নিবন্ধন ফিরে পেল জামায়াতে ইসলামী
৪ জুন ২০২৫ ১১:১৭
স্টাফ রিপোর্টার : দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। নির্বাচন কমিশনকে অবিলম্বে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। গত রোববার (১ জুন) সকালে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৪ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। এ সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এ রায় দেন। এ আদেশের কারণে দীর্ঘ ১২ বছর পর নিবন্ধন ফিরে পেল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
আদালতে জামায়াতের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার ইমরান আবদুল্লাহ সিদ্দিক, এডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন, ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম। এ রায়ের পর জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান ফেসবুকে আলহামদুলিল্লাহ লিখে পোস্ট করেছেন।
রায়ের পর বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেন, বিগত দেড় দশক শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের হাতিয়ার ‘ইঙ্গিতে চলা আদালত’ এক রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এরপর ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের হাইকোর্টের রায় বাতিল ও এ সংক্রান্ত আপিল নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বিভাগ বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন। সেই সাথে সর্বোচ্চ আদালত বলেন, জামায়াতে ইসলামীর ‘পেন্ডিং রেজিস্ট্রেশন’ ও অন্যান্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অন্যদিকে দলীয় প্রতীক সংক্রান্ত জামায়াতের আবেদন প্রত্যাহারের আবেদন কোনো পর্যবেক্ষণ না দিয়ে মঞ্জুর করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। আদালতে জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিকী ও এডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম।
উল্লেখ্য, পরবর্তীকালে হাইকোর্টের ২০১৩ সালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামায়াতে ইসলামী। তবে সেই দিন হরতাল থাকায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানিতে জামায়াতের মূল আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ ‘ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ বলে আপিল খারিজের আদেশ দেন। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল থাকে। একপর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশে গত ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে শেখ হাসিনার সরকার। রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারায় জামায়াত, ছাত্রশিবিরসহ তাদের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে হাসিনার পতনের পর গত ২৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অন্যদিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলটি পুনরুজ্জীবনের আবেদন করা হয়। সে আবেদনের পর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আপিল বিভাগে পেন্ডিং মামলাটি পূর্ণাঙ্গ শুনানি হয়ে নিষ্পত্তি হয়নি। ‘ডিসমিসড ফর ডিফল্ট’ হয়। সেজন্য আমরা মামলাটি পুনরুজ্জীবনের আবেদন করি। সে পুনরুজ্জীবনের (রেস্টর) আবেদন গত ২২ অক্টোবর মঞ্জুর হওয়ার পর মেরিট অনুযায়ী আবার আপিল শুনানি শুরু হয়। এর মধ্য দিয়ে নিবন্ধন ফিরে পেতে জামায়াতের আইনি লড়াইয়ের পথ খুলে যায়। সেই ধারাবাহিকতায় গত রোববার (১ জুন) সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফিরিয়ে দিতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন।
বিভিন্ন দলের নেতাদের প্রতিক্রিয়া: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফিরে পাওয়া দেশের রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক ঘটনা বলে মনে করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা মনে করেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিহিংসার কারণে তাদের প্রতি অবিচার করেছিল। দীর্ঘদিন পর তারা আদালত থেকে ন্যায়বিচার পেয়েছেন।
বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির নির্বাহী সভাপতি মাওলানা এ কে এম আশরাফুল হক বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা ছিল আওয়ামী লীগের চরম ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপ। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক নিবন্ধন ফিরে পাওয়ায় দেশে মুক্ত রাজনীতির যুগের যাত্রা শুরু হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার গত ১৭ বছর রাজনৈতিক যে ফ্যাসিজম কায়েম করেছিল, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফিরে পাওয়ায় এর কিছুটা অবসান হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার মাধ্যমে দেশে নতুন করে মুক্ত রাজনৈতিক চর্চার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটা ইতিহাসের একটি মাইলফলক হবে, ইনশাআল্লাহ। আগামীতে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও সুস্থ রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করে চিরদিনের জন্য ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের পথ রুদ্ধ করতে জামায়াতে ইসলামী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, জামায়াতে ইসলামী দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। গ্রহণযোগ্য প্রতিটি সংসদে তাদের প্রতিনিধি ছিল। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নিবন্ধন কেড়ে নিয়ে জুলুম করেছিল। তাদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করেছিল। একইভাবে বিগত সরকার লেবার পার্টিরও নিবন্ধন কেড়ে নিয়েছিল। আমরাও আদালত থেকে ন্যায়বিচার পেয়েছি। নিবন্ধন ফিরে পেয়েছি। তিনি আরো বলেন, বিগত সরকার বিশেষ গোষ্ঠীর ইন্ধনে দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, যা গণতন্ত্রের জন্য শোভন ছিল না। এ কারণেই জামায়াত ও লেবার পার্টি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিল।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমেদ বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন ফিরে পাওয়া একটি ইতিবাচক ঘটনা। আওয়ামী লীগ সরকার কোনো কারণ ছাড়াই তাদের সুবিধার্থে একটি ইসলামী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে দিয়েছিল। যেটা ছিল তাদের স্বৈরাচারী আচরণের বহিঃপ্রকাশ। এখন জামায়াত নিবন্ধন ফিরে পাওয়া একটি ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের দেশে রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমীর মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা একটি অন্যায় সিদ্ধান্ত ছিল। এখন আইনগতভাবে তারা রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পেয়েছে- এটা দেশের রাজনীতির জন্য অবশ্যই একটা ভালো দিক। তারা এখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সঠিকভাবে ভূমিকা রাখতে পারবে। তিনি আরো বলেন, তারা গণতান্ত্রিকভাবেই দেশে রাজনীতি করছে। ’৭১-এর দোহাই দিয়ে তাদের রাজনীতি বঞ্চিত করার কোনো সুযোগ নেই।
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন রাজী বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন ফিরে পাওয়া অবশ্যই একটি ভালো খবর। এটা তাদের হক ছিল, তাদের অধিকার ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নিবন্ধন অন্যায়ভাবে বাতিল করেছিল। এখন তারা তাদের অধিকার ফিরে পেয়েছে। নিবন্ধন না থাকলে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারতো না। এখন তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে এবং ভালো করবে আশা করি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন কেড়ে নিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের প্রতি জুলুম ও অবিচার করেছিল। যেসব কারণে তাদের নিবন্ধন কেড়ে নেয়া হয়েছিল, সেসব কারণ সব ইসলামী দলের জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু শুধু জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা তাদের প্রতি অবিচার ছিল। তাদের দাবিয়ে রাখতে প্রতিহিংসা থেকে এটা করা হয়। এখন বিচার বিভাগ কিছুটা হলেও স্বাধীন। এজন্য তারা আদালত থেকে সুবিচার পেয়েছে। দীর্ঘদিন পরে হলেও তারা ন্যায়বিচার পেয়েছে। এটা অবশ্যই একটি ভালো খবর।