সংস্কার হোক বিপ্লবের সফল দলিল
২৯ মে ২০২৫ ১১:২৪
॥ এস এম আবদুচ ছালাম আজাদ ॥
ইদানীং সংস্কার নিয়ে হরেকরকম নসিহত শোনা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে নানা মুনি-ঋষির নানা নসিহত ও মতামত। কোনো কোনো মতামত আশাপ্রদ। আবার কোনো কোনো নসিহত কেবল নসিহতই। এসব নসিহত আলো-আঁধারের ধূম্রজালে মিশে যাবে। দু’কলম কেউ লিখলে হয়তো ইতিহাসের কোনো কোণায় স্থান পাবে। নচেৎ হারিয়ে যাবে মহাশূন্যের ঊর্ধ্বে কোথাও। যাক যে যা বলুক, শতত সত্য হলো- এ মুহূর্তে দেশের অবকাঠামোর সকল শাখা-প্রশাখায় বঞ্চিত সংস্কার খুবই জরুরি। যেটা জরাজীর্ণ রাস্তা জোড়াতালি দেয়ার মতো নয়। বরং পূর্বের কাঠামো পরিপূর্ণরূপে বিলীন করে দিয়ে নতুন অবকাঠামো তৈরি করে সেই অবকাঠামোকে সামনে রেখে নতুন রাস্তা তৈরি করার নামই হবে মৌলিক সংস্কার। এ সংস্কারের মধ্যে পুরনো কোনো ইট, বালি, সিমেন্ট ইত্যাদি থাকবে না। থাকবে না কোনো পুরনো পাথরকুচি। থাকবে না পুরনোর কোনো নাম-গন্ধ। থাকবে না পুরনোর কাসুন্দিঘাঁটা কোনো জারি গানের সুর। এমন সংস্কারই চব্বিশ বিপ্লবের পর বর্তমান জনগণের একমাত্র চাওয়া। নিরীহ জনসাধারণের একমাত্র কামনা।
সংস্কার কী?
সংস্কার একটি নতুন দিনের নতুন চেতনার নতুন অধ্যায়ের নাম। যে অধ্যায় এখনো রচিত হয়নি। সামনে রচিত হবে। যে অধ্যায় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা কিংবা কল্পনা কিছুই করা হয়নি। এ মুহূর্ত থেকে নব উদ্যোগে ভাবতে হবে। নতুন পথ রচনা করতে হবে। পুরনোকে ভেঙে-চুরে বালিকণার সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। পুরনো বিল্ডিংটা ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। পুরনোর কোনো অস্তিত্ব রাখা যাবে না। পুরনোর নামগন্ধ রাখা যাবে না। পুরনোকে মরা পাতার মতো বোঁটা থেকে খুলে ফেলতে হবে। সেই খসেপড়া পাতার মর্মর ধ্বনি শোনা যাবে কদিন কারো পায়ের চাপে। তারপর হারিয়ে যাবে অজানা-অচেনার পথে। অতঃপর নববসন্ত বাগিচায় এনে দেবে নতুন পুষ্পকুঁড়ি। ডালে ডালে কলি ফুটে নয়া পুষ্পের সমাহার ঘটবে। ধারণ করবে নবরূপ। বয়ে আনবে নবচেতনা। বের হবে নতুন রস। ছড়াবে মাতাল করা নতুন গন্ধ। নতুন রং, নতুন ঢঙে ওপর গড়ে উঠবে নতুন কাঠামো। সৃষ্টি হবে নবস্রোতের নবধারা। চব্বিশ বিপ্লবের নয়া বসন্ত সে সংস্কারই দাবি করে। যে সংস্কারের মাধ্যমে গড়ে উঠবে চোর-ডাকাতবিহীন এক নতুন বাংলাদেশ।
সংস্কার কেন?
কোনো বিল্ডিং পুরনো হয়ে জরাজীর্ণ হয়ে পড়লে বা অবকাঠামো নষ্ট হয়ে গেলে কিংবা কোনো স্থাপনা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়লে সেখানে সংস্কারের বিষয়টি বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫৩ বছর অতিবাহিত হয়েছে। ফলে জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়েছে সাংবিধানিক অবকাঠামো, আইনবিধান ও বিচারের অবকাঠামো, সিভিল প্রশাসনের সকল শাখা-প্রশাখার সকল অবকাঠামো, পুলিশ প্রশাসনের সকল প্রকার অবকাঠামো, দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো, রাজনৈতিক অবকাঠামো, শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত অবকাঠামো, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মৌলিক অবকাঠামো, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র বিভাগের অবকাঠামো, অমদানি-রফতানি অবকাঠামো, আইন- আদালাতের বিচারিক অবকাঠামো, সামাজিক সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার সকল অবকাঠামোসহ একটি দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোই জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। দেশে আইনের শাসন বলতে যা বোঝায়, তা নেই। পুলিশ প্রশাসনের খোলস ঠিক থাকলেও নৈতিক মান শূন্যের কোটায়। সাধারণ কনস্টেবল থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ের অফিসার পর্যন্ত সকলেই মাসের শেষে তাদের জন্য নির্ধারিত গ্রেড অনুযায়ী সরকারি মাইনে গ্রহণ করে থাকেন। তারপরও সাধারণ পুলিশ ফাঁড়ির সাধারণ কনস্টেবল থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ের বড় ছোট অফিসারদের অনৈতিক লেনদেন ওপেন সিক্রেট হয়ে রয়েই গেছে। প্রতিটি অফিসে ক্যাশিয়ারের দৃশ্যমান অবস্থান বিদ্যমান রয়েছে বলে শোনা যায়। এ জায়গায় সাধারণ জনগণের কোনো স্থান নেই। সাধারণ মানুষকে কেবল সান্ত্বনার বাণীই শুনতে হয়। এখনো অপরাধীরা বিজয়ের হাসিটায় হেসে যায়। যারা ক্যাশিয়ারের সাথে বড়-ছোট অংশের লেনদেন সেরে নিয়ে নিরপরাধী সেজে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। এমন অবস্থা আজো বিদ্যমান রয়েছে।
নির্বাচনে ভোট বেচাকেনার সংস্কৃতি নতুন নয়। ভোট ডাকাতির বিষয়ও ওপেন সিক্রেট। টাকার বান্ডিল দিয়ে হোন্ডা আর গুণ্ডা কিনে দিনের কাজ রাতে শেষ করার হাজারো নজির বিদ্যমান রয়েছে। এখনো সেই কায়দায় নির্বাচন করে ক্ষমতার চেয়ার দখল করার খায়েশ অনেক দলের নেতাদের আস্ফালনে দেখা যায়। আবার ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বিজয়ীকে পরাজিত ঘোষণা করার নজিরও কম নেই। দেশের শিক্ষা বিভাগের অবস্থার কথা সকলেই অবগত। এ বিভাগে নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য হরদম চলছে। যেসব অনৈতিক কাজ চলছে, তা হিসাব করে রেজিস্ট্রি খাতায় লিখে রাখার ব্যবস্থা নিতে গেলে পৃথক দপ্তর খুলে বসতে হবে। এখানে সংবিধান অচল, আইন অচল, নিয়মনীতি অচল, লাজ-লজ্জা অচল, প্রেম-প্রীতি অচল। অনৈতিকতা আর অসাধুতাই কেবল সচল রয়েছে।
বিদ্যমান রসম-রেওয়াজ হওয়া কিংবা হারাম কাজ হালাল হিসেবে নিত্য চলতে থাকা মোটেই উচিত নয়। এখনই এ অবস্থার কঠিন প্রতিরোধ দরকার। এমন প্রতিরোধ কঠিন ও সৎ মানসিকতার শাসক ব্যতীত সম্ভব নয়। কোনো অসৎ কিংবা অসাধু দলীয় সরকার এমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। হানাদারমুক্ত স্বাধীনতার পর থেকে আগ্রাসানমুক্ত নতুন স্বাধীনতার দিন পর্যন্ত যত দলীয় সরকারই দেশ শাসন করেছে, তাদের চরিত্রই এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। কোনো দলীয় সরকার তাদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তাই কোনো দলীয় সরকার কল্যাণকর কোনো সংস্কার করবেÑ এমন আশা করা বোকামি। সে কারণে রক্তাক্ত জুলাই চব্বিশ বিপ্লবোত্তর যে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়েছে, সেই সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংবিধানসহ রাষ্ট্রের সকল শাখা-প্রশাখার অবকাঠমোয় প্রাসঙ্গিক সংস্কার করে নেওয়া ফরজে আইন বলে মনে করি। এই ফরজ কাজ আদায় না করে যদি যেনতেনভাবে নির্বাচন করে যে কারো হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়, তাহলে নতুনভাবে ভয়ঙ্কর আরেক ফ্যাসিস্টের জন্ম নেবে নতুন উদ্যমে, নতুন চেতনায়, নতুন গতিতে। তখন জাতি প্রবেশ করবে নতুন এক অন্ধকার যুগে। যে অন্ধকার থেকে বের হওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়বে।
সংস্কারবিরোধী কারা?
অনিয়মই যাদের কাছে নিয়ম, অসত্যই যাদের কাছে সত্য, অব্যবস্থাপনা যাদের কাছে সঠিক ব্যবস্থাপনা, অগোছালো এবং অসুন্দর যাদের কাছে গোছালো এবং সুন্দর, যারা দেশ ও দেশের জনগণকে ভালোবাসে না, বরং ক্ষমতাকে বা ক্ষমতার চেয়ারটাকেই বেশি ভালোবাসে, তারা কোনোরকম সংস্কার চায় না। এসব লোক দেশপ্রেমে মজেনা, জনপ্রেমে মজেনা, বরং ক্ষমতাই যাদের কাছে সোনার হরিণ, ক্ষমতাই যাদের কাছে সাত রাজার ধনÑ এ মহলটিই কোনোরকম সংস্কার চায় না। যারা রাজনীতিকে পুঁজি করে স্বল্পসময়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়, তারা ইতিবাচক সংস্কার চাইবে না। তারা পুরনো জরাজীর্ণ বিল্ডিংয়ের ভেতর নেশার আড্ডাখানা বানিয়ে সুখ পেতে চায়। রাজনীতির নামে জাতিকে নতুন করে ধোঁকা দিতে চায়। এরা আবার পতিত ফ্যাসিস্টদেরও সাথে পেতে চায়। ফ্যাসিস্টদের নিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধতে চাই। সরকারে, প্রশাসনে, দেশের সকল বিভাগে ফ্যাসিস্টদের পূর্ণাঙ্গ সেটআপ বহাল রেখে দিয়ে চব্বিশের আন্দোলনের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানি করতে চায়। মনে রাখতে হবে যে, চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ, ঘুষখোর, ধর্ষক ও দলবাজদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার জন্য আমাদের কলিজার টুকরো ছেলেরা জীবন দেয়নি। তারা জীবন দিয়েছে সকল প্রকার বৈষম্যকে পদতলে দিয়ে বৈষম্যকে বিনাশ করে দেয়ার জন্য। বৈষম্যহীন নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য। আগ্রাসনমুক্ত রাষ্ট্র ও জাতি গড়ার জন্য।
অতএব বর্তমান সরকারকে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। নতুন চেতনার পর্দা উন্মোচন করতে হবে। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মিথ্যার অবসান ঘটাতে হবে। শক্ত হাতে দমন করতে হবে সকল অনিয়ম ও সকল বৈষম্য। সংবিধানসহ প্রশাসনের সকল জায়গায় করতে হবে প্রাসঙ্গিক সংস্কার। কেননা এ সংস্কারই হবে জুলাই চব্বিশ বিপ্লবের সফল দলিল। মহাদলিল। এ দলিলই নতুন আগ্রাসনমুক্ত স্বাধীনতার সাক্ষ্য বহন করবে।