বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় কে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত?
২৯ মে ২০২৫ ১০:২০
॥ এফ শাহজাহান ॥
ভারতের বন্দর ব্যবহার করে অন্য দেশে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের পর বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকসহ বেশকিছু পণ্য আমদানিতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ভারত। ফলে দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে। এতে উভয়পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও শিগগিরই সুরাহার কোনো লক্ষণ নেই। দুই দেশের বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ এবং আমদানি-রপ্তানিকারকরা বলছেন, বাণিজ্যবৈষম্য বেশি থাকায় চলমান নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের ক্ষতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভারত গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলাদেশ গত ১৫ এপ্রিল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর ১৭ মে শনিবার বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যের আমদানিতে একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ভারতের কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বৈদেশিক বাণিজ্য দফতর (ডিজিএফটি) জানায়, ‘কোনো স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি রেডিমেট পোশাক ভারতে আমদানি করা যাবে না। তবে নব সেবা এবং কলকাতা সমুদ্রবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক ভারতে আসতে পারবে।’
ডিজিএফটি আরও জানায়, ফল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য, তুলা, সুতির পোশাক, প্লাস্টিক এবং পিভিসি দিয়ে তৈরি জিনিস, রঞ্জকের মতো পণ্য, কাঠের আসবাবপত্র বাংলাদেশ থেকে আসাম, মিজোরাম, মেঘালয় কিংবা ত্রিপুরার কোনো শুল্ককেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবে না। পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা এবং ফুলবাড়ি শুল্ককেন্দ্রের ক্ষেত্রেও একই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ থেকে মাছ, এলপিজি, ভোজ্যতেলের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এছাড়া ভারত হয়ে নেপাল বা ভুটানের মতো দেশে ওইসব পণ্য যাওয়ার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকবে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘‘ভারত বাংলাদেশি পণ্যে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় বাংলাদেশের বাজারে এখনো কোনো প্রভাব পড়েনি। নিজস্ব সক্ষমতা ব্যবহার করেই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এ সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। তিনি আশাবাদী যে, উভয়পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে নতুন এ সমস্যারও সমাধান করতে সক্ষম হবে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ বিষয়ে কাজ করছে বলে তিনি জানান।
সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে শেখ বশিরউদ্দীন আরও বলেন, ‘প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতায় টিকে থাকতে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান করা হবে।’ তিনি আরও যোগ করেন যে, উভয় দেশের ভোক্তা এবং উৎপাদনের স্বার্থে স্বাভাবিক বাণিজ্য চলমান থাকবে।
‘জারা’র মতো বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডের জন্য বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এমজিএইচ গ্রুপের প্রধান আনিস আহমেদ বলেন, ‘ফাস্ট ফ্যাশন রপ্তানিতে বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বিশাল ধাক্কা। ভারতের ওই রুট ধরে মালামাল ইউরোপ-আমেরিকায় পৌঁছাতে এক সপ্তাহের মতো সময় লাগতো। কিন্তু এখন সমুদ্রপথে তা পাঠাতে আট সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে।’
আনিস আহমেদ বলেন, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরের অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করা হয়েছে। এর মাঝে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে ভারতের বন্দর ব্যবহার করে।
গত ১৮ মে রোববার ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুর দিল্লি সংস্করণের খবরে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক চীন সফরে ভারতের সেভেন সিস্টার নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের করা মন্তব্যের পটভূমিতেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি বার্তা দিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সরকারি সূত্রে পত্রিকাটিকে জানানো হয়েছে।
দ্য ইকোনমিক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে এখন প্রতি বছর ভারতে ৬১.৮ কোটি ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রফতানি করা হয়, যেটা এরপর থেকে কলকাতা ও নহভা সেভা (মুম্বাই) সমুদ্রবন্দর ছাড়া আর কোনো রুটে আনা যাবে না।
বাণিজ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিটিআরআইয়ের একটি রিপোর্ট উদ্ধৃত করে দ্য ইকোনমিক টাইমস আরও জানিয়েছে, ‘‘ঢাকার ‘ডিপ্লোম্যাটিক পিভট’ বা কূটনৈতিক ভারসাম্য যে চীনের দিকে ঝুঁকছে; ভারতের এসব বিধিনিষেধ তারই জবাব বলে মনে করা যেতে পারে।’’
গত ২৩ মে শুক্রবার ভারতের সাবেক কেন্দ্রীয় আমলা এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সাবেক এমপি জহর সরকার জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারত বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ জিনিস আমদানি করে, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি রপ্তানি করে। বাংলাদেশ বেশ কিছু ভারতীয় পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। যদিও সম্প্রতি বাংলাদেশ কিছুক্ষেত্রে এ ভারতনির্ভরশীলতা খানিকটা কমাতে পেরেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বরাবরই ভারতের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড বা মুক্ত বাণিজ্যনীতি চেয়ে এসেছে। বাংলাদেশের বর্তমান শাসকও নীতিগতভাবে তা চান বলেই আমার ধারণা। উত্তর-পূর্ব ভারতে এবং পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের এ অঞ্চলও বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। ফলে বাণিজ্য পথের ওপর নিষেধাজ্ঞা তৈরি হলে তার প্রতিফলন দুই দেশের বাজারের ওপরই পড়বে। জিনিস-পত্রের দাম বাড়তে শুরু করবে এবং শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী হবেন।
তিনি বলেন, আমাদের যথেষ্ট ঔদার্য দেখানো উচিত ছিল। বাণিজ্য বন্দরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি একটি বড় কূটনৈতিক পদক্ষেপ। এ সময়ে এ কাজের প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি না।
দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্কের জটিল জালে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন থাকলেও ২০২৫ সালের মে মাসে ভারতের একতরফাভাবে বাংলাদেশের কিছু পণ্য, বিশেষত তৈরি পোশাক, স্থলপথে আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এক বহুল আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের এ বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা শুধু দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিপ্রেক্ষিতেই নয়, বরং এর ফলে কে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ভারত না বাংলাদেশ; সেই প্রশ্নটিও এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের এ পদক্ষেপ হয়তো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা আন্তর্জাতিক কৌশলের প্রতি চাপ প্রয়োগের একটি কৌশল হতে পারে। তবে এতে করে ভারতের লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাই যে বেশি, তা প্রমাণিত সত্য। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক উন্নয়ন এবং ২০২৫ সালের মধ্যবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা নিশ্চয় ভারতের অতিরিক্ত উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
এ নিবন্ধে ৪টি গুরুত্বপূর্ণ অনুষজ্ঞ বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের একতরফা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় কে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, না নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রথমত : বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার প্রকৃতি ও প্রেক্ষিত
২০২৫ সালের মে মাসে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয় যে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, পাটজাত পণ্য এবং কিছু কৃষিপণ্য স্থলপথে আমদানি নিষিদ্ধ থাকবে পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত (India Ministry of Commerce & Industry, 2024)| ।
যদিও এ নিষেধাজ্ঞা বিমান ও নৌপথে প্রযোজ্য নয়, তবুও স্থলপথের গুরুত্ব এতটাই প্রবল যে, বাংলাদেশের প্রায় ৬৫% পণ্য ভারতে স্থলবন্দর দিয়েই প্রবেশ করে।
দ্বিতীয়ত : বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশ ও ভারতের ওপর অর্থনৈতিক প্রভাব
ভারতের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় বেশি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর। কারণ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের বার্ষিক রপ্তানি আয় প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার, যার ৮০% যায় ইউরোপ ও আমেরিকায়। ভারতীয় বাজার তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও, বাংলাদেশের নন-ব্র্যান্ডেড গার্মেন্টস, আন্ডারগার্মেন্টস ও সস্তা টেক্সটাইল ভারতে চাহিদাসম্পন্ন।
ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমে গেলে এ খাতে কমপক্ষে ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে, যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে খুলনা, যশোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা তাৎক্ষণিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।
স্থলপথে পণ্য রপ্তানির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশের প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক, ড্রাইভার, খালাসি এবং কাস্টমস হ্যান্ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পাশাপাশি সীমান্তবর্তী বন্দরে চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় লোকসান গুণতে হচ্ছে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি ও পণ্য রপ্তানিকারকদের।
ভারতের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের নৌপথ ও বিমানপথ বিকল্প হলেও পরিবহন খরচ গড়ে ২০৩০% বেড়ে যায়। ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে, যা দীর্ঘমেয়াদে রপ্তানি হ্রাসের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
অপরদিকে ভারতের সম্ভাব্য ক্ষতির দিকগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কম দামি গার্মেন্টস, চটের ব্যাগ, মাছ ও পেঁয়াজসহ কিছু কৃষিপণ্য ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো; বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরায় বেশ জনপ্রিয়। নিষেধাজ্ঞার ফলে এসব পণ্যের ঘাটতি তৈরি হবে এবং স্থানীয় বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিরোধীদলগুলো এর বিরোধিতা করতে পারে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার ব্যবসায়ী মহল থেকে চাপ তৈরি হতে পারে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। এর ফলে ভারতের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত দূরত্ব তৈরি করলে- চীন, তুরস্ক, ভিয়েতনাম বা পাকিস্তান সুযোগ নিতে পারে। চীন ইতোমধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ ভারতের বিকল্প বাজারে অন্যরা আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবে। এতে ভারতের কৌশলগত প্রভাব কমতে থাকবে।
এ বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের একটি পরিসংখ্যানভিত্তিক পর্যালোচনা করা দরকার। এজন্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির পরিসংখ্যান এবং ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানির পরিসংখ্যানটা এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির পরিমাণ
বাংলাদেশ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে, যার মধ্যে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, পাটজাত পণ্য, মাছ ও কৃষিপণ্য উল্লেখযোগ্য (EPB, 2024)। স্থলপথে রপ্তানির পরিমাণ ছিল এর প্রায় ৭০% (Hossain, 2023)।
ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানির পরিমাণ
ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানির পরিমাণ অনেক বেশি। প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে বিদ্যুৎ, খাদ্যশস্য, ইস্পাত, কাঁচামাল, ও রাসায়নিক দ্রব্য শীর্ষে (Indian Ministry of Commerce & Industry, 2024)।
এ পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় যে, ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির তুলনায় বাংলাদেশ ভারতের পণ্যের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। তবে প্রশ্ন হলো, নিষেধাজ্ঞার কারণে কাদের ওপর প্রকৃত আর্থিক ও কৌশলগত চাপ পড়বে?
তৃতীয়ত : বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিরোধীদলগুলো এর বিরোধিতা করতে পারে; বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার ব্যবসায়ী মহল থেকে চাপ তৈরি হতে পারে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। এর ফলে ভারতের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
চীন ইতোমধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে (World Bank, 2023)। ফলে বাংলাদেশ ভারতের বিকল্প বাজারে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবে। এতে উপমহাদেশের রাজনীতিতে ভারতের কৌশলগত প্রভাব কমতে পারে। সেই সঙ্গে মালদ্বীপের পাশাপাশি ভারতের আরেক নিকটতম প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরো খারাপ হবে। যেটা ভবিষ্যতে ভারতকেই ভোগাবে।
বাংলাদেশ সরকার ভারতের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিল্লির হাইকমিশনের মাধ্যমে আলোচনার ইচ্ছা জানিয়েছে। ভারতীয় পক্ষ এখনো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না জানালেও ধারণা করা হচ্ছে, বিষয়টি রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে যাবে।
কূটনৈতিক সম্পর্ক ও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের এ পদক্ষেপ হয়তো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা আন্তর্জাতিক কৌশলের প্রতি চাপ প্রয়োগের একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তবে এটা দীর্ঘস্থায়ী হলে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক উন্নয়ন এবং ২০২৫ সালের মধ্যবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সবচেয়ে জটিল উদ্বেগের কারণ হতে পারে (Kumar, 2022)।
চতুর্থত : উভয় দেশের জন্য ভবিষ্যতের পথনির্দেশনা
ভারতের একতরফা বাণিজ্য নিশেধাজ্ঞা মোকবিলায় বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে চীন, তুরস্ক, আফ্রিকায় বিকল্প বাজার খুঁজে রপ্তানিকে বহুমুখীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশের স্থলপথের বিকল্প হিসেবে নৌপথের আরো উন্নয়ন করাও জরুরি। আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তিতে (BIMSTEC, BCIM) সক্রিয় ভূমিকা রাখা এখন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একতরফা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ভারতের উচিত হবে নরম কূটনৈতিক পথ বেছে নেওয়া, যাতে দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট না হয়। ভারতের উচিত হবে-বাংলাদেশের সঙ্গে লাগোয়া সীমান্ত রাজ্যগুলোর ব্যবসায়ী স্বার্থ বিবেচনায় নেওয়া এবং সতর্কতার সঙ্গে বাংলাদেশের ওপর চীনের প্রভাব বৃদ্ধির ঝুঁকি মূল্যায়ন করা।
বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যবিরোধ নিষ্পত্তিতে আন্তরিকভাবে দ্বিপক্ষীয় মঞ্চ কার্যকর করার ক্ষেত্রে উভয় দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। সেইসঙ্গে একটি ‘ট্রান্সপারেন্ট ট্যারিফ ফ্রেমওয়ার্ক’ গঠন করাও জরুরি। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা একতরফাভাবে আরোপ করতে না হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ইতিহাস ও ভৌগোলিক বাস্তবতায় গাঁথা। ভারতের একতরফা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের ওপর তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করলেও এতে আখেরে ভারতই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ বাংলাদেশের বাজার হারানো ভারতের জন্য কখনোই সুখকর কিছু হবে না। বরং এ ধরনের সিদ্ধান্ত পারস্পরিক আস্থা নষ্ট করবে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তুললে, তা শেষ পর্যন্ত ভারতের ভবিষ্যতের জন্য ভালো নয়। বাংলাদেশ নিয়ে এখন ভারতের ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করা উচিত।
লেখক : সাংবাদিক, স্কুল অব জার্নালিজমের নির্বাহী পরিচালক।