কুষ্টিয়ায় কুরবানি উপলক্ষে প্রস্তুত দুই লক্ষাধিক পশু, ন্যায্যমূল্যের আশায় খামারিরা
২৯ মে ২০২৫ ১১:১১
কুদরতে খোদা সবুজ, কুষ্টিয়া : আসন্ন ঈদুল আজহা সামনে রেখে কুষ্টিয়ায় প্রায় ২ লক্ষাধিক কুরবানির পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। কুরবানির পশুর হাটগুলোয় কুষ্টিয়ার গরুর বাড়তি চাহিদা থাকায় এ বছরেও অনেক কৃষক, খামারি গরু পালন করেছেন। কুরবানির বাজার ধরতে তাদের পোষা প্রাণীটির পরম যত্ন-আত্তি করছেন খামারিরা। প্রাকৃতিক উপায়ে ও দেশীয় পদ্ধতিতে গরু লালন-পালন এবং মোটাতাজা করেছে জেলার খামারিরা। বাড়তি লাভের আসায় শেষ মুহূর্তে পশুর পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্যানুযায়ী। চলতি বছর কুষ্টিয়া জেলায় প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার খামার ও কৃষকের বাড়িতে ২ লক্ষাধিক গরু-ছাগলসহ বিভিন্ন প্রজাতির কুরবানির পশু মোটাতাজা করা হচ্ছে। এসব কোরবানির পশু স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হবে। বিভিন্ন খামারি ও পশু পালনকারী বলছেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি রয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। পরিচর্যার খরচ বেড়েছে। ফলে কাক্সিক্ষত ক্রেতা আসবে কিনা, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। তারা বলছেন, করোনার সময় থেকে তেমন লাভ করতে পারেননি। এবারও লাভের আশায় পশু পালন করেছেন। মানুষের ব্যয় বাড়লেও বাড়েনি আয়। গরু আমদানি হবে কিনা, তা নিয়েও শঙ্কিত তারা। এবার জেলায় সবচেয়ে বেশি কুরবানির পশু প্রস্তুত করা হয়েছে সীমান্তবর্তী দৌলতপুর উপজেলায়।
দৌলতপুর উপজেলার সাদীপুর গ্রামের খামারি জিয়াউল ইসলাম জানান, পশু খাদ্যের দাম বাড়ায় গরু লালন-পালনে খরচ বেড়েছে। তাই ন্যায্যমূল্য না পেলে লোকসান গুনতে হবে। তবে তিনি লাভের আশা করছেন। আবার পশুর খামারে কাজ করে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। দিন-রাত পরিচর্যা করে কুরবানির পশুরহাটে পশুগুলো তুলতে শেষ মুহূর্তে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারাও। কোনো ক্ষতিকর ও ভেজাল খাদ্য ছাড়া দেশীয় পদ্ধতিতে খাবার খাইয়ে গরু মোটাতাজা বা হৃষ্টপুষ্ট করা হয়েছে।
কুমারখালী উপজেলার যদুবয়রা ইউনিয়নের জোতমোড়া গ্রামের খামারি হান্নান মোল্লা। সারা বছর বাড়িতে কমবেশি গরু পালন করেন। ঈদ সামনে, তাই লাভের আশায় গরুর সংখ্যা বাড়ান। এবারো তার খামারে ছোট বড় মিলিয়ে ৬টি গরু রয়েছে। দিন-রাত গরু পরিচর্যায় সময় পার করছেন। তবে ঈদ যত এগিয়ে আসছে তার চিন্তা তত বাড়ছে। ক্রেতা কম থাকায় লাভের আশা দূরের কথা বাজারে নিয়ে গরু বিক্রি করে আসল তুলতে পারবেন কি নাÑ এটা তার সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
হান্নানের মতো বেশিরভাগ খামারির গরু বিক্রি করা নিয়ে এখন থেকে নানা চিন্তা শুরু করেছেন। তবে কম লাভ হলেও অনেক খামারি স্থানীয় বাজারে আগেই গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিম্নবিত্ত এবং দরিদ্র শ্রেণির মানুষ গরু লালন-পালন করে থাকেন। এসব পরিবার তাদের বাড়ির আঙিনায় গড়ে তুলেছেন খামার। সব খামারেই দেশি ছোট ও মাঝারি সাইজের গরু পালন করা হয়। তারা স্বপ্ন দেখেন সারা বছর লালন করা গরু বিক্রি করে কিছুটা স্বাবলম্বী হবেন। বিশেষ করে রিকশা, ভ্যান, অটোচালক কিংবা দিনমজুর নানা পন্থায় কিছু টাকা জমিয়ে অথবা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ছোট ছোট গরু কিনে লালন পালন করেন।
খামারিরা জানান, প্রতি কুরবানির ঈদের দু-এক মাস আগে থেকেই হাটে হাটে ঘুরে ব্যাপারিরা গরু কিনে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যেত। এবার সেই সংখ্যা অনেক কম। জেলায় বড় পশুর হাট রয়েছে ১২টি। এসব হাট ছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলে আরো ছোট ছোট হাট-বাজারে বিক্রির জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার গরু-ছাগল নিয়ে আসছে খামারিরা। কিন্তু কেনাবেচা একদম কম। ঈদুল আজহার আরও কিছুদিন বাকি থাকলেও বাইরের ব্যাপারীদেরও দেখা মিলছে না।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বড় আইলচারা গ্রামের বাসিন্দা বোরহান উদ্দিন মণ্ডল প্রতি বছর কুরবানি উপলক্ষে পশু প্রস্তুত করেন। তিনি আর সাধারণ খামারিদের মতো নয়, তার লক্ষ্য বড় বড় গরু কুরবানি উপলক্ষে প্রস্তুত করা, যা অন্য খামারিদের থেকে আলাদা। ঈদ উপলক্ষে এবার প্রস্তুত করেছেন অন্তত ১৭টি গরু। যার মধ্যে ৬টি গরু এবারের ঈদে বিক্রি করবেন। অবশিষ্ট গরু পরের কুরবানির জন্য প্রস্তুত করবেন।
এবারের ঈদের জন্য বোরহান উদ্দিন যে ৬টি গরু প্রস্তুত করেছেন এগুলো বিশালদেহী। একেকটি গরুর ভিন্ন নাম রেখেছেন তিনি। কোনোটির নাম বাংলার ডন, কোনোটির নাম বাংলার মাফিয়া। আবার কোনোটির নাম হামজা, আলিফ, সুলতান কিংবা বাদশা নামেও নামকরণ করা হয়েছে গরুগুলোর। সবচেয়ে দীর্ঘদেহী গরুর মধ্যে বাংলার ডন আর বাংলার মাফিয়া অন্যতম। কুচকুচে কালো এ গরুটির উচ্চতা ৭০ ইঞ্চি। ওজন প্রায় ৪৫ মণ। দীর্ঘদেহী এ গরুটি সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেয়া কঠিন। তাই বাজারে নিবেন না বলে জানান খামারি বোরহান উদ্দিন মণ্ডল।
তিনি বলেন, বাংলার ডন নামে গরুটির দাম ধরেছেন ২১ লাখ টাকা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যাপারিরা আসেন গরু কেনার জন্য। কাক্সিক্ষত দাম হলে তিনি গরুটি বিক্রি করবেন। প্রায় একই উচ্চতাসম্পন্ন গরু বাংলার মাফিয়া। এটারও ২১ লাখ টাকা দাম নির্ধারণ করেছেন তিনি। অন্য ৫টি গরু তিনি ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকা হলে বিক্রি করবেন।
তিনি জানান, পাকিস্তানি ক্রস জাতীয় এসব গরু বছর দুয়েক আগে থেকে লালন-পালন শুরু করেন তিনি। পরিবারের সবাই মিলে গরুর পরিচর্যা করেন। খামার ছাড়া অন্য কোনো আয় নেই তাদের। তাই খামারই তাদের একমাত্র আয়ের উৎস।
খামারি বোরহান উদ্দিন আরও জানান, গরুর খাদ্য তালিকায় বিছালী, ভুসি, ঘাস রয়েছে। এর বাইরে গরু মোটাতাজাকরণে তিনি রাসায়নিক কোনো কিছু ব্যবহার করেন না। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে প্রস্তুত করে থাকেন গরু। প্রতিদিন গরু পরিচর্যায় তার খরচ হয় ১ হাজার টাকা থেকে ১২শ’ টাকা।
খামারি বোরহান উদ্দিন মণ্ডলের ছেলে গোলজার হোসেন গরু পরিচর্যায় দিনরাত পরিশ্রম করেন। দিনে চারবার গোসল করানোর কাজ বাবার সঙ্গে মিলেই করে থাকেন। অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ হলেও তাতে ক্লান্তি নেই তার। বরং এর মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পান তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ পারভেজ জানান, বোরহান উদ্দিন মণ্ডল প্রতি বছরই কুরবানির পশু পালন করে থাকেন। তার কালেকশন অন্য সবার থেকে আলাদা। অন্যতম সেরা গরুই তিনি লালন-পালন করে থাকেন।
কুমারখালী উপজেলার সদকী ইউনিয়নের হুদা গ্রামের কৃষক জামাল হোসেন বলেন, ৫৫ কেজি বস্তার গমের ছালের ভুসির দাম গতবার ছিল প্রায় ২ হাজার ২০০। এবার সেটি প্রায় ২৪০০ টাকা হয়ে গেছে। ৫০০ টাকার গুঁড়া হয়েছে ৮০০ টাকা। চার-পাঁচ টাকা আঁটি বিছালি কিনেছেন সাত-আট টাকায়। বড় খামারি ও ব্যবসায়ীরা মজুত করায় দাম বাড়ে।
পশু মোটাতাজা করার জন্য ছাল, ছোলা, খেসারি, খুদ, গুঁড়া, খৈল, অ্যাংকর, ডাল, খড় খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়।
স্থানীয় কুমারখালী স্টেশন বাজারসংলগ্ন ছালপট্টি এলাকার ব্যবসায়ী মতিয়ার রহমান বলেন, ৩৯ কেজির বস্তা খুদ ১ হাজার ৫২০, অ্যাংকরের ভুসি ১ হাজার ১৭০, ৫৫ কেজির বস্তা ছাল ২ হাজার ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি ১৫০-২৫০ টাকা।
কুমারখালী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন বলেন, রমজানের ঈদেও অনেক পশু বিক্রি হওয়ায় সংখ্যা কিছুটা কমেছে। এবার ভালো দাম পাবেন খামারিরা।
কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, পশু বিক্রির জন্য চারটি সাপ্তাহিক হাট রয়েছে। অনলাইনেও চলে বেচাকেনা। বাজার তদারকির ব্যবস্থা করা হবে।
কুষ্টিয়া জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার মো. আল মামুন হোসেন মণ্ডল জানান, কুরবানির পশুর জন্য প্রসিদ্ধ জেলা কুষ্টিয়া। এখানকার গরুর চাহিদা অন্য জেলার চেয়ে বেশি। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে কুরবানির পশু প্রস্তুত করে থাকেন এখানকার খামারিরা।