প্রশাসনে সঠিকভাবে কাজ করতে পারলে নির্বাচন কমিশনের লোকদেরও পরীক্ষা হয়ে যাবে। জনগণ স্থানীয়ভাবে বিচার পাবে। ভবিষ্যতে জাতীয় নির্বাচনের পথ পরিষ্কার হবে। সব দেশীয় ও বিদেশি ষড়যন্ত্রের সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
দেশের ১৮ কোটি মানুষ এক আল্লাহয় বিশ্বাসী। তাই দেশের কল্যাণে সব মানুষ একাকার হয়ে দেশীয় ও ভারতীয় সব ষড়যন্ত্র রুখে দেবে, ইনশাআল্লাহ। যে আল্লাহ বাংলাদেশের কল্যাণে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতাকে সরাসরি মদদ দিয়ে স্বৈরাচারী হাসিনাকে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য করেছিলেন, সেই আল্লাহ আমাদের এ বাংলাদেশকে সকল ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করবেন।
শহীদ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের এক স্মরণীয় নাম। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এদেশের জন্য কাজ করে গেছেন। সব ধরনের লোক নিয়ে তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ কায়েম করেছিলেন। ভারতীয় ষড়যন্ত্রে এ দেশীয় দালালচক্র তাকে শহীদ করে কাপুরুষের মতো। বর্তমানে শহীদ জিয়ার গড়া বিএনপি আদর্শচ্যুত হয়ে পড়েছে। বেগম জিয়া অসুস্থ। ছেলে তারেক জিয়া দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়ে প্রবাস জীবনে আছেন। বিদেশ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়। বিএনপির সালাহউদ্দিন, রিজভী, দুদুদের নিয়ন্ত্রণ করা তারেক জিয়ার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে তাদের মাথাব্যথা নেই। তাই আগস্ট বিপ্লবের শহীদের হত্যার বিচার বা আহতদের পুনর্বাসনের কথা চিন্তা না করে যেনতেন নির্বাচনের জন্য বর্তমান সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছে। এরা বিদেশি প্রভুদের ইশারায় চলেন, তারা কখনোই দেশমাতৃকার কল্যাণে কাজ করবে না।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দরে তাদের নৈতিক মান বজায় রেখে ছাত্র-জনতার পক্ষে কাজ করছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা সর্বক্ষেত্রে মানবিক দায়িত্ব পালন করছে দ্বিধাহীনচিত্তে। ফলে জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের প্রতি ছাত্র-জনতা আকৃষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া তাদের মাধ্যমে পরিচালিত দেশের সব জায়গায় স্কুল-কলেজ-মসজিদ-মাদরাসা, এতিমখানা, বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লিনিক, হাসপাতাল অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করছে। জামায়াতে ইসলামীর লোকেরা ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে দেশের সবচেয়ে ভালো ব্যাংক করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু হাসিনার দোসর এস আলম গ্রুপ এ ব্যাংকের সব টাকা কুক্ষিগত করে বিদেশে পাঠিয়ে ব্যাংকটাকে দেউলিয়া করে ফেলেছে। এছাড়া আরো কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক এরা ফতুর করে ফেলেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের নামে কোনো ব্যাংক ব্যবস্থা এদেশে থাকতে দেবে না। মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে আগস্ট বিপ্লবের পর ব্যাংকগুলো আবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। ষড়যন্ত্র যতই কঠিন হোক, আল্লাহর পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন হবে, ইনশাআল্লাহ।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার জন্য জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলোকে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। শিবির যেমন আগস্ট বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল। যদিও কিছু লোক বা ছাত্র তা হাইজ্যাক করার চেষ্টা করেছে, তাতে কোনো লাভ হবে না। দেশের সচেতন মানুষের কাছে ইতোমধ্যেই জামায়াত-শিবিরের ভূমিকা দিবালোকের মতো সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। আমরা যারা এক আল্লাহয় বিশ্বাস করি এবং তাকেই অভিভাবক জানি, আর তিনিই আমাদের একমাত্র সাহায্যকারী, কোনো সন্দেহ নেই।
মহান আল্লাহ তায়ালা সব ষড়যন্ত্র ভেদ করে মৃত্যু থেকে জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে অপরাধমুক্ত ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি এখন মুক্ত-স্বাধীনভাবে ইসলামের জন্য জামায়াতের সাথে কাজ শুরু করে দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ। জামায়াত ইতোমধ্যেই আদালতের রায়ে সংগঠনের নিবন্ধন ফিরে পেয়েছে। জামায়াতের প্রতীক দাঁড়িপাল্লাও ফিরে পাবে, ইনশাআল্লাহ। আমরা যদি আল্লাহর হয়ে যাই, তবে মহান আল্লাহও আমাদের হয়ে যাবেন কোনো সন্দেহ নেই। ষড়যন্ত্রকারীরা যতই ষড়যন্ত্র করুক না কেন। দেশের আপামর জনগণের প্রতি আবেদন- আসুন, আমরা দেশের ভালো মানুষের সন্ধান করি। সব চাঁদাবাজ, দখলবাজ, প্রতারকদের পরিত্যাগ করি। গ্রাম-গঞ্জ থেকে শহর-বন্দরে সর্বক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে ভালো লোকদের বাছাই করি। দল-মত না ভেবে সৎ, যোগ্য, জনদরদি লোক দেখে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করি। টাকার লোভ, পদের লোভ পরিত্যাগ করে দেশের লাভ, জনগণের লাভ চিন্তা করে এগিয়ে যাই। বার বার দেশের ছাত্র-জনতা মাঠে-ময়দানে রক্ত দিয়েছে, কিন্তু জনগণ তার প্রতিদান পায়নি। অসৎ নেতারা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেশের সম্পদ, ব্যাংকের সম্পদ লুট করে বিদেশে পালিয়েছে। দেশের ক্ষতি করেছে, জনগণের ক্ষতি করেছে। আবার তারাও যে শান্তিতে আছে, তা কিন্তু নয়। পরবাসে পরাধীন জীবনযাপন করা মোটেই মর্যাদাকর নয়।
শেখ হাসিনার বিচারকার্য তারই গড়া ট্রাইব্যুনালে শুরু হয়েছে। বিচার স্বচ্ছ করার জন্য আদালত থেকে লাইভে বিচারকার্য দেখা ও শোনা যাচ্ছে। আগের ক্যাঙ্গারু আদালতের সুযোগ এখানে নেই। জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলামের ন্যায়বিচার পাওয়ায় আগের যেমন কল্পিত বিচারে জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে, তাদেরও মরণোত্তর বিচার হবে। হুকুমদাতা, বিচারকসহ সহযোগীরা বিচারের আওতায় এলে সবারই ফাঁসি হবে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে। দেশের মানুষ সঠিক বিচার চায়।
সংস্কার দ্রুত সেরে গণভোট করে রায় নিয়ে নির্বাচনসহ সব কাজ এর আলোকে করলে জনগণকে আর ভুগতে হবে না। যার পাওনা সে পেয়ে যাবে, তাদের কর্মফল অনুযায়ী। আমরা দেশের জনগণ আর ভুগতে চাই না। আমরা আর প্রতারিত হতে চাই না। আমাদের সব অধিকার সঠিক মূল্যায়নে পেতে চাই।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের সব দলের প্রতি আহ্বান, আসুন আমরা দেশের মানুষের হয়ে কাজ করি। ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিদেশিদের দালাল না হয়ে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি। মহান আল্লাহ আমাদের কাজের বরকত দেবেন, আমরা তাঁর রহমত পাব। দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ পাব, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।