বাংলা ভাষার সুরক্ষায় সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ


২৯ মে ২০২৫ ১১:২৩

॥ মো. মোস্তফা মিয়া ॥
বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সাথে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮), যার অনন্য পৃষ্ঠপোষকতার কারণে আমরা পেয়েছি বাংলা ভাষা। বহিরাগত সেন-আর্যদের অত্যাচারে যখন বাংলা ভাষা ও বাঙালি নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম হয়, তখনই সুলতানি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা পূর্ণমাত্রায় প্রাণ ফিরে পায়। মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে হয়তো কালের গর্ভে হারিয়ে যেত বাংলা ভাষা।
ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ লিখেছেন, সেনেরা কনৌজ থেকে উচ্চ শ্রেণির ব্রাহ্মণ এনে হিন্দু সমাজে কৌলীন্য প্রথার প্রচলন করেন। তারা সাহিত্য ও রাষ্ট্র ভাষায় সংস্কৃত আমদানি করে ভাষায়ও রাষ্ট্রগত কৌলীন্য প্রতিষ্ঠা করেন। রাজ্যময় বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা রহিত হয়। রাজদেশ অনুসরণ করে শাস্ত্রবিদ পণ্ডিতগণও দেবভাষা সংস্কৃত ছাড়া লোক-ভাষায় শাস্ত্রালোচনা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন-
অষ্টাদশ পুরকণানি রামস্য চরিতানিচ
ভাষায়াং মানব : শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ।
অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরাণ রামচরিত ইত্যাদি ধর্মশাস্ত্র লোক-ভাষায় আলোচনা ও শ্রবণ করলে রৌরব নরকে যেতে হবে।
শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন, বাঙ্গালা ভাষা মুসলমান-প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কথঞ্চিৎ আত্মপ্রকাশ করিতেছিল। পণ্ডিতরা নস্যাধান হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি করিতেছিলেন এবং তৈলাধার পাত্র কিম্বা পাত্রাধার তৈল এ বলিয়া ঘোর বিচারে প্রবৃত্ত ছিলেন। যোগাযোগ তাহারা হর্ষচরিত হইতে হারং দেহি যে হরিণি প্রভৃতি অনুপ্রাসের দৃষ্টান্ত আবিষ্কার করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেছিলেন এবং কাদম্বরি, দশকুমারচরিত প্রভৃতি পদ্য-রসাত্মক গদ্যের অপূর্ব সমাস-বদ্ধ পদের গৌরবে আত্মহারা হইয়াছিলেন। রাজসভায় নর্ত্তকী ও মন্দিরে দেবদাসীরা তখন হস্তের অদ্ভুত ভঙ্গি করিয়া এবং কঙ্কণ ঝঙ্কারে অলি গুঞ্জনের ভ্রম জন্মাইয়া ‘প্রিয়ে, মূঞ্জময়ি মানমনিদানং’ কিম্বা ‘মুখরমধীরম, ত্যজ মঞ্জীরম’ প্রভৃতি জয়দেবের গান গাহিয়া শ্রোতৃবর্গকে মুগ্ধ করিতেছিল। সেখানে বঙ্গ-ভাষার স্থান কোথায়? ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গ ভাষাকে পণ্ডিতমণ্ডলী দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষা তেমনই সুধী সমাজের অপাংক্তেয় ছিল-তেমনই ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল ।
বাংলা ভাষাকে সর্বপ্রথম রাজদরবারে জায়গা করে দেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৮৯-১৪০৯)। তাঁর প্রেরণায় শাহ মুহম্মদ সগীর রচনা করেন ইউসুফ জোলেখা কাব্যগ্রন্থ । এর আগে এটা ছিল নিম্ন বর্গ ও অস্পর্শের ভাষা।
তিরতিএ পরনাম করোঁ রাজ্যক ঈশ্বর
বাঘে ছাগে পানি খাএ নিভয় নিভর।।
এছাড়া সুলতানি আমলে কবি দৌলত উজির বাহরাম খান রচনা করেন কালজয়ী প্রেমের উপখ্যান লায়লী-মজনু। এটি ছিল বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ সংযোজন। এ আমলের সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় যারা সাহিত্য চর্চা করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি যশোরাজ খান, মালাধর বসু বিপ্রদাস, বিজয়গুপ্ত, কবিন্দ্র পরমেশ্বর দৌলত কাজী ও আলাওল প্রমুখ। এসব কবি-সাহিত্যিকের কালজয়ী রচনা বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে ।
কবি হাফিজ শিরাজীকে আমন্ত্রণ জানানোর কারণে বাংলা ও বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ ইরানের সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন।
হাজার বছর আগে বাঙালি জাতির মুখের ভাষা ‘বাংলা’কে কেড়ে নিয়েছিলো দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেন রাজারা। সেন রাজাদের হিন্দু পণ্ডিতরা ফতওয়া জারি করেছিলো, “যারা বাংলা ভাষা বলবে ও শুনবে তারা ‘রৌরব’ নামক নরকে যাবে।” ঐ সময় তুর্কি বংশোদ্ভূত ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী নির্যাতিত বাঙালিদের মুক্ত করতে এগিয়ে আসেন এবং ১২০৪ সালে মাত্র ১৮ জন ঘোড়সওয়ারী নিয়ে সেন রাজাকে পরাজিত করে বাংলাকে স্বাধীন করেন। বক্তারা বলেন, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেইদিন শুধু ভূমির বিজয় হয়নি, সাথে মুক্ত হয়েছিলো বাঙালিদের মুখের ভাষা ‘বাংলা’।
ভাষাবিদ দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, “মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ-সাহিত্যের জন্মদাতা বললে অত্যুক্তি হয় না। বঙ্গ-সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গ-ভাষা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা।” অধ্যাপক ও গবেষক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, “যদি বাংলায় মুসলিম বিজয় ত্বরান্বিত না হতো এবং এদেশে আরো কয়েক শতকের জন্য পর্বের শাসন অব্যাহত থাকতো, তবে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেত এবং অবহেলিত ও বিস্মৃত-প্রায় হয়ে অতীতের গর্ভে নিমজ্জিত হতো।”
মধ্যযুগে মুসলিম শাসকদের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষার যে সাহিত্যচর্চা শুরু হয়, তার মাধ্যমে বাংলা ভাষা একটি পরিপূর্ণ ভাষা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার যোগ্যতা অর্জন করে।
বাংলা ভাষাকে কলুষিত করার চেষ্টা পরবর্তীতে যুগে যুগে আরো হয়। ১৮শ’ সনে ব্রিটিশরা কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করে বাংলা ভাষার আরবী ও ফারসী শব্দ বাদ দিয়ে সংস্কৃত শব্দ প্রবেশের উদ্দেশ্যে সাহিত্যচর্চা শুরু করে। তারা দেখাতে চায়, “বাংলা ভাষার সাথে মুসলমানদের কোন সম্পর্ক নেই”।
মুসলিমদের হেয়প্রতিপন্ন করতে প্রচার করা হয়, বাংলা ভাষায় প্রথম কুরআন শরীফ অনুবাদ নাকি গিরিশ চন্দ্র সেন করেছে। অথচ ১৮৮৬ সালে গিরিশ চন্দ্র সেনের অনুবাদের বহু পূর্বে ১৮০৮ সালে বাংলা ভাষায় কুরআন শরীফের আংশিক অনুবাদ করেন মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া। এরপর ১৮৩৬ সনে মৌলভী নাঈমুদ্দীন পূর্ণাঙ্গ কুরআন মাজীদের বাংলা অনুবাদ সম্পন্ন করেন। অথচ এ ইতিহাস প্রচার করা হয় না।
মধ্যযুগে হিন্দু পণ্ডিতগণ বাংলা ভাষাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে পারে নাই। তারা বাংলা ভাষাকে ইতরের ভাষা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আধুনিককালে বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এবং তথাকথিত মুসলিম অভিজাত শ্রেণি বাংলা ভাষাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ না করে বরং ঘৃণা করতে থাকে। বাংলা ভাষা নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিলেন। তারপরও বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটানো রোধ করা সম্ভব হয় নাই। নদীর প্রবহমান পানির মতো বাংলা ভাষা তার নিজস্ব গতিতে বিকাশমান হয়েছে। বাংলা ভাষার চেতনা থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। ভাষার চেতনা থেকেই স্বাধিকারের চেতনা জাগ্রত হয় এবং সেই চেতনা থেকেই স্বাধীন-সার্বভৌম চেতনার বিকাশ ঘটে। এ বিকাশের প্রত্যেকটা স্তরে তারুণ্যের চেতনা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। ভাষার চেতনা থেকেই তারুণ্যের মানসিক চেতনার মাধ্যমে ১৯৭১ এর সূচনা ঘটে এবং ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। যেহেতু ভাষার চেতনা থেকেই ন্যায্য অধিকারের চেতনা জাগ্রত হয় সেহেতু সংকুচিত অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য তারুণ্যের চেতনা শক্তিশালী হয়। অধিকার ফিরে পাওয়ার চেতনা থেকেই তারুণ্যের চেতনায় রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষার মর্যাদা সুরক্ষায় সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ এবং এনজিও ব্যক্তিত্ব।