অতি দ্রুত সংস্কার ও নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করে বিচারকার্য দৃশ্যমান করা প্রয়োজন -ডা. শফিকুর রহমান
২৯ মে ২০২৫ ১০:০৮
স্টাফ রিপোর্টার: আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, জনগণের আস্থা ফেরাতে এবং দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় অতি দ্রুত সংস্কার ও নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করে বিচারকার্য দৃশ্যমান করা প্রয়োজন। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হলে জাতি আবারো গভীর সংকটে পড়বে। তাই নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। দেশের সকল অংশীজনের আন্তরিক সহযোগিতা ও পরামর্শের ভিত্তিতে দেশ সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে, ইনশাআল্লাহ।
দেশ খুবই সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী গত ২২ মে বৃহস্পতিবার বিকালে দেশের এ সংকট উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করার জন্য তাৎক্ষণিক কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরি বৈঠক করে বিস্তারিত আলোচনা করেছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছে। গত ২৪ মে শনিবার সকালে রাজধানী ঢাকার মগবাজারস্থ আল-ফালাহ মিলনায়তনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার ষান্মাসিক অধিবেশনে সভাপতির সমাপনী বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীরবৃন্দ, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলবৃন্দসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা (পুরুষ ও মহিলা) সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন। অধিবেশনটি সকাল ৯টায় শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী দেশের সকল দল অন্তর্বর্তী সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করার আশ্বাস প্রদান করেছে। জামায়াতে ইসলামী সমমনা দলগুলোর সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ ও মতবিনিময় করেছে। আমি দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় দল-মতনির্বিশেষে দেশের সর্বস্তরের জনতাকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের পাশাপাশি মহান রবের নিকট দোয়া করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
দায়িত্বশীলদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এমন কোনো রুটি-রোজগারে জড়িয়ে না পড়ি, যাতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই। সংগঠনের কাজে সময় দেওয়ার পাশাপাশি পরিবারের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। সন্তানদের চক্ষুশীতলকারী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। লেনদেনে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। আমাদের মূল শক্তি হলো আল্লাহ তায়ালার ওপর তাওয়াক্কুল। আল্লাহর ভয় ও জবাবদিহি নিয়ে আমাদের প্রতিটা কাজ আঞ্জাম দিতে হবে।
আজকের এ অধিবেশনে এবং আমাদের পরিকল্পনায় কোনো ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলে আল্লাহ তায়ালা শুধরে দিন এবং তাঁর রহমত ও করুণা দিয়ে আমাদের ঢেকে রাখুন।
এর আগে ২৪ মে শনিবার সকালে রাজধানী মগবাজারস্থ আল-ফালাহ মিলনায়তনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে সংগঠনের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার ষান্মাসিক অধিবেশন হয়। এ সময়ও জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীরবৃন্দ, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলবৃন্দসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার (পুরুষ ও মহিলা) সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন।
সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান মজলিসে শূরার অধিবেশনে উদ্বোধনী বক্তব্য পেশ করেন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, স্বাধীনতার মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের এ দীর্ঘ পরিক্রমায় জাতির মূল প্রত্যাশার অনেকগুলো আজও অপূর্ণ থেকে গেছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হয়নি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের মর্যাদাপূর্ণ হেফাজত সংরক্ষণ করতে পারেননি। গত ১৫ বছরের শাসকগোষ্ঠী দেশকে দুঃশাসন উপহার দিয়েছে। তাদের পুরোটা সময় মানুষ দুঃস্বপ্নে বসবাস করেছে। জেল-জুলুমের স্টিমরোলার জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কাউকে বিচারের নামে প্রহসন করে আবার কাউকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। আয়নাঘর বানিয়ে গুমের সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে দেশে যা ঘটেছে, তার সাক্ষী দেশের আপামর জনগণসহ গোটা বিশ্ববাসী। ইতোমধ্যেই জাতিসংঘের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি এবং মানবাধিকার সংগঠন ঐ সময়ের সরকারকে স্পষ্টভাবে দায়ী করে জুলাই-আগস্টের ঘটনার একটি রিপোর্ট পেশ করেছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমরা জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে অবস্থান করছি। এ বাঁক সফলভাবে উত্তরণ করতে হবে। বিশেষ করে গত কয়েকদিনের ঘটনা প্রবাসীসহ দেশবাসীকে বিচলিত করেছে। এ ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামী একটি দায়িত্বশীল সংগঠন হিসেবে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। আমরা দ্রুততম সময়ে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরি সভা করে দেশের চলমান বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আলোচনায় আমরা বলেছি, সংঘাত-সংঘর্ষ এবং কাদা ছোড়াছুড়ি করে জাতিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া একেবারেই সমীচীন হবে না।
তিনি বলেন, জামায়াতের রাজনীতি দেশ ও জনগণের কল্যাণে। জামায়াত সবসময় জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দলীয় পরিকল্পনা-কর্মসূচি রচনা ও পরিচালনা করে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এ অনিশ্চয়তা উত্তরণে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে সর্বদলীয় ডায়ালগ করার আহ্বান জানিয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি, সকলের সন্তোষজনক আলোচনার মাধ্যমে জাতির আতঙ্ক ও আশঙ্কা দূর হবে এবং এ সংকটের উত্তরণ ঘটবে, ইনশাআল্লাহ। তিনি বলেন, ২০১৪-তে ১৫৪ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, ২০১৮-তে নিশি রাতের ভোট এবং ২০২৪-এ ডামি আর আমি’র প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে জাতির সাথে চরম তামাশা করা হয়েছে। এ অবস্থায় জাতিকে একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে হবে; যার মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটবে এবং জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমরা সরকারের কাছে সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করেছিলাম। সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় জনগণের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা সরকারের প্রতি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দাবি করছি। এরপর আমাদের দাবি ছিল ফ্যাসিবাদের সুষ্ঠু বিচার। এ বিচার প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ। তবে জাতির কাছে বিশ্বাসযোগ্য বিচারকার্য অনতিবিলম্বে দৃশ্যমান হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি দুটি স্পর্শকাতর বিষয় জাতির সামনে এসেছে। মানবিক করিডোর ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ব্যবস্থাপনা। এ ব্যাপারে সিকিউরিটি এক্সপার্ট এবং দেশের সকল পক্ষের সাথে আলোচনা করে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। অথবা নির্বাচিত পার্লামেন্ট-এর জন্য রেখে দেওয়া যেতে পারে।
সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী আমাদের গর্বের বিষয়। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে তাদের মর্যাদাপূর্ণ অবদান রয়েছে। সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা উচিত নয়। জাতির প্রত্যাশা সেনাবাহিনী স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার মাধ্যমে দেশ ও জাতির সেবা করবে এবং দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ও সেনাবাহিনী যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের দিকে নজর দিবে।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা একাধিকবার বলেছেন জাতীয় নির্বাচন তিনি এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে সম্পন্ন করতে চান। এতে আমাদের আস্থা রয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে চাই।
ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে আমীরে জামায়াত শান্তিকামী বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ফিলিস্তিনের জনগণ দশকের পর দশক ধরে নির্যাতিত এবং নিষ্পেষিত হচ্ছে। গাজা ও ফিলিস্তিনে মানবতাবিরোধী যুদ্ধ চলছে। আমরা জাতিসংঘসহ শান্তিকামী ও মানবতাবাদী বিশ্বসম্প্রাদয়কে যুদ্ধ বিরতি নয়, স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি। সিরিয়াকে সে দেশের জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী চলতে দেওয়া উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
আরাকান প্রসঙ্গে আমীরে জামায়াত বলেন, আরাকানের রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে সম্মান ও নিরাপত্তার সাথে পুনর্বাসিত করতে হবে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে।
আমীরে জামায়াত নিজ দলের দায়িত্বশীলদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সব ক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। সকল ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দিতে হবে।
সাংবাদিকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আপনারা সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আপনাদের রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। আমাদের প্রত্যাশা আপনাদের ইতিবাচক ভূমিকা সমাজকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আসুন, আমরা কালোকে কালো এবং সাদাকে সাদা বলি।
সব শেষে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে জনপ্রত্যাশার জায়গায় পৌঁছে দেয়ার জন্য আমাদের প্রিয় সংগঠন অতীতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে; ভবিষ্যতের জন্যও আমরা প্রস্তুত। আল্লাহ তায়ালার বিধানে বিশ্ব মানবতার কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়েছে। এ বিধানের মাধ্যমেই সব ধর্মের মানুষের জীবন-সম্পদ ও ইজ্জতের নিরাপত্তা এবং তাদের নিজ নিজ অধিকার নিশ্চিত করাই আমাদের লড়াই-সংগ্রাম, চেষ্টা-প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আসুন, আমরা একটি শান্তিপূর্ণ, দুর্নীতিমুক্ত মানবিক কল্যাণরাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ হই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রিয় দেশকে সকল ধরনের ক্ষতি ও ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করুন। অনৈক্য ও বিভাজন তৈরি না করি। দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিই।