কবি নজরুল ইসলামের সাহিত্যে কুরবানির তাৎপর্য
১৫ মে ২০২৫ ১৬:০০
॥ মনসুর আহমদ ॥
ঈদুল আজহার প্রধান আকর্ষণ কুরবানি। এ দিনে গোটা বিশ্বের মুসলমানেরা হযরত ইবরাহীমের (আ.) আদর্শে আল্লাহর রাহে গরু, ছাগল, উট, দুম্বা ও মহিষ কুরবানি দিয়ে থাকে। একজন মুমিন ‘ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়া ইয়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’ ঘোষণা দিয়ে তার জীবনের সবকিছু আল্লাহর রাহে কুরবানি করার ওয়াদা করেন পশু কুরবানির মধ্য দিয়ে। সে কারণে ঈদুল আজহার বৈশিষ্ট্য ঈদুল ফিতর থেকে কিছুটা ভিন্নতর।
ঈদ আমাদের জীবনে শুধুমাত্র আনন্দ নিয়ে আসে না। ঈদ এলে আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে মধুর রসের এক স্রোত বয়ে যায়। সেই স্রোতে সিক্ত হয়ে সংস্কৃতিকর্মীরা বিভিন্ন ধরনের সৃষ্টিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশের সৃষ্টিতে মুসলমানদের জাতীয় আদর্শে রূপ প্রকাশিত না হয়ে তরল আনন্দ ও আর্থিক লাভ-লোকসান বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ব্যতিক্রম। তিনি ঈদকে ঘিরে তার সৃষ্টিতে ইসলামী চিন্তা-চেতনা জাগিয়ে তোলার স্বপ্ন এঁেকছেন। তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন গান ঈদকে ঘিরে। যেমনÑ ‘নাই হলো মা জেওর লেবাস এই ঈদে আমার’, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’, ‘আজ ঈদ ঈদ খুশীর ঈদ, এলো ঈদ’, ‘ঈদোজ্জোহার তকবীর শোন ঈদগাহে’, ‘শহীদানের ঈদ এল বকরীদ’, ‘ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক’, ‘শহীদি ঈদ’, ‘ঈদ মোবারক হো গাজী’, ‘ঈদুল ফেতর’, ‘এলো আবার ঈদ ফিরে, এলো আবার ঈদ’। কবি রচনা করেছেন কৃষকের ঈদ, ঈদ মোবারক, বকরীদ প্রভৃতি কবিতা। এসবের প্রত্যেকটিতে ফুটে উঠেছে কুরবানির প্রকৃত তাৎপর্য। ‘বকরীদ’ কবিতায় তিনি ঈদের মর্মবাণী ফুটিয়ে তুলেছেন সুন্দরভাবে।
বিভিন্ন উম্মতের জীবনধারা পেরিয়ে মুসলিম উম্মাহর বর্তমান কুরবানির মূল সম্পৃক্ত হলো হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাইল (আ.)-এর সাথে। হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্যে আল্লাহর হুকুমের কাছে আত্মসমর্পণের স্বীকৃতিস্বরূপ নিজ পুত্রকে কুরবানির প্রস্তুতি ছিল সবচেয়ে কঠিন। কুরবানির সেই ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি লিখেছেন-
“ইবরাহীমের কাহিনী শুনেছ? ইসমাইলের ত্যাগ?
আল্লারে পাবে মনে কর কুরবানি দিয়ে গরু ছাগ?
আল্লার নামে ধর্মের নামে, মানব জাতির লাগি
পুত্রেরে কুরবানি দিতে পারে, আছে কেউ হেন ত্যাগী?
সেই মসুলিম থাকে যদি কেউ, তসলিম করি তারে,
ঈদগাহে গিয়া তারি সার্থক হয় ডাকা আল্লারে।
অন্তরে ভোগী বাইরে সে যোগী, মুসলমান সে নয়,
চোগা চাপকানে ঢাকা পড়িবে না সত্য সে পরিচয়!”
বিশ্বময় মুসলিম জাতির যে দুর্দশা তা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন হযরত ইবরাহীমের ন্যায় শক্তিশালী ইমামের। আজ বিশ্বময় মুসলমানদের নেতৃত্ব প্রদানকারী শক্তিশালী ইমামের আকাক্সক্ষায় ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
“কোথা সে শক্তি- সিদ্ধ ইমাম, প্রতি পদাঘাতে যার
আবে -জম জম শক্তি উৎস বাহিরায় অনিবার?
আপনি শক্তি লভেনি যে জন, হায় সে শক্তিহীন
হয়েছে ইমাম, তাহারি খোৎবা শুনিতেছি নিশিদিন।
দীন কাঙ্গালের ঘরে ঘরে আজ দেবে যে নব তাগিদ
কোথা সে মহান শক্তি -সাধক আনিবে যে পুনঃ ঈদ।”
আজ যদি হযরত ইবরাহীম, ইসমাইলের মতো কোনো যোগ্য ইমাম জাতির নেতৃত্ব গ্রহণ না করে তবে কুরবানির ঈদ মুসলমানদের ঘরে আনন্দ বহাতে পারবে না। গোটা বিশ্বে সেই নীল, শাতিল অরব থেকে শুরু করে কাশগড়ের বেলাভূমি পর্যন্ত সব মুসলমান শত্রুর কৃপাণ তলে প্রাণ হারাচ্ছে। তাই তাদের রক্ষার জন্য যদি ইবরাহীমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের প্রাণ, ঐশ্বর্য কুরবানি না করি তা হলে শুধু পশু কুরবানি দিয়ে আল্লাহর রেজামন্দী হাসিল করা যাবে না। সেদিকে ইঙ্গিত করে কবি লিখেছেন,
“ ওরে হত্যা নয় আজ সত্য-গ্রহ শক্তির উদ্বোধন!
চড়েছে খুন আজ খুনিয়ার
মুসলিমে সারা দুনিয়াটার!
‘ জুলফেকার’ খুলবে তার
দুধারী ধার শেরে খোদার রক্তে পূত বদন!
খুনে আজকে রুধবো মন!
ওরে শক্তি হস্তে মুক্তি, শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন!
[ কুরবানি]
কবি মুসলমানদের কুরবানি শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে আল্লাহর রাহে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন-
“স্ত্রীপুত্রে আল্লারে সঁপি জেহাদে যে নির্ভীক
হেসে কুরবানি দিত প্রাণ হায়! আজ তারা মাগে ভিখ্!
কোথা সে শিক্ষা -আল্লাহ ছাড়া,
ত্রিভূবনে ভয় করিত না যা’রা
আজাদ করিতে এসেছিল যারা সাথে লয়ে কুরআন!”
কুরবানির ঈদ উৎসবেকে দেখেছেন কবি শহীদানদের উৎসব রূপে। তাইতো তিনি গাইলেন-
“‘শহীদান’দের ঈদ এলো বকরীদ!
অন্তরে চির নৌ-জোয়ান যে, তারি তরে এই ঈদ…
উমরে, খালেদে , মূসা ও তারেকে বকরীদে মনে করো,
শুধু সালোয়ার পরিও না, ধরো হাতে তলোয়ার ধরে।”
কবি নজরুলের এই আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে কবি শাহাদৎ হোসেনের কণ্ঠে অভিন্ন সুরে।
তিনি বলেছেন-
‘কই কোথা ‘ইব্রাহিম’, জেগে ওঠো এসেছে আহ্বান
অশ্রুহীন শুষ্ক আঁখি ‘হাজেরার’ জাগো মাতৃ প্রাণ
নিষ্করুণ অকম্পিত প্রাণে
আজি এই মীনার ময়দানে
লক্ষ কোটি ‘ইসমাইল’ তরুণের তপ্ত তাজা প্রাণে
জাগায়ে তুলিতে হবে ঈদের বোধন।’
কুরবানির আসল তাৎপর্য তুলে ধরে ঈদের বোধন জাগাতে এক অভিভাষণে কবি বলেন, “দুদিন বাদে কুরবানির ঈদ আসছে। ঈদের নামাজ আমাদের শিখিয়েছে, সত্যিকার কুরবানি করলেই মিলবে নিত্যানন্দ। আমরা গরু-ছাগল কুরবানি করে খোদাকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করছি। তাতে করে আমরা নিজদেরই ফাঁকি দিচ্ছি। আমাদের মনের ভেতরে যেসব পাপ অন্যায়, স্বার্থপরতা ও কুসংস্কারের গরু ছাগল- যা আমাদের সৎবৃত্তির ঘাস খেয়ে আমাদের মনকে মরুভূমি করে ফেলছে, আসলে কুরবানি করতে হবে সেই সব গরু-ছাগলের। হযরত ইব্রাহীম নিজের প্রাণ তুল্য পুত্রকে কুরবানি করেছিলেন বলেই তিনি নিত্যানন্দের অধিকারী হয়েছিলেন। আমরা তা করিনি বলেই আমরা কুরবানি শেষ করেই চিড়িয়াখানা যাই তামাশা দেখতে। আমি বলি, ঈদ করে যারা চিড়িয়াখানায় যায়, তারা চিড়িয়াখানায় থেকে যায় না কেন?
এমনি ত্যাগের ভেতর দিয়ে জনগণকে যারা আপন করে নিতে পারবে, তারাই হবে জনগণের নায়ক।”
যারা মানবতার কল্যাণের জন্য, নির্যাতিত জনতার মুক্তির জন্য নিজদের অর্থ সম্পদ কুরবানি করতে নারাজ তারা সওয়াব অর্জনের লক্ষ্যে যত বেশি পশু কুরবানিকরুক, তা তাদের কাজে আসবে না। কারণ তাদের কুরবানি ভোগের, ত্যাগের নয়। কবি তাই বলেন, ‘‘শক্তিমান পুরুষই কওমের, জাতির, দেশের, বিশ্বের ইমাম হন- অধিনায়ক হন। অনন্ত দিক যাকে ধরতে পারেনি, সেই পরম দিগম্বরের করুণা পাবে এ সব দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য লোভীর দল? যে জাতির পবিত্র কুরআনের প্রথম শিক্ষা- ‘আলহামদুলিল্লাহ রাব্বিল আলামিন’- সমস্ত প্রশংসা মহিমা যশ-খ্যাতি আল্লাহর প্রাপ্য, আমার নয় -সেই আয়াত দিনে শতবার উচ্চারণ করেও যারা ভোগের পাঁকে পড়ে রইলেন কর্দম-বিলাসী মহিষের মতো তারা আর যাই হোন- আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের কৃপা পাননি।”
কুরবানিকে কেন্দ্র করে কবি যে সব বাণী উচ্চারণ করেছেন সংস্কৃতি জগতের আর দ্বিতীয় কোন পুরুষ তা করেননি। এমন সেনানী যখন আহ্বান করেন,
“কোথায় শম্শের, কোথায় সে বাজু, সেই দরাজ দস্ত? বাঁধো আমামা, দামামায় আঘাত হানো আর এক বার তেমনি করে। যে কওম যে জাতি চলেছে গোরস্তানের পথে, ফেরাও তাকে সেই পথে- যে পথে চলে তারা একদিন পারস্য, রোম সাম্রাজ্য জয় করেছিল, আঁধার বিশ্বে তাওহিদের বাণী শুনিয়েছিল।’ তোমাদের মাঝ থেকে বেরিয়ে আসুক তোমাদের ইমাম- “দাঁড়াও তাঁর পতাকা তলে তহ্রীমা বেঁধে। বলো, আল্লাহু আকবর, হাঁকো হায়দরী হাক, সপ্ত আসমানে চাক্ হয়ে ঝরে পড়ুক খোদার রহমত, নবীর দোওয়া। চাঁদ সেতারা গলে’ পড়ুক কল্যাণের পাগল -ঝোরা।” তখন অন্যদের কি তরল আনন্দ মদিরা রসে ডুবে থাকা শোভা পায়?