ভারতের নির্মমতা

৪০ রোহিঙ্গাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ

স্টাফ রিপোর্টার
২২ মে ২০২৫ ১৬:৫৩

তদন্ত করছে জাতিসংঘ, সুপ্রিম কোর্টে মামলা, জামায়াতের নিন্দা
স্টাফ রিপোর্টার : গত ৮ মে’র ঘটনা। ভারতীয় প্রশাসন শরণার্থী পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও দিল্লিতে বসবাসকারী কয়েক ডজন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আটক করে। এদের মধ্যে প্রায় ৪০ জনকে চোখ বেঁধে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজে তোলা হয়। ওই জাহাজটি আন্দামান সাগর পেরোনোর পরে শরণার্থীদের লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হয় এবং মিয়ানমার সীমানার অভ্যন্তরে অবস্থিত একটি দ্বীপে সাঁতার কেটে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। শরণার্থীরা সম্ভবত সাঁতরে ওই দ্বীপে পৌঁছান, কিন্তু তাদের বর্তমান অবস্থা এবং তারা কোথায় আছেন- এখনো তা অজানা। আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার ও জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘন করে ভারত এমন নির্দয় কাণ্ড ঘটিয়েছে। গত ১৫ মে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর থেকে ওই ৪০ রোহিঙ্গা সম্পর্কে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। ওই বিবৃতিতে জাতিসংঘ জানায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিবারের সদস্য এবং তাদের আইনজীবীর বরাতে বলা হয়েছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গত সপ্তাহে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে একটি নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে মিয়ানমার উপকূলে সমুদ্রে ফেলে দেয়। গত ১৬ মে কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থী মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেসকে (এপি) জানান, তাদের পরিবারের সদস্যরা ৬ মে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে আটক হন। আটককৃতদের মধ্যে ১৫ জন খ্রিস্টানও ছিলেন। ৮ মে তাদের একটি বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে ভারতীয় নৌবাহিনীর মাধ্যমে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আইনজীবী দিলাওয়ার হুসেন জানান, ভুক্তভোগী পরিবারগুলো ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে একটি পিটিশন দায়ের করেছে- যাতে ভারত সরকারকে তাদের পরিবারকে দিল্লিতে ফিরিয়ে আনতে নির্দেশ দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
ঘটনা তদন্ত করছে জাতিসংঘ
মিয়ানমারের সমুদ্র উপকূলে ভারতীয় নৌবাহিনী কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থীকে সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ জাতিসংঘ তদন্ত করে দেখছে বলে ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজ থেকে আন্দামান সাগরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোর করে নামিয়ে দেওয়ার খবরে জাতিসংঘ এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একজন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে এ ধরনের ‘অনুচিত ও অস্বীকৃত’ ঘটনার তদন্ত করানো শুরু হয়েছে বলেও বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। এর আগে গণমাধ্যমে এরকম খবর এসেছিল, দিল্লির পুলিশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের ঘর থেকে আটক করেছে। ওইসব প্রতিবেদন নিয়ে ভারত সরকার বা ভারতের নৌবাহিনী এখন পর্যন্ত কোনো বক্তব্য দেয়নি। তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কথিত প্রত্যর্পণ নিয়ে গত ১৬ মে শুক্রবার ভারতের সুপ্রিম কোর্টে এক শুনানি হয়েছে। ওই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সন্দেহ প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী কোনো আদেশ দিতে অস্বীকার করেছে।
সুপ্রিম কোর্টে মামলা
এদিকে এ-সংক্রান্ত একটি জনস্বার্থ মামলা সম্প্রতি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে শুনানির জন্য উঠেছিল। এমনটাই জানিয়েছে আইন আদালতের খবর দেয় এমন দুটি ওয়েবসাইট ‘লাইভ-ল’ এবং ‘কোর্টবুক’। ওই মামলায় দাবি করা হয়েছে যে, ৪৩ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ভারত সরকার জোর করে মিয়ানমারে প্রত্যর্পণ করেছে এবং জাহাজ থেকে উপকূলে অনেকটা দূরে সমুদ্রে নামিয়ে দিয়েছে। ওই মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে যে, ওই দলে শিশু, নারী এবং ক্যান্সারসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যা আছে- এমন বয়স্ক মানুষও ছিলেন। অভিযোগগুলো নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিচারপতি সূর্যকান্ত এবং বিচারপতি কোটেশ্বর সিং। মামলার বাদীরা একটা অন্তর্বর্তী নির্দেশ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন আদালতের কাছে। তবে সেই অনুরোধ খারিজ হয়ে যায়। মামলাটির দ্রুত শুনানির আবেদনও নাকচ করে দেন বিচারপতিরা। এছাড়া ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে কাজ করে- এমন একটি সামাজিক সংগঠন ‘মাসুম’ও পৃথকভাবে শীর্ষ আদালতের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। ভারতের প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন জানিয়ে ‘মাসুম’ লিখেছে যে, রাজস্থান ও গুজরাটের মতো রাজ্যগুলো থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশি নাগরিকদের যেভাবে প্রত্যর্পণ করানো হচ্ছে, তা ভারত মেনে চলতে বাধ্য এমন আন্তর্জাতিক আইন যেমন লঙ্ঘিত হচ্ছে, তেমনি ভারতীয় সংবিধানে যেসব অধিকার দেওয়া হচ্ছে, তারও লঙ্ঘন হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার ঘটনায় জামায়াতের নিন্দা
৪০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আন্দামান সমুদ্রে ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে সমুদ্রে ফেলে দেয়ার মর্মান্তিক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মা’ছুম এক বিবৃতিতে বলেন, ভারতের দিল্লি থেকে নারী-শিশুসহ অন্তত ৪০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আটক করে আন্দামান সমুদ্রের মিয়ানমার সীমান্তের কাছে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে আন্তর্জাতিক পানি সীমানায় নিয়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে গত ৮ মে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হয়। তিনি বলেন, দুনিয়ার সভ্য ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বিরল। আমরা ভারতের এ অমানবিক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এ অমানবিক ঘটনার মাধ্যমে ভারত আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার ও জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘন করেছে। ভারতের এ ধরনের মর্মান্তিক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার জন্য তিনি শান্তিকামী বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ভবিষ্যতে এ ধরনের অমানবিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সেজন্য ভারত সরকারের প্রতিও দলের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়।
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে ভারত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নির্মমভাবে দেশছাড়া করছে। গত ৭ মে ভারতের আসামে নিবন্ধিত অন্তত ৫ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পুশইন করে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)। সে রোহিঙ্গারা এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) হেফাজতে রয়েছে। এছাড়া আসাম রাজ্যের একটি ডিটেনশন সেন্টার থেকে প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে সরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও খবর পেয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ এও বলেছে, মিয়ানমারে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নির্যাতন ও সহিংসতার হুমকির সম্মুখীন হওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোর করে প্রত্যর্পণের যেকোনো প্রচেষ্টা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।