সোনার চেয়েও খাঁটি আমার দেশের মাটি


২৯ মে ২০২৫ ১১:১৮

॥ ফিরোজ আহমদ ॥
সোনার চেয়েও খাঁটি সে যে আমার দেশের মাটি। খুবই মূল্যবান রত্ন সোনা। কিন্তু সোনা থেকে সোনা উৎপাদন হতে আমরা কখনো দেখিনি। কিন্তু সারা জাহানের বিচিত্র সব মাটির মতো কালিগঞ্জের এ মাটিতেও যখনই আসি, তখনই দেখি আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, লেবু, আমড়া এবং আরো অনেক ফলে-ফুলে ভরা সোনালি সবুজপাতায় নুইয়ে পড়ছে জানা-অজানা সব গাছগাছালি। চিকন চাল, মোটা চাল, ভুট্টা, গম, যব, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, কলা, বেগুন, ঢ্যাঁড়শসহ আরো অনেক তরুতাজা শস্য, সবজি, ফল খেয়ে আমরা মহাতৃপ্ত হই। শুকরিয়া জানাই মহান আল্লাহর।
এবার এসেও আবার তারই চাক্ষুষ প্রমাণ পেলাম। চোখজুড়ানো অভিনব সব ফুলে-ফলে ভরা বড়গায়ের সুন্দর সেরা গ্রামের সব পাড়ায় পাড়ায়। যেদিকে তাকাই সেদিকেই টাটকা, তাজা সুস্বাদু ও সুস্বাস্থ্যের সব ফলমূল আর শস্যের পরে শস্য দেখে আমরা পাগল হয়ে যাই। অথচ আমার প্রিয় এমদাদ চাষি ভাইয়েরা ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের সঠিক বিনিময় পায় না। গ্রামেগঞ্জের বাজারে গিয়ে এত সব রত্নের যথাযথ মূল্য না পেয়ে আফসোস করতে দেখি অন্য চাষি ভাইদের। আমরা এসব আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে এসে আম, জাম, কাঁঠাল, আমড়া আর লিচু খেতে খেতে ক্লান্ত। তবুও আরো খাই। খাই আর মনের আনন্দে লাফাই। খেয়ে যেন কোনটাই শেষ করতে পারি না। তাই কালিগঞ্জ আমার প্রাণের প্রিয় সোনারখনি। আগের মতই শালিকা শামিমা আমার বড় মেয়ে কুবরাকে মোবাইলে বার বার কল দিয়ে লিচু খেতে আসতে তাগিত দিতে থাকে।
তাই কুতুবপুরের মদনপুর থেকে সিএনজিযোগে বড় মেয়ে কুবরা, তার স্বামী নাসিরউদ্দীন ও আমি এ তিনে মিলে সেদিন দুপুরের আগেই যাত্রা শুরু করলাম। নারায়ণগঞ্জ থেকে আড়াইহাজার পার হয়ে নরসিংদী। তারপর ঘোড়াশাল ব্রিজ পার হয়ে কালিগঞ্জ। এবার আমরা গাজীপুর জেলার বিরাট গ্রাম্য এলাকায় ঢুকে গাছগাছালির মেলার সৌন্দর্যের দিকে শুধু চেয়েই থাকি।
শিল্পকারখানা, শহর, বন্দর, গ্রামগঞ্জ পার হয়ে বড়গায়ে এসে আমরা অনায়াসে পৌঁছালাম ১৭ মে, শনিবার ২০২৫-এ। আলহামদুলিল্লাহ। সবুজ শ্যামল সুন্দর ধান, পাট, আম, লিচু, কলা, লেবু, ফুল, ফল আর শস্যেভরা মাটির দেশে এলাম। মনে বড় শান্তি। মনের মাঝে ভাবনা আরো অনেক। তাই ভাবি বিচিত্র ভুবনে আমার জীবনের কথা। এক আল্লাহর সীমাহীন ক্ষমতার নিদর্শনে ভরা। আমার জীবন নিয়ে সেসব কথাই আপনাকেও জানাতে চাই। আমার এ মুসাফিরী জীবনের কিছুচিত্র আবারও তুলে ধরতে ভালো লাগছে।
পাঁচ বছর ধরে হাজারীবাগ, রায়েরবাজার, ধানমন্ডিতে ঘুরেফিরে মাটি ও মানুষের সাথে মিশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক অভিজ্ঞতা পেয়েছি। দেখেছি রাব্বুল আলামিন আল্লাহকে। বিলিয়েছি আপনজনদের মাঝেও। ফেব্রুয়ারি ’২৫ থেকে মিরপুর ১৩ তে আবাসন গেড়ে আবারও পেলাম অনেক কিছু। পেলাম অভিজাত শহর নাভানা সিটিতে অন্যরকমের মানুষের উন্নত আবাসন। রাকীন, নাভানা ও রূপশীজুড়ে পেলাম সব ১৫ তলার এক সাইজ ও একই রঙের দালানে ভরপুর সুন্দর সেরা আধুনিক সব শহুরে জীবন। পেলাম ধনবান অভিজাত চেহারার ভালো ভালো মানুষের ভিড়।
এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে আবারও ঘুরি। শুধু পারিবারিক কারণে নয়, মনের খুশিতেও মাঝেমধ্যে এখানে সেখানে ঘুরার সুযোগ পেলে আমি খুব খুশি। তেমনি রশির টানে জীবনসঙ্গিনী স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালন ও পারিবারিক বন্ধনের কারণে আবারও এলাম ছোট ছেলে আলী ইমরানের বাসা মিরপুর ২-এ বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমির স্টাফ কোয়ার্টারে। জানা-অজানা শত শত লাল, নীল, সবুজ, সাদা, হলুদ, গোলাপি ফুল, ফল ও নানারকমের পাতা বাহারের মেলার দিকে শুধু চেয়েই থাকি। কারণ এখানেও অন্যরকম শহুরে আমেজে ভরপুর সরকারি কর্মকর্তাদের চমৎকার অফিস ভবন এবং বহুতল ভবনের আবাসন এ কোয়ার্টার। আরাম আয়েশে ৯ দিন এখানে কাটিয়ে এবার যেতে হবে কুতুবপুরে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষায় দুই মেয়ের বাড়িতে।
তাই ২০২৫-এর ১৪ মে ওভার ট্যাক্সিতে চড়ে কুতুবপুরের উদ্দেশে আরামদায়ক ভ্রমণ করার আরো একটি সুযোগ নিলাম। নিজ গ্রামের মতোই এ কুতুবপুর গ্রামটি আমার কাছে খুবই প্রিয়। কুবরা ও সাবেরা নামের আমার কলিজার টুকরা দুটি মেয়েকেই এখানে বিয়ে দিয়েছি। অনেক অসংলগ্নতা ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে পরম ধৈর্যের ফলস্বরূপ তারা এখানে পরের মেয়ে থেকে বৌ এবং বৌ থেকে মা হয়েছে। এখানে আমাদের ৫ জন নাতি-নাতনি পরম আদরে আদরে বড় হয়ে উঠেছে। তাদের নিয়েই খুব আনন্দ-উল্লাসে সংঘ দিতে ঘন ঘন আসি। আবারও এলাম একই কারণে। পরদিন নওমিনের বাবা কল দিয়ে বলল নওমিনের ফুফুশাশুড়ি মারা গেছে। বিকাল ৩টায় আপনাকে নিয়ে জানাযায় কদমতলী যাবো। কদমতলীতে জানাযা দোয়া সেরে তালই সাহেবের কথামত তার প্রধান বাড়িতে রাত ১০টা পর্যন্ত শরবত, তালের আঁশ, কলা, আংগুর, নাসপাতি, নুডলস, নান রুটি, গ্রীল ইত্যাদি খেতে খেতে ওভার লোডেড হয়ে শীতলক্ষা নদী পার হয়ে রাতের আধারে আবার সেই কুতুবপুর ফিরে আসলাম।
এবার আসলাম সিদ্ধিরগঞ্জের আইয়ুব নগরে। আইয়ুব নগরের অধিবাসী জামায়াতের রোকন এমদাদ ভাবী সিরাজুন সিদ্ধিকা ১০ মে শনিবার ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের অধিকারী করুন। ১৭ মে শনিবার আসর বাদ দুই মেয়ের পরিবারসহ আমার পরিবারের সবাই সেই আইয়ুব নগরের এমদাদ ভাইয়ের বাড়িতে খাবার দাবারসহ দোয়া, সমবেদনা, শোকাহতদের সাহস দেওয়া ইত্যাদি উদ্দেশ্য নিয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত অবস্থান করি একান্তভাবে পারিবারিক বন্ধনে। সেখানেও সেই সোনালি মাটির সোনালি ফলমূল আপেল, আংগুর, মাল্টা, নুডলস, পিঠা, পুড়ি, বিস্কুট, চা ইত্যাদি না খেয়ে পারিনি।
ইতোমধ্যে সুযোগ এলো সোনার চেয়েও খাঁটি গ্রাম ঐ বড়গাও বেড়ানোর। কুতুবপুর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কালিগঞ্জে পৌঁছানোর বিরল সুন্দর সিএনজি ভ্রমণ। গাজীপুর জিলার ঐ কালিগঞ্জের বড়গাঁও অতি বিখ্যাত এক গ্রাম। আমরা যে অভিজাত পরিবারে বেড়াতে আসলাম এখানেই ঘুমিয়ে আছেন জান্নাতি অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী। তিনি হলেন বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের নেতা, অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল।
তাঁরই নিজ হাতে গড়ে তোলা সুন্দর মসজিদে এসে জোহরের সালাত আদায় করে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি। মসজিদের ডান পাশেই সেই মহান ব্যক্তিত্ব মরহুম অধ্যাপক ইউসুফ আলী রাহিমাহুল্লাহর কবর। মনের দাবি মোতাবেক এবার দুজনে দাঁড়িয়ে আন্তরিক দোয়া করতে করতে তাঁর কবর জিয়ারত করলাম। বিরল এ মানুষটির রূহ মুবারকে আল্লাহর সন্তুষ্টি, শান্তিময় রহমত ও জান্নাতুল ফেরদৌসের অনাবিল সুখ নাজিলের আন্তরিক আবেদন জানাই মহামহিম আল্লাহর দরবারে। আকুলভাবে দোয়া করলাম- যেন এ গ্রামে আরো এমন মানুষের আগমন হতে থাকে অনেক। এমন মানুষের গ্রামে বেড়াতে এসে আমরা গর্ববোধ করতে লাগলাম। বড়গায়ের বাড়ি থেকে মৌসুমি ফল ভোগের অনেক সুযোগ পেয়ে নিজেদের খুবই ভাগ্যবান মনে করতে লাগলাম। আমার মেয়ে কুবরা সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শহুরে পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছে। সেখানেই সরকারি কোয়ার্টারে বড় হয়ে ইট শুরকির কালচারে নিরস বন্ধনের শুকনা জীবনধারায় অভ্যস্ত। অনেক দিন পর আবার এমন সুন্দর গ্রামে এসে ভোর থেকেই আমার সেই মেয়েটি ব্যস্ত হয়ে গেল কাঁচা ও তাজা সুস্বাদু সব ফলমূল ভোগ করা ও অন্যদের জন্য সংগ্রহ করতে। তার এ মানবসেবা ও আত্মত্যাগে বিরল গুনের জন্য আমি জানাই আন্তরিক মুবারকবাদ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে শুধু ওপর নির্ভরশীল হবার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : সমাজসেবক।