সীমান্তের অর্ধশত স্থান দিয়ে দেশে আসে মাদক, হুন্ডিতে টাকা যায় ভারতে


২৯ মে ২০২৫ ১১:১৬

আবদুল বাছেত মিলন, সিলেট : সিলেটের জকিগঞ্জে মাদক ব্যবসায়ীদের তৎপরতা দিন দিন বেড়েই চলছে। মাদকের সহজলভ্যতায় বিপথগামী হচ্ছে তরুণসমাজ। তাতে উদ্বিগ্ন সচেতন মহল। একসময় বার্মা থেকে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে মাদকের বড় চালান আসতো। কিন্তু কয়েক বছর থেকে মাদকবিরোধী অভিযান জোরদারের পর দেশের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা রুট পরিবর্তন করে জকিগঞ্জ সীমান্তকে মাদকের নিরাপদ ট্রানজিট হিসেবে বেছে নিয়েছে। এ সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে দেদার ইয়াবা, মদ, গাঁজা, ফেন্সিডিল, হেরোইনসহ হরেক রকম মাদক বাংলাদেশে এনে সারা দেশে পাইকারি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রতিদিন হুন্ডির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা যায় ভারতে। এরপর রাতে জকিগঞ্জ সীমান্তের অন্তত অর্ধশতাধিক স্থান দিয়ে মাদকের বড়োসড়ো চালান দেশে ঢোকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে প্রায় সময় মাদকের ছোট-বড় চালান ধরা পড়ে। গ্রেফতার হন মাদক বহনকারী। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান চোরাকারবারের মূলহোতারা। এ কারণে মাদক ব্যবসা অপ্রতিরোধ্য হয়ে গেছে। একসময় জকিগঞ্জে যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরাতো, তারা এখন রাতারাতি বিপুল টাকার মালিক বনে গেছেন। দৃশ্যমান তাদের আয় রোজগারের কোনো পথ না থাকলেও মাদকের টাকায় বাড়ি-গাড়িসহ জায়গা ক্রয় করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেনÑ এমন মানুষের সংখ্যা জকিগঞ্জে কম নয়।
মাদক ব্যবসায় জকিগঞ্জে এখন মোরগের ফড়িয়া, টমটম, ভ্যান, রিকশাচালক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের কিছুসংখ্যক নেতাকর্মী ও কতিপয় জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত লিপ্ত হয়েছেন। মাদক ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি হুন্ডি ব্যবসায়ীরাও অবৈধ টাকার মালিক হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকবিরোধী অভিযান করলেও হুন্ডি ব্যবসায়ীরা নিরাপদে থাকেন। তবে পুলিশ ও বিজিবির দাবি, মাদক উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়। সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে। পুলিশের তথ্যানুযায়ী, গত কয়েকদিনে জকিগঞ্জে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে প্রায় ১৫টি মামলা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন অন্তত ২৬ জন আর ৩ কোটি টাকা দামের বিভিন্ন ধরনের মাদক উদ্ধার করা হয়েছে ।
বিশ্বস্ত সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বার্মা থেকে ইয়াবা ট্যাবলেটসহ হরেক রকম মাদক চোরাকারবারিদের মাধ্যমে কয়েক হাত বদল হয়ে ভারতের কয়েকটি রাজ্য ঘুরে আসামের শ্রীভূমি (করিমগঞ্জ) জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় এনে মজুদ করা হয়। এরপর দু-দেশের মাদক ব্যবসায়ীদের আলাপচারিতায় টাকা লেনদেন হয় হুন্ডিতে। ভারতের চোরকারবারিদের হাতে টাকা পৌঁছার পর রাতে বাংলাদেশে মাদকের চালান পাঠানো হয়। জকিগঞ্জ উপজেলার তিনদিক ভারতবেষ্টিত। দক্ষিণে ভারতের আসাম ও উত্তরে মেঘালয় রাজ্য। ভারতের সঙ্গে প্রায় ৫৪ কিলোমিটারের সীমান্ত এলাকা। ফলে ভারত থেকে এ সীমান্তের অন্তত অর্ধশতাধিক স্থান দিয়ে সহজে মাদকের চালান দেশে আনা যায়।
সূত্র জানায়, প্রতিদিন রাতে জকিগঞ্জ সীমান্তের বিরশ্রী ইউপির বড়চালিয়া, পীরনগর, লক্ষ্মীবাজার, গড়রগ্রাম, খলাছড়া ইউনিয়নের লোহারমহল, কাপনা, মাদারখাল, চিরপাল, নরসিংহপুর, জকিগঞ্জ পৌরসভার হাইদ্রাবন্দ, পীরেরচক, মাইজকান্দী, জকিগঞ্জ ইউনিয়নের ছবড়িয়া, বাখরশাল, মানিকপুর, সেনাপতিরচক, লালোপাড়া, সুলতানপুর ইউনিয়নের ইছাপুর, সুলতানপুর, অজরগ্রাম, সহিদাবাদ, ভক্তিপুর, বারঠাকুরী ইউনিয়নের পিল্লাকান্দী, আমলশীদ, বারঠাকুরী, উত্তরকুল, লাড়িগ্রাম, কসকনকপুর ইউনিয়নের আইওর, উত্তর আইওর, বিয়াবাইল, বিরশ্রী ইউপির বড়চালিয়া, সুপ্রাকান্দী, মানিকপুর ইউপির কয়েকটি স্পটসহ পুরো উপজেলার অন্তত অর্ধশতাধিক স্থান পয়েন্ট দিয়ে ভারত থেকে ইয়াবা, মদ, গাঁজা, ফেন্সিডিল, হিরোইনসহ নানারকমের মাদকদ্রব্য দেশে ঢুকছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাদক ব্যবসায়ীরা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা দেওয়ার পর মুহূর্তেই রুপিতে রূপান্তরিত হয়ে পৌঁছে যায় ভারতে। এরপর রাতের বেলায় সুবিধাজনক সময়ে পলিথিনের বড় ব্যাগ দিয়ে মুড়িয়ে টিউবের মাধ্যমে অথবা বাঁশের সাহায্যে মাদকের চালান নদীতে ভাসিয়ে দেয় ভারতের চোরাকারবারীরা। আর বাংলাদেশি মাদক ব্যবসায়ীরা নদী থেকে তা তুলে আনে। মাদকবিরোধী অভিযান চললেও জড়িতরা ধরা পড়ছে কম। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মাদক বহনকারীরা ধরা পড়লেও মূল গডফাদাররা আড়ালে বসে নিরাপদে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে। শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা অন্তরালে থেকেই বিভিন্ন শ্রেণির লোককে দিয়ে মাদক পাঠায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। এর মধ্যে মাদকের চালান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বহনকারীসহ ধরা পড়লেও মূলহোতার নাম বের হয় না। এর পেছনেও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
সম্প্রতি মাদক মামলায় জেল থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া একাধিকজনের সঙ্গে ছদ্মবেশে আলাপ করে জানা গেছে, মাদক বহনকারীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পরণ মূলহোতার নাম প্রকাশ না করলে অনেক সুবিধা মেলে। ওই সুবিধাসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো মাদকের মূল মালিক গ্রেফতার ব্যক্তির পরিবারের খরচপাতিসহ যাবতীয় সুবিধা দেন এবং কয়েকদিনের মধ্যে জেল থেকে বের করে আনেন। এ সুবিধা থাকায় বহনকারীরা মূল গডফাদারের নাম প্রকাশ করেন না। জেল থেকে বের হওয়ার পর আবারও মাদক ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েকদিনে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে কয়েকটি বড় চালান ধরা পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চালান চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে বারঠাকুরী ইউনিয়নের উত্তরকুল গ্রামের মৃত নছির আলীর ছেলে ইউপি সদস্য আবদুল মুকিত (৫৫) বসতঘর থেকে জব্দ করা হয়। উদ্ধারকৃত চালানে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা পাওয়া যায়। এ সময় আবদুল মুকিত ও তার ছোট ভাই মো. আবদুল কাদির (৪৮)কে আটক করা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, ওই দুই সহোদর দীর্ঘদিন ধরে মাদকের ব্যবসা করে আসছিলেন। কিন্তু তারা কখনো গ্রেফতার হননি। বাড়িতে মাদক মজুদ করে পাইকারি ব্যবসা করতেন তারা। এর আগে গত বছরের ৫ মার্চ র‌্যাব-৯ জকিগঞ্জ পৌর এলাকার পূর্ব মাইজকান্দি গ্রামের খলিলুর রহমানের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তার ছেলে মোরগের ফড়িয়া হোসাইন আহমদ হুশাই (৩৫)-এর ঘর থেকে ৪৭ হাজার ১শ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। যার মূল্য ছিল ১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। অভিযানকালে মোরগের ফড়িয়া হোসাইন আহমদ হুশাই ও একই গ্রামের সিরাজ উদ্দিনকে আটক করা হয়। ওই চালানটি তখন সিলেটের সবচেয়ে বড় চালান ছিল। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই আসামিরা জেল থেকে বেরিয়ে এসে আবারও ব্যবসা শুরু করে। এর আগে ইয়াবা বিক্রির সময় আটক হন জকিগঞ্জের খলাছড়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড সদস্য শাহিন আহমদ ও ৬নং ওয়ার্ড সদস্য শাহাব উদ্দিন। গত ৯ এপ্রিল আয়শা (৩০) নামে এক নারী জকিগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জে ইয়াবা নিয়ে যাবার পথে আশুগঞ্জ থানা পুলিশের হাতে আটক হন। এর আগে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে জকিগঞ্জের শাহিনুর আক্তার (৩০) ও নাজমিন বেগম তামান্না (২১) নামে দুই নারীকে র‌্যাব-৯ সিলেট রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে থেকে ৩ হাজার ৮০৫ পিস ইয়াবাসহ আটক করে। ওই দুই নারী সম্পর্কে খালা-বোনঝি। বিশেষ ব্যবস্থায় তারা ইয়াবার চালান ঢাকার মিরপুরে নিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা সিন্ডিকেটের নাম বলেনি। র‌্যাব ও পুলিশের ধারণা শুধু তামান্না ও শাহিনুর আক্তার নয়। ইয়াবা বহনে একটি মহিলা চক্র রয়েছে। মহিলাদের দিয়ে নিরাপদে ইয়াবা বহন সম্ভব। এ কারণেই ইয়াবা চক্রের সদস্যরা অসহায় নারীদের দিয়ে ইয়াবা পাচার করছে।
সীমান্তের একাধিক ব্যক্তি নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, রাত হলেই সীমান্তে মাদক ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বাড়ে। বিভিন্ন এলাকা থেকে দামি গাড়ি ও মোটরসাইকেল নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা ছদ্মবেশে সীমান্তে এসে মাদকের হিসাব-নিকাশ করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে তারা নানা কৌশলও অবলম্বন করেন। বেশিরভাব মাদক ব্যবসায়ীরা সবসময় সিক্রেট সিম কার্ড ব্যবহার করে এবং ভারতীয় সিম দিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে মোবাইল ফোনে ভারতের লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে দেখা যায়। এরপর মাদকের চালান আসে। সীমান্তের লোকজন মাদকের বিরুদ্ধে কথা বললে নানাভাবে হেনস্তার শিকার হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চোরাকারবারের সাথে সম্পৃক্ত এক যুবক জানায়, প্রতিদিনই সীমান্ত এলাকার অর্ধশতাধিক স্থান দিয়ে আসছে নানা ধরনের বিপুল পরিমাণ মাদক। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবার চাহিদা বেশি থাকায় এর চালান বেশি আসে। মাদক বহনে ব্যবহার হয় নারী-পুরুষ, যুবক, যুবতী, কিশোর ও শিশুরা। গত আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে প্রতিদিন বড় চালান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়েছে। ওইসময়ে মাদক ব্যবসায়ীরা বড় অঙ্কের টাকা কামিয়েছে। এখনো সুযোগ বুঝে চালান ছাড়া হয়। তার ভাষ্যমতে, দেশের অন্য সীমান্তগুলোয় মাদক ব্যবসায় কড়াকড়ি রয়েছে। এর তুলনায় জকিগঞ্জ সীমান্ত মাদক ব্যবসার সুবিধাজনক রুট। এ কারণে দেশের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। ওই চোরাকারবারী আরও জানায়, মাদকবিরোধী অভিযান কঠোর হলে তারা কৌশল পরিবর্তন করে। কিন্তু মাদক ব্যবসা কখনো বন্ধ হয়না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যেসব চালান ধরা পড়ে, সেই চালানের মালিক প্রকৃতপক্ষে বহনকারী ব্যক্তির নয়। যাদের কাছে মাদকের চালান পাওয়া যায়, তারা টাকার বিনিময়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় শুধু বহন করে। আটকরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে মূল ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ না করলে গ্রেফতার ব্যক্তিকে তার মালিক জেল থেকে বের করে নিয়ে আসে। এমনকি পরিবারের খরচপাতিও দেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিবি জকিগঞ্জ ক্যাম্পের নায়েক সুবেদার ফারুক আহমেদ বলেন, মাদক উদ্ধারে বিজিবি তৎপর রয়েছে। সীমান্তে টহল জোরদার আছে। ভারত থেকে মাদকের চালান আসা বন্ধ করতে বিজিবি কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া কোন প্রশ্নের জবাব দিতে তিনি অপরাগতা প্রকাশ করেন।
জকিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম মুন্না জানান, মাদকের বড় গডফাদারদের ধরতে পুলিশ কাজ করছে। গত কয়েকদিনের মধ্যে ২৬ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার ও প্রায় ৩ কোটি টাকার মাদক উদ্ধার করে ১৫ টি রুজু করা হয়েছে। হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। মাদকের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।