কবি আফজাল চৌধুরীকে যেমন দেখেছি
২২ মে ২০২৫ ১৭:২৫
॥ শরীফ আবদুল গোফরান ॥
নিউ এলিফ্যান্ট রোডে কেন্দ্রীয় ফুলকুঁড়ি আসরের অফিস। আমার বাসা তখন মতিঝিল কলোনেিত। প্রতিদিন মতিঝিল থেকে ফুলকুঁড়ি অফিসে আসতাম। আমি তখন ফুলকুঁড়ি আসরের মহানগরীর অফিস সম্পাদক। কবি মুকুল চৌধুরী কেন্দ্রীয় ফুলকুঁড়ির অর্থ সম্পাদক। কবি মুকুল ও শিল্পী আবদুল মান্নান অফিসেই থাকতেন। অফিসে এসে দেরি হয়ে গেলে অনেক সময় আমিও রাতে ফুলকুঁড়ি অফিসে থেকে যেতাম। রাতভর আড্ডা হতো। ফুলকুঁড়ির সাথে জড়িত অনেকেই এভাবে রাত কাটিয়ে দিতেন। রাতে খাওয়ার আয়োজন হতো। আমি ও কবি মুকুল চৌধুরী হাতিরপুল বাজার থেকে অনেক তরিতরকারি নিয়ে আসতাম। রান্না হলে রাতে সবাই মজা করে খেতাম। খাওয়া শেষে গল্প করে রাত কাটিয়ে দিতাম। আমাদের সাথে এ সময় আড্ডায় অংশ নিতেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক, কবি মহিউদ্দীন আকবর, খোরশেদ আলম, সাংবাদিক জেবুল আমিন দুলাল, সাংবাদিক আবদুর রাজ্জাক, কোনো কোনো সময় আসাদ বিন হাফিজসহ আরো অনেকে। কবি মুকুল চৌধুরী থাকতেন বলে সিলেটের কেউ ঢাকায় এলে ফুলকুঁড়ির ঠিকানায় চলে আসতেন। কবি সোলায়মান আহসানও আসতেন।
প্রতিদিনকার মতো সেদিনও আমি, মুকুল চৌধুরী, আবদুল মান্নান, সাংবাদিক জেবুল আমিন দুলাল, খোরশেদ আলম বসে বসে গল্প করছিলাম। রাত প্রায় ১২টা। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে মুকুল মুকুল ডাকও শোনা গেল। জিজ্ঞেস করতেই জবাব এলোÑ খুলুন, খুলুন। মুকুল আছে? আমি সিলেট থেকে এসেছি। ভাবলাম, সিলেট থেকে আবার কে এলো। কালই তো ‘সিলেট কণ্ঠ’ সম্পাদক মোকতাবিছুন নূর ভাই সিলেট চলে গেলেন।
মোকতাবিছ ভাই চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তরে সিলেট কণ্ঠ পত্রিকার অডিট করানোর জন্য এসেছিলেন। তাছাড়া তিনি ঢাকায় এলে এখানে থাকতেন। আমাদের সাথে আড্ডা দিয়ে তার সময়টা কেটে যেত। সাথে কবি মুকুল চৌধুরী তো আছেই। ভাবতে ভাবতে মান্নান গিয়ে দরজা খুললেন। মধ্যবয়সের একজন লোক ভেতরে প্রবেশ করলেন। ঢুকেই একগাল হাসি দিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কেমন আছ? কবি মুকুল চৌধুরী তো দেখামাত্রই চমকে উঠলেন। দেখেই আন্দাজ করলাম, কোনো গুণী মানুষ অবশ্যই। কাপড়-চোপড় ছাড়ার পর কবি মুকুল চৌধুরী আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার নাম বলার সাথে সাথে বলে উঠলেন, ও হ্যাঁ, সিলেট কণ্ঠে প্রায় তোমার লেখা দেখি। তিনি আমাদের সবার নাম জেনে গিয়েছেন। কিন্তু আমি কখনো তাকে এর আগে দেখিনি। অবশ্য আমি ছাড়া সবাই তাকে চেনেন।
মুকুল চৌধুরীর কানে কানে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কে? মুকুল বলল, আমার স্যার। কবি আফজাল চৌধুরী। কবিকে দেখামাত্র মন ভরে গেল। যার কত গল্প শুনেছি, কিন্তু কখনো তাকে এভাবে সামনা-সামনি দেখিনি। তার হাসি-খুশি মুখ ও আনন্দঘন পরিবেশে হৃদয়ে গেঁথে গেল তার প্রতি ভালোবাসা। তখনো ভাবতে পারিনি কবির সাথে এত সম্পর্ক হবে। আল্লাহ তায়ালা এ ভালো মানুষটির কাছাকাছি থাকার সুযোগ করে দেবেন। বেশ কয়েক বছর কবি আফজাল চৌধুরীর কাছাকাছি থাকার সুযোগ হয়েছে। এ সময়গুলোয় কবি কখনো ছিলেন আমাদের শিক্ষক, আবার কখনো কখনো অভিভাবক। যতদিন আমরা কবি আফজাল চৌধুরীর কাছাকাছি ছিলাম, ততদিন তিনি আমাদের বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে রেখেছেন। কিছুদিন তিনি আমাদের থেকে দূরে ছিলেন। কিন্তু দূরে থাকলেও আমাদের ভোলেননি। একদিন হঠাৎ করে দেখা হলো প্রীতি প্রকাশনীর সামনে। দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। দেখামাত্র জড়িয়ে ধরলেন। জিজ্ঞেস করলাম, স্যার কোথায় উঠেছেন। হোটেলে উঠেছি। তোমাদের দেখতে এলাম। কবি আফজাল চৌধুরীর সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এত অল্প সময়ে ওসব স্মৃতি লেখা যায় না।
কবি আফজাল চৌধুরী ছিলেন অমায়িক স্বভাবের ও সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ। জীবনাচরণে এবং কথাবার্তায় সর্বত্র তার এ সারল্য লক্ষণীয় ছিল। তিনি অতি সাধারণ ও অত্যন্ত সুদর্শন ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। এ মানুষটির গলার স্বর ছিল পৌরুষদ্বীপ্ত এবং ভরাট। আমি কখনো কবি আফজাল চৌধুরীকে রাগ করতে দেখিনি। সবসময় হাসি-খুশি থাকতেন। অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ, স্পষ্টভাষী ও সত্যবাদী কবি আফজাল চৌধুরী কখনো কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতেন না। আপন অন্তরে যা তিনি সত্য বলে জানতেন, তা প্রকাশ করতেন স্পষ্ট ভাষায় এবং সাহসী প্রত্যয়ে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদের দু-একটি ঘটনার সাথে আমি জড়িত ছিলাম। তখন দেখেছি বিপ্লবী আফজাল চৌধুরীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা, যা ভোলার নয়।
ব্যক্তি জীবনে কবি আফজাল চৌধুরী ছিলেন নিরহঙ্কারী, কোনো প্রকার শঠতা, সংকীর্ণতা ও অসততার ঠাঁই ছিল না তার চরিত্রে। আপন নিষ্ঠা ও সততা থেকে তিনি কখনো বিচ্যুত হননি। তিনি ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। স্রষ্টার প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। তার সাহিত্যকর্ম পর্যালোচনা করলে প্রমাণ পাওয়া যাবে। বিনয় ও কৃতজ্ঞতাবোধ কবি আফজাল চৌধুরীর চরিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। নিজের কবিত্ব শক্তি সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত উঁচু ধারণা পোষণ করতেন। কিন্তু তা প্রকাশে ছিলেন বিনয়ী।
কবি আফজাল চৌধুরীর কর্মে কোনোরকম দ্বিধা-জড়তা ছিল না। তিনি যা ভাবতেন, তা বিশ্বাস করতেন। কথায় ও কাজে তা দ্বিধাহীনভাবে প্রকাশ করতেন। অথচ তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ, অত্যন্ত অন্তরমুখী এবং ভাবুক। কবি আফজাল চৌধুরী সারা জীবন তার আদর্শ ও বিশ্বাসে ছিলেন অবিচল।