আমার একখানা কথা আছে


২২ মে ২০২৫ ১৭:২৬

॥ আবদুল হালীম খাঁ ॥
দেশের ভালো-মন্দের সঙ্গে নাগরিকদের ভালো-মন্দ ও ভাগ্য জড়িত। সকল রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন মহল এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই দেশের কথা বলছেন। নাগরিক হিসেবে সবারই কথা বলার অধিকার আছে। পাকিস্তান আমল থেকে বর্তমান বাংলাদেশের ৫৪ বছরের শাসনব্যবস্থা এবং শাসকদের আমরা দেখে আসছি। দেখে আসছি দেশের উন্নতির নামে শাসকদের শাসন পদ্ধতি ও জনগণের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা, দুর্গতি, শোষণ, নির্যাতন। দেখছি শিক্ষার নামে মানুষকে ধর্মহীন ও চরিত্রহীন করে পশু-হায়েনা বানানোর সরকারের কুমতলব। বিগত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার কৌশল করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার, পৌরসভার মেয়র-কমিশনার, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, হাইস্কুল, কলেজ, ভার্সিটির শিক্ষক ও সকল কর্মচারী দলীয়, অযোগ্য ও লুটেরা এবং সন্ত্রাসী লোক নিয়োগ দিয়ে চারদিকের আটঘাট মজুদ করে বেঁধেছিল- যাতে তার বিরুদ্ধে আর কেউ কথা না বলতে পারে। এভাবে স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর রামরাজত্ব কায়েম করেছিল। রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করে তাকে সরানো তো দূরের কথা, একটু নড়াতেও পারেনি। বরং নেতাকর্মীদের জেলহাজত ও হাজার হাজার মামলা দিয়ে এমনভাবে দুর্বল করে ফেলেছিল যে, তারা আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। যারা অন্যায়-অবিচারের সামান্য প্রতিবাদ করতো, তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী, সন্ত্রাসী, মৌলবাদী, রাজাকার, পাকিস্তানপন্থী ইত্যাদি অভিযাগ দিয়ে খুন, গুম ও জেলে ঢুকিয়ে দিতো। ফাঁসি দিতো আর গোপন আয়নাঘরে নিয়ে হত্যা করে বস্তাবন্দি করে রাতে মেঘনা নদী দিয়ে ভাসিয়ে দিতো।
হাসিনা কত যে মায়ের বুক খালি করেছে, কত বধূকে স্বামীহারা করেছে, কত শিশুকে পিতাহারা করেছে, কত সুখের ঘরে আগুন জে¦লে দিয়েছে, কত নির্দোষ লোককে চাকরিচ্যুত করেছে, কতজনের ব্যবসা, দোকান, বাড়ি লুট করে নিয়ে বাড়িঘরছাড়া করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তিন সন্তানের এক মহিলাকে ধানের শীষে ভোট দেয়ার কারণে গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে গণধর্ষণ করিয়েছে। কত স্কুল-কলেজ, মাদরাসাছাত্রী ধর্ষিতা হয়েছে, ভার্সিটিতে জাঁকজমক করে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালিত হয়েছে, কোনো একটি অপরাধীর বিচার করেনি। সকল ডাকাত, চোর, খুনি, সন্ত্রাসী ও লুটেরাদের উৎসাহিত করেছে। ছাত্রলীগের গুণ্ডা-সন্ত্রাসীদের আমার সোনার ছেলে বলে বুকে তুলে নিয়ে উৎসাহিত করেছে। হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের অত্যাচার, খুন, গুম, ফাঁসি, জেল-জুলুম ও নির্যাতনে দেশের জনমনে যে দুঃখ, ক্ষোভ, ক্রোধ জমা হয়েছিল, তার বিস্ফোরণ ঘটেছিল ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে। তার সংগঠিত কোনো দল ও বাহিনী তাকে রক্ষা করতে পারেনি। তিনি পদত্যাগ করে চোরের মতো দেশত্যাগ করে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আর একটু দেরি হলেই উত্তেজিত ছাত্র-জনতা তাকে ধরে ছিঁড়ে-ফেড়ে টুকরো টুকরো করে লাশ কুত্তা দিয়ে খাওয়াতো, তাতে সন্দেহ নেই। হাসিনা দেশত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলন সফল হয়েছে। দেশের জনগণের মুখে হাসি ফুটেছে।
বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। এখন সকল ছাত্র-জনতার আশা এ সরকারের ওপর। পতিত খুনি সরকার বিগত সাড়ে ১৫ বছরে যত হাজার হাজার মানুষ খুন, গুম করেছে, জেলহাজতে বন্দি করে পচিয়ে মেরেছে, নির্দোষ মানুষকে ফাঁসি দিয়েছে, যত কোটি কোটি টাকা লুট করেছে, দেশে-বিদেশে মিলকারখানা গড়েছে, বাসাবাড়ি তৈরি করেছে সকল অপকর্মের বিচারের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স ৯ মাস অতিক্রম করেছে। এখন পর্যন্ত খুনিদের বিচার করেনি এবং খুনিদের বিচারের কথাও তেমন একটা বলছে না। বার বার বলছে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা এবং উৎসবমুখর নির্বাচনের কথা। জনমনে প্রশ্ন লেগেছে- রাষ্ট্র সংস্কারের কথা ও উৎসবমুখর নির্বাচনের মুলা জনগণের নাকের সামনে ঝুলিয়ে রেখে সরকার কি খুনিদের বিচার ভোলাতে চাচ্ছে নাকি? মজলুম ছাত্র-জনতা সকল বিচারের আগে চাচ্ছেন খুনি-সন্ত্রাসীদের বিচার। যে উৎপীড়িত ছাত্র-জনতা খুনি সরকার তাড়ানোর জন্য জীবন দিয়েছেন, আহত হয়েছেন, পঙ্গু হয়ে হাসপাতালে ও বাসাবাড়িতে চিৎকার করছেন, যারা বাড়িঘর ও চাকরি হারিয়েছেন, যারা মা-বাবা, ভাই-বোন হারিয়েছেন, তারা আগে চান খুনি অপরাধীদের বিচার। তারপরে চান রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচন। যে সকল ভাই শহীদ হয়েছেন, তাদের উত্তরাধিকারীরা খুনির বিচার না পেয়ে সংস্কারের আইনের কথা শুনে ও ব্যালট পেপার হাতে নিয়ে খুশি হবেন? পরিবারের রোজগারের যে ভাইরা পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন, হাসপাতালে চিৎকার করছেন, তারা কি ব্যালট পেপার বেঁটে খেয়ে সান্ত্বনা পাবেন? সবাই আগে চাচ্ছেন খুনি অপরাধীদের বিচার। তারপর নির্বাচন। দেশের জনগণের জানা আছে, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একসময় আন্দোলন শুরু করেছিলেন- ‘ভোটের আগে ভাত চাই, নইলে সরকারের রক্ষা নাই।’ সেই রকম ‘নির্বাচনের আগে খুনিদের বিচার চাই’ আন্দোলন হতে পারে মনে হচ্ছে।
খুনি অপরাধীরা অনেকে বিদেশে নিজস্ব বাসাবাড়িতে আরামে থেকে দেশের বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র করছেন। যারা এখনো দেশে নানা পদে বহাল রয়েছেন, তারা গোপনে সংগঠিত হয়ে নানারকম অপকর্ম করে যাচ্ছেন। তারা মিল-কারখানায়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কৌশলে আন্দোলনের বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছেন। এখনো ছাত্ররা নানারকম অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে এখনো ধর্ষণ, হত্যা অহরহ ঘটছে। এর কারণ কী? কারা এসব অপকর্ম করছে? কেন করছে? কেন তারা এসব অপকর্ম করার সুযোগ পাচ্ছে? আকাশে ইতোমধ্যে কিন্তু খণ্ড খণ্ড কালো মেঘ জমে উঠেছে। এর প্রধান কারণ হলো খুনি অপরাধীদের বিচারে ঢিলেমি করা। খুনি অপরাধীদের বিচার না করা। গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে যে, ‘ঢিলা কাছায় কোল বাড়ে’। কথাটা যে মহাসত্য, তা অন্তর্বর্তী সরকারে খুনিদের বিচারের ঢিলেমিতে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। বিচারে বিলম্ব করা মানে অপরাধীদের সুযোগ দেয়া। এ কারণেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। দেখা যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার যে সরিষা দিয়ে ভূত ছাড়াতে চাচ্ছে সেই সরিষার ভেতরে থোকা থোকা ভূত। হায়! অন্তর্বর্তী সরকার। দেশ-জনতার সকল আশায় গুড়েবালি পড়েছে নাকি! আমরা হতাশ নই। আমরা আশাবাদী। এ সরকারই জনগণের ভরসা। এ সরকার ব্যর্থ হলে দেশের যে কী ভয়াবহ অবস্থা হবে, তা ভাবা যায় না। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আগে নির্বাচনের দাবি তুলেছে। তারা মনে করছে নির্বাচন হলেই তারা সরকার গঠন করে সকল অপরাধের বিচার করে দেশের সব সমস্যা সমাধান করে ফেলবে। কিন্তু আমরা সেই পাক আমল থেকে বর্তমান বাংলাদেশের ৫৪ বছরের সরকারের শাসনব্যবস্থা দেখেছি। কোনো সরকারের শাসনব্যবস্থা জনগণের সমস্যা দূর করতে পারেনি। কোনো মানুষের অধিকার দিতে পারেনি। আমাদের জানা হয়ে গেছে, কোন শাসনব্যবস্থায় জনগণের কল্যাণ ও উন্নতি।
গলা উঁচু করে যে যত করুক চিৎকার
জানি জানি কেউ দিতে পারবে না অধিকার,
কেউ করতে পারবে না সমস্যার সমাধান
যদ্দিন আল কুরআন না হবে সংবিধান।
অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দেশের ছাত্র-জনতার প্রাণের সহজ বাংলা ভাষা বুঝে সর্বপ্রথম খুনি অপরাধীদের বিচার করে তারপর অন্য কাজে হাত দেয়া।