মর্যাদার প্রকৃত মাপকাঠি


২৯ মে ২০২৫ ১১:২১

॥ জাফর আহমাদ ॥
“নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক সম্মানিত, তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সবকিছু জানেন ও খবর রাখেন।” (আল হুজুরাত : ১৩)। অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি মুত্তাকি, তিনিই সবচেয়ে বেশি সম্মানিত ও মর্যাদাবান। সুতরাং মর্যাদার মাপকাঠি হলো, “তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়”।
পৃথিবীর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর মতো মুসলমানগণ যেদিন থেকে তাকওয়াকে বাদ দিয়ে অন্যান্য বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে মানুষের মর্যাদা দিতে শুরু করেছে, সেদিন থেকে তাদের কপাল পুড়তে শুরু করেছে। রাসূল সা.-এর অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়া ‘বুনিয়ানুম মারসুস’ ‘সুদৃঢ় প্রাচীর’-এর ফাটল বা ভাঙন সেখান থেকেই শুরু হয়েছে। বিজাতীয়দের মতো মুসলমানদের মধ্যে আজ খান্দান, গোত্র ও গোষ্ঠীগত বিভেদের পাহাড় পরিলক্ষিত হয়। আর এরই ফলে তাদের মধ্যেও অহংকার, ঘৃণা, তাচ্ছিল্য, বিদ্বেষ ও অবমাননা এবং জুলুম ও নির্যাতন দানাবেঁধে উঠেছে। অথচ এটি ছিল ইহুদি-খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিকদের চরিত্র। জাতীয়তার ভিত্তিতে ইহুদিরা মনে করেছে, তারাই আল্লাহর মনোনীত সৃষ্টি। এজন্য পৃথিবীর সকল অইসরাইলিরা অধিকার ও মর্যাদার দিক থেকে নিম্ন পর্যায়ের। পক্ষান্তরে খ্রিষ্টানরা বলেছে, ঈসা আল্লাহর পুত্র (নাউযুবিল্লাহ), সুতরাং তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। হিন্দু জাতি পৃথিবীর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠী থেকে নিজেদের শ্রেষ্ঠতর মনে করা ছাড়াও খোদ নিজেদের মধ্যেই অসংখ্য কঠিন ভেদনীতি চালু করে রেখেছে। তারা বর্ণাশ্রমের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং শুদ্রদের লাঞ্ছনার গভীর খাদে নিক্ষেপ করেছে। তাদের ঘরে অন্য ধর্মের কেউ ঢুকে পড়লে সেটিকে ধুয়ে-মুছে পবিত্র করে থাকে। এরাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদার গণতন্ত্র ও কট্টর সমাজনীতি শ্রেণি সংগ্রামের আগুন জ্বালিয়েছে, সাদা-কালো বর্ণবাদনীতি অসংখ্য বনি আদমের রক্ত ঝরিয়েছে, আদিবাসী-অ-আদিবাসীর উচ্ছেদের সংগ্রাম তো চলছেই।
আমাদের ভালো করে মনে রাখা প্রয়োজন, খান্দান, বংশ, গোত্র ও গোষ্ঠী, বর্ণ, ভাষা, দেশ ও জাতীয়তা এগুলো অহংকারেরও হোতা। আরও মনে রাখা প্রয়োজন, পৃথিবীর সর্বপ্রথম যে গুনাহের খাতায় নাম লিখিয়েছিল, সে হলো শয়তান এবং প্রথম যে গুনাহটি আল্লাহর হুকুমকে মানতে অবাধ্য করেছিল, সেটি হলো অহংকার। আর অহংকার সৃষ্টি হয়েছিল জন্মগত শ্রেষ্ঠত্বকে ভর করে। সূরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম আদমকে সিজদা কর। সকলেই সিজদা করলো। কেবল ইবলিস করলো না। সে অস্বীকার ও অহংকার করলো। সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।” অন্যত্র বলা হয়েছে, সে বললো, আমি আগুনের তৈরি আর আদম মাটির তৈরি। অর্থাৎ তার মধ্যে বর্ণবাদের অহংকার ও বিদ্বেষ দানাবেঁধে উঠেছিল। ফলে সে-ই পৃথিবীর প্রথম নিকৃষ্ট কীট, যে আল্লাহর আদেশকে অমান্য করলো এবং তাঁর লা’নত নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত তাকে বেঁচে থাকতে হবে।
কিন্তু ইসলাম এসব নীতিকে কখনোই সমর্থন করে না। মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের বুনিয়াদ হলো, ‘তাকওয়া’। জন্মগতভাবে সকল মানুষ সমান। কেননা তাদের মূল উৎস এক। একমাত্র পুরুষ এবং একমাত্র নারী থেকে গোটা জাতি অস্তিত্ব লাভ করেছে। তাদের সকলের সৃষ্টিকর্তা এক, তাদের সৃষ্টির উপাদান ও নিয়ম-পদ্ধতি এক এবং তাদের সবার বংশধারা একই পিতা-মাতা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। সুতরাং মানুষ যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন, সেটি দেখার বিষয় নয়। বরং যে মূল জিনিসের ভিত্তিতে একজন অপর জনের ওপর মর্যাদা লাভ করতে পারে তা হচ্ছে এই যে, সে অন্য সবার তুলনায় অধিক আল্লাহভীরু, মন্দ ও অকল্যাণ থেকে দূরে অবস্থানকারী এবং নেকী ও পবিত্রতার পথ অনুগমনকারী। রাসূল সা. মক্কা বিজয়ের সময় কা’বা তাওয়াফের পর বক্তৃতা করেছিলে। তাতে তিনি বলেন, “সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের দোষ-ত্রুটি ও অহংকার দূর করে দিয়েছেন। হে লোকেরা! সমস্ত মানুষ দু-ভাগে বিভক্ত। এক. নেক আমলদার ও পরহেজগার, যারা আল্লাহর দৃষ্টিতে মর্যাদার অধিকারী। দুই. পাপী ও দুরাচার, যারা আল্লাহর দৃষ্টিতে নিকৃষ্ট। অন্যথায় সব মানুষই আদমের সন্তান। আর আদম মাটির সৃষ্টি।” (তিরমিযী)। অন্য এক হাদীসে উল্লেখ আছে, “আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেহারা-আকৃতি ও সম্পদ দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কাজ-কর্ম দেখেন।” (মুসলিম, ইবনে মাজাহ)।
ইসলাম সাম্য-সংহতির অনুপম শিক্ষা শুধুমাত্র ব্যক্তি চরিত্রে নয়, বরং মানুষের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় জীবনসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাস্তবায়ন করেছে। আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগে রাসূল সা. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মদীনা নামক ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করুন। রাসূলুল্লাহ সা. এমন এক সমাজ কায়েম করেছিলেন, যেখানে বর্ণ, বংশ, ভাষা, দেশ ও জাতীয়তার কোনো ভেদাভেদ ছিল না, যেখানে উঁচু-নিচু, ছুঁত-ছাত এবং বিভেদ ও পক্ষপাতিত্বের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সে সমাজ ব্যবস্থায় হযরত বেলাল রা. এবং হযরত ওমর রা.-এর মধ্যে যেমন কোনো পার্থক্য ছিল না, তেমনি আলী রা. ও আনাস-যায়েদ ইবনে সাবেত রা. মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। থাকলেও সেটি তাকওয়ার ভিত্তিতেই নিরূপিত হতো। একবার হযরত ওমর রা.-এর বেলালকে রা. ধমক দিয়ে কথা বললে রাসূল সা. অসন্তুষ্ট হন এবং বলেন, ওমর হে! তোমার কি এখনো বংশীয় গৌরব রয়েছে? ওমর রা. লজ্জিত হলেন। তিনি নিজের সকল আভিজাত্যের অহংবোধকে ধ্বংস করে দেন। মানবিক সাম্য ও ঐক্য সে সমাজকে এমনি ফুলে-ফলে সুশোভিত করেছিল, যা পৃথিবীর আর কোনো ধর্ম বা ব্যবস্থায় সামান্যতমও পরিলক্ষিত হয় না। এ ভাবটিই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কাব্যে এভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন-
“সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শুন এক মিলনের বাঁশি।
এক জনে দিলে ব্যথা
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান।”
(কুলি-মজুর, সাম্যবাদী, নজরুল রচনাবলী)।
প্রকৃতপক্ষে আমরা মুত্তাকি হতে পারছি না বিধায় ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মতো বিকল্প পথে মর্যাদার সন্ধান করে ফিরছি। আর এজন্য আমরাও বংশ, বর্ণ, ভাষা, দেশ এবং জাতীয়তার ভিত্তিতে মর্যাদার বৃত্ত গড়ে তুলেছি। এ নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যেই আমাদের সামজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এ নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে আমাদের চিন্তা-চেতনাকে নিয়ে যেতে পারছি না বিধায় উন্নয়নের বাধাগুলোও টপকানো আমাদের জন্য দুষ্কর হয়েছে। ফলে সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের আজ্ঞাবহ সাজতে বাধ্য হচ্ছি। অথচ তাকওয়ার মতো মানবীয় উন্নতর গুণের অধিকারীদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত কল্যাণের ভাণ্ডার সংরক্ষিত রয়েছে বলে আল কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। সত্যিই মুসলিম দেশসমূহের ভৌগোলিক ও কৌশলগত অবস্থান অধিকতর এমন উত্তম স্থানে রয়েছে যে, প্রতিটি মুসলিম দেশের মাটির নিচে আল্লাহ তায়ালা অফুরন্ত নিয়ামতের ভাণ্ডার মজুদ করে রেখেছেন। আমাদের গোলামি ও পরাজিত মানসিকতার কারণে আল্লাহ দান করছেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমাদের বর্তমান মুসলিম দেশসমূহের সরকার প্রধানগণ আল্লাহর ভয়ের চেয়ে সাম্রাজ্যবাদী ইহুদি-খ্রিষ্টান গোষ্ঠীকেই বেশি ভয় করেন। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা বলেন : “লোকালয়ের মানুষগুলো যদি ঈমান আনতো ও তাকওয়া বা ভয় করতো, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। সুতরাং তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করলাম।” (সূরা আ’রাফ : ৯৬)।
দুনিয়ার জীবনে উঁচু-নীচুর যে মানদণ্ড তৈরি করা হয়েছে, এগুলো আল্লাহর কাছে গুরুত্বহীন। আমরা দুনিয়ায় যাকে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন সাব্যস্ত করেছি, আল্লাহর কাছে সে একেবারেই মূল্যহীন। পক্ষান্তরে দুনিয়ায় যাকে আমরা নীচ, উচ্ছিষ্ট্য ও হেয়প্রতিপন্ন করে রেখেছি, কিন্তু আল্লাহর কাছে সে সম্মানিত ও মর্যাদাসম্পন্ন বান্দা হিসেবে গণ্য হবেন। তাকওয়ার ভিত্তিতে চরিত্র সংশোধনকারীই মূলত মর্যাদাশীল ব্যক্তি। কারণ তাকওয়া এমন একটা শক্তি, এমন একটা গুণ, যার ওপর ভিত্তি করে মানুষ হক ও বাতিল, ভুল ও সঠিক, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্যরেখা টানতে পারে। যিনি শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়ে সেটিকেই সত্য হিসেবে মেনে নেন, যা তিনি নাজিল করেছেন। তিনি সেটিকেই সঠিক মনে করেন, যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। যে কাজ বা প্রথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আরো অসংখ্য ক্ষতির সৃষ্টি করে, যে সকল কাজে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, সেটিই মানুষের জন্য ক্ষতিকারক। এ ধরনের ক্ষতিকর কাজ থেকে আত্মরক্ষাকারীই মূলত মর্যাদশীল ব্যক্তি।