নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশ ও বিনির্মাণে ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রের করণীয়


১৫ মে ২০২৫ ১৫:৫৮

॥ ড. আ. জ. ম. ওবায়েদুল্লাহ ॥
(ইসলামী চিন্তাবিদ, কবি ও গীতিকার ড. আ. জ. ম. ওবায়েদুল্লাহ গত ১১ মে রোববার মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ নশ্বর দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন পরপারের অসীম জীবনের ঠিকানায় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আমাদের জন্য রেখে গেছেন তার সাহিত্যভাণ্ডার। তার সমৃদ্ধ চিন্তার সফল একটি নিবন্ধ সাপ্তাহিক সোনার বাংলার পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো।- বি. সম্পাদক)
রাষ্ট্র : সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান
মানবসভ্যতায় রাষ্ট্রসমূহের উন্মেষ, বিকাশ ও স্থায়িত্ব যত ত্বরান্বিত হয়েছে, ততই সমাজ সমৃদ্ধি ও মূল্যবোধকেন্দ্রিক হিসেবে গড়ে উঠেছে। আল-কুরআনে বড় বড় সভ্যতা ও রাষ্ট্রশক্তির বর্ণনা এসেছে। এসব বর্ণনায় ফেরাউন, নমরূদ, ইয়াজুজ মাজুজ, হামানসহ প্রতাপশালী শাসক ও তাদের সাম্রাজ্যের বর্ণনা এসেছে। অনুরূপভাবে কুরআনে আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও কল্যাণময় শাসক সুলাইমান (আ.), দাউদ (আ.), মূসা (আ.), মুহাম্মদ সা.-সহ আল্লাহর প্রিয় শাসক ও তাঁদের রাষ্ট্রব্যবস্থার বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে সর্বজনগ্রাহ্য প্রথম সাংবিধানিক শাসক হিসেবে হাম্বুরাভির নাম উঠে আসে। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ বছর আগে ভারতীয় সভ্যতায় অন্যতম শাসক অশোকের নাম পাওয়া যায়, সন্ধান মেলে রাষ্ট্রনায়ক কৌটিল্যের রাজ্যবিষয়ক বর্ণনা ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ এর। গ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সক্রেটিস তাঁর অন্যতম শিষ্য প্লেটো যিনি ‘দি রিপাবলিক’ রচনা করেছেন আরো রয়েছেন অ্যারিস্টটল।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল বলেছেন, রাষ্ট্র একটি স্বভাবগত কার্যক্রম। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক জীব। যে মানুষ সমাজবহির্ভূত জীবনযাপন করে, যার জীবন কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীন নয়, নিঃসন্দেহে বলা যায়, সে হয় মানবেতর জীব, না হয় মানব প্রজাতির ঊর্ধ্বে কোনো সত্তা- যার মধ্যে মানবীয় প্রকৃতির কোনো অস্তিত্ব নেই (রাজনীতি)। অনুরূপভাবে প্লেটোও মনে করেন, রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনতা ব্যতিরেকে মানবজীবনে উন্নতি লাভ করা কোনো ব্যক্তির পক্ষে অকল্পনীয়। কেননা মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে রাজনীতি তথা রাষ্ট্রীয় তৎপরতার দিকে। মানুষ তার এ স্বাভাবিক প্রবণতা থেকে কখনো মুক্ত হতে পারে না। (Republic বা প্রজাতন্ত্র)। আধুনিক সমাজতত্ত্বের জনকখ্যাত ইবনে খালদুন রহ. তাঁর আল মুকাদ্দিমা গ্রন্থে রাষ্ট্রের অপরিহার্যতা তুলে ধরে বলেছেন, ‘মানুষ স্বভাবতই সামাজিক। শেষ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্র ও সরকার উদ্ভাবনের পক্ষে অকাট্য যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন।’ (ইতিহাসের ভূমিকা বা আল মুকাদ্দিমা)। ইসলামে অকাট্য দলিলের ভিত্তিতে মানবজীবনে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা বাধ্যতামূলক করেছে।
রাসূল সা. প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল
নবুয়্যত লাভের পর একটানা ১৩ বছরব্যাপী রাসূল সা. তাঁর সাহাবীদের সাথে নিয়ে মক্কা নগরীতে দাওয়াতের কাজ অব্যাহত রাখেন। এ সময় তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজের চাইতে মানুষের আত্মগঠন, আত্মসংশোধন ও আল্লাহর বিধানের প্রতি আনুগত্যশীল হিসেবে তৈরির কাজ করেন।
এ সময় আল্লাহর রাসূলের কাজ ছিল নিম্নরূপ, ‘আর তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন উম্মি লোককে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করা হলো। তিনি তাদেরকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনান, তাদের আত্মশুদ্ধির জন্য চেষ্টা চালান, তাদেরকে কিতাবের জ্ঞান শিক্ষা দেন এবং হিকমা বা প্রযুক্তি শেখান।’ (সূরা জুমা : ২)।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে একদল ওহির জ্ঞান সমৃদ্ধ, পরহেজগার, আত্মশুদ্ধ, কিতাবের বিষয়ে পারদর্শী ও হিকমাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী তৈরি করেন। এ ১৩ বছরে কুরআন অধ্যয়ন করে তাঁরা ইসলামের পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করেন। রাসূলের গভীর সান্নিধ্যে এর প্রায়োগিক বিষয়ের সম্যক ধারণা লাভ ও চর্চার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। অতঃপর ইয়াসরিববাসীর স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম কবুল ও আকাবার শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুন এক সংগ্রাম শুরু হয়। মদিনাবাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাসূল সা. ও তাঁর সাহাবীগণ ঘরবাড়ি, ধন-দৌলত, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে পেছনে ফেলে মদিনায় হিজরত করেন। রাসূলের যে সকল সাথী হিজরত করে মদিনায় এলেন, তাঁদের নাম হলো ‘মুহাজির’। আর এ মুহাজিরদের যারা আপন ভাই-বোনের মতো সাদরে গ্রহণ করে আশ্রয় দিলেন- তাঁরা হলেন ‘আনসার’। আনসার-মুহাজির এবং মদিনাবাসীর অন্যান্য ধর্ম ও গোত্রের লোকজনকে সাথে নিয়ে মুহাম্মদ সা.-কে রাষ্ট্রপ্রধান করে কায়েম হলো পরিপূর্ণ ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র।
মদিনা রাষ্ট্রের বাসিন্দাগণ এক সূত্রে গাঁথা হলেন একটি ঐক্যের চুক্তির মধ্য দিয়ে। এ চুক্তিটিকেই বলা হয় ঐতিহাসিক মদিনা সনদ। এটিকে বলা হয়, ইসলামের ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান। এখানে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, মুশরিক নির্বিশেষে সবাই সমান মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে থেকে এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয়- তারা পরস্পর পরস্পরকে সম্মান করে সমান অধিকার ভোগ করবে। বাইরের রাষ্ট্র বা শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হলে একযোগে প্রতিরোধ করবে। বাইরের শক্তির সাথে কেউ আঁতাত করতে পারবে না।
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জাজিরাতুল আরব এলাকার ঘরে ঘরে ইসলামের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। পারস্পরিক আস্থা, ভালোবাসা, সম্মান ও সৌহার্দ্য তাদের মধ্যে অনন্য বন্ধন সৃষ্টি করে। এ বন্ধনকেই কুরআন বলেছে, ‘বুনিয়ানুম মারসুস’ বা সিসাঢালা প্রাচীরের মতো বন্ধন, যা কোনো বুলেটও ছেদ করতে পারে না। ইসলাম পরিষ্কার ঘোষণা করে দিয়েছে যে, একজন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধানের প্রধান কাজ কী। কুরআনে সূরা হজের ৪১নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা উল্লেখ করেছেন, ‘আর তাদেরকে পৃথিবীতে ক্ষমতা প্রদান করা হলে কিংবা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে দিলে তারা- ১. নামাজ কায়েম করবে, ২. যাকাত আদায় করবে, ৩. সৎকাজের আদেশ দেবে এবং ৪. অসৎকাজ থেকে বিরত রাখবে। এ চারটি মৌলিক কাজ কোথাও বাস্তবায়ন হলে সেখানে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যাবতীয় মৌলিক মূল্যবোধ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। মদিনা সনদের রাষ্ট্রের বাসিন্দাদের সকলকে আইনের চোখে সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। পারস্পরিক অধিকার আদায়ের কথা বলা হয়েছে। সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে নিয়ম বলে দিয়েছেন। ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যের ঘোষণা দেওয়া হয় এ সনদে।
সরকারের; বিশেষ করে ইসলামী সরকারের ওপরে উল্লিখিত ৪টি মৌলিক দায়িত্বের পাশাপাশি ইতঃপূর্বে তুলে আনা নবুয়্যতের ৪টি কাজও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। নবুয়্যতের ৪টি কাজ আর রাষ্ট্রপ্রধানের ৪টি কাজকে সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে একটি ইসলামী সরকারের প্রায় অভিন্ন মৌলিক দায়িত্ব আমরা খুঁজে পাই।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান কাজগুলো নিম্নরূপ:
আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকার-ব্যবস্থার প্রধান কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিধান করা বিশেষত ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাস ও অরাজকতা ধ্বংস করে স্থিতিশীলতার প্রতিষ্ঠা। থমাস হোবস লেভিয়াথান (Thomas Hobbes Leviathan)-এর মতে, নাগরিকগণ যেন একে অপরের ক্ষতি করতে না পারে এবং তারা বাইরের শত্রু থেকে যাতে বাঁচতে পারে এমন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চিত করা হচ্ছে সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
জননিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে সরকারকে প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত আইন প্রণয়ন, বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল (সামরিক ও বেসামরিক বাহিনী ও কর্মকর্তা, পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী গড়ে তোলা) নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার মধ্য দিয়ে দক্ষ ও সুশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এজন্য জনগণের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ট্যাক্সে তুলে তা দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক স্থাপনা, কারাগার, আদালত ইত্যাদি গড়ে তোলা রাষ্ট্রের কাজ। সামরিক বাহিনীর প্রধান কাজ প্রতিরক্ষা, বহিঃশত্রুর মোকাবিলা করা এবং দেশের সীমান্ত রক্ষা করা।
নাগরিকের একার পক্ষে তার ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক প্রয়োজনসমূহ পূরণ করা সম্ভব নয়। ৬০০০ বছর আগে ভারতীয় সভ্যতার অন্যতম রূপকার কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে রাষ্ট্রের ১৮টি কাজ নির্ধারণ করেন, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- জনপথ (Roads and Highways), জলাধারা (Wasa), পান্থশালা, পথচারীও মুসাফিরদের জন্য সরাইখানা, জনশিক্ষা ইত্যাদি। এ কারণেই আমরা দেখি পৃথিবীর সকল প্রাচীন সভ্যতা ও রাষ্ট্র তার অন্যান্য কাজের পাশাপাশি জনশিক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছে। যেমন- গ্রিক সভ্যতায় জ্ঞানকে বাধ্যতামূলক করা হয়। দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, ‘নিজেকে জানো’ (Know thyself)। ইসলামও শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, শ্রেষ্ঠ নবী এবং মানবতার মুক্তি-দূত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আল্লাহর প্রথম বাণী ছিল- ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমায় সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আলাক : ১)। আবার রাসূল সা. বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ’, ‘জ্ঞান অর্জন করো দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৪)। এছাড়াও রাসূল সা. বলেছেন, ‘আমার একটি কথাও যদি জানা থাকে, তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।’ (সহীহ বুখারি)।
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম সদর দফতর ছিল মসজিদে নববী। এখানে বসে নবীজি সকলের কাছে কুরআনের বাণী ও শিক্ষা পৌঁছে দিয়েছেন। শিক্ষিত সাহাবীগণ (নারী কিংবা পুরুষ) অশিক্ষিত সঙ্গীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। একদল মাজনুন মানুষ আসহাবে সুফফা হিসেবে যাদের পরিচিতি- তাঁরা রাত-দিন রাসূলের সান্নিধ্যে থেকে কুরআন শিখেছেন। রাসূলের কথাগুলোকে বক্ষে ধারণ করেছেন। তাঁর সমস্ত আমলকে জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এভাবে তাঁরা জ্ঞান অর্জন ও বিতরণকে অর্থাৎ শিক্ষার কাজকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। মসজিদে বসেই নবী প্রতিরক্ষার জন্য সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন, যাদেরকে দিয়ে তিনি নিজেই ২৭টি যুদ্ধে সরাসরি সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এখানে বসেই মদিনা রাষ্ট্রের সীমানা প্রতিরক্ষার কাজ করেছেন। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও মুসলিমদের জানমাল, ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা দিয়েছেন, বিনিময়ে জিজিয়া গ্রহণ করেছেন। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন, যেখানে স্বয়ং খলিফাকেও বিচারকের রায় মেনে নিতে হয়েছে। খলিফার নিজ সন্তানের পাপের শাস্তি দোররা মারতে মারতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। এমনই এক অসাধারণ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা সক্ষম হয়েছিল বলে এর সুনাম-সুখ্যাতি জগৎময় ছড়িয়ে পড়ে। তবে এ অসাধারণ মানবিক গুণাবলি ও মূল্যবোধ কোনো অলৌকিক পন্থায় গড়ে ওঠেনি।
রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব প্রত্যেক নাগরিকের সুশিক্ষা ও নৈতিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা।
মানবশিশু জন্মলাভের পর থেকেই পরিবার ও পারিপার্শ্বিকতার কাছ থেকে তার শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করার সময় তিনটি মৌলিক জিনিস সাথে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-
১. জ্ঞান বা শিক্ষা
২. বিবেক বা ভালো-মন্দের বোধ এবং
৩. ইচ্ছের স্বাধীনতা বা Free will.
মানবসভ্যতার সাথে আনুপাতিক হারে শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশ লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষকে মানুষ করার আয়োজনের নাম শিক্ষা। সুস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসহ মানুষ বড় হতে থাকে, এটি একটি প্রাকৃতিক বৃদ্ধি (Natural Growth)। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি শিক্ষাব্যবস্থার আয়োজন না হলে মানুষের ভারসাম্যপূর্ণ মানসিক, চৈন্তিক ও আত্মিক বিকাশ হয় না। এক্ষেত্রে জন মিলটনের সংজ্ঞাটি প্রণিধানযোগ্য- Education is the harmonious developments of bodz, mind and soul.’ Sir Stanley Pole ঠিকই বলেছেন, ‘If you teach your child three Rs i.e. Reading, Writing and Arithmetic and do not give him 4th R, i.e. Religion, definitely you will get 5th R, i.e. Rascal’. ধর্মকে অবহেলা করে অবজ্ঞা করে কখনো একজন মানুষের অস্তিত্ব বিকাশ হয় না। এজন্য রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “মানুষের আত্মাকে যদি কিছুতে জাগরিত করে তা তার ধর্ম।’ রাষ্ট্র তার নাগরিকের জন্য শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করবে এক্ষেত্রে যে ধরনের মানুষ আমরা চাই, সে ধরনের মানুষ তৈরির মালমসলার জোগান দিতে হবে। আজ প্রতিটি রাষ্ট্রেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় রয়েছে। শিক্ষাকে একটি পর্যায় পর্যন্ত অবৈতনিক করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষার ব্যয় বেশি এবং এটাই স্বাভাবিক। তবে গবেষণাকর্মে উদ্বুদ্ধ করার জন্য রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সহযোগিতা নিয়ে বৃত্তির ব্যবস্থাও করে থাকে। শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক বিষয় নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করে জাতির উপযুক্ত মানুষ তৈরির জন্য সুচিন্তিত, পরিকল্পিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন সময়ের দাবি। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ব্রিটিশদের লক্ষ্য ছিল কেরানি ও দোভাষী তৈরি করা। আজ তার লক্ষ্য হওয়া উচিত স্বাধীন দেশের উপযোগী নেতৃত্ব তৈরি করা।
এক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় বাজেটের কমপক্ষে ১০% শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। ভালো মানুষ তৈরির জন্য প্রয়োজন ভালো শিক্ষা কারিকুলাম অর্থাৎ কোন্ পর্যায়ে কী বিষয়ে নাগরিকের মানসিক বিকাশ হবে তা স্থির করা। (যেমন প্রি স্কুল লেভেল, স্কুলের নার্সারি থেকে ক্লাস ফাইভ) আপনি তাকে কী শেখাবেন, জীবনের কী কী দিক সম্পর্কে অবহিত করবেন? সে কারিকুলামের লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য অবশ্যই একটি চমৎকার সিলেবাস তৈরি করা, যেখানে প্রতিটি বিষয়ে ওই বয়সী শিক্ষার্থীর ভাষা, মন ও ধারণক্ষমতার দিকে খেয়াল করে বিষয়ভিত্তিক পাঠ্য তালিকা তৈরি করবেন। একটি ছোট্ট উদাহরণ। বাংলা বিষয়ে পর্যায়ক্রমিক কোন ক্লাসে কী শেখাবো, কোন দক্ষতার ওপর কতটা জোর দেব, সেক্ষেত্রে ছড়া, কবিতা, গল্প, ব্যাকরণ ইত্যাদি বিষয়ে বিরাজমান সৃষ্টিসমূহ বাছাই করে সবাইকে তার আলোকে জ্ঞান দান এবং বছর শেষে তার অর্জনকে পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচাই করা।
উল্লেখ্য, আগে আমাদের শিশুরা এক ‘বাল্যশিক্ষা’ বই থেকে ছড়ায় ছড়ায় যা শেখতো, এখন সেসবকে কৌশলে বাদ দেওয়া হয়েছে। আগে আমাদের জাতীয় মানের লেখক কবিদের যেসব গল্প কবিতা ছিল তা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে এমন লেখা দিয়ে, যা আমাদের ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও জীবনবোধের ওপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয়, সামাজিক, নৈতিকবোধ-বুদ্ধির সাথে যাদের সম্পৃক্ততা নেই, তারা যখন সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকেন, তখন এমন বিপর্যয়কর অবস্থা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
রাষ্ট্র শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিমার্জন করে দেশের মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ভিত্তি করে যদি আগামী দিনের প্রতিটি প্রজন্মকে উন্নত নৈতিকতা, শাশ্বত মূল্যবোধ, সুস্থ সংস্কৃতি, দেশপ্রেম, সাহসী, শৌর্যবীর্যে উন্নত মানুষ হিসেবে গড়ার ব্যবস্থা নেয়; তাহলে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষা সম্ভব। মূল্যবোধভিত্তিক একটি সমাজ ও রাষ্ট্র তখন আর সোনার হরিণ হয়ে থাকবে না। তবে মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে রাষ্ট্রের ও সরকারের আরো কিছু করণীয় রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে: ১. রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সংবিধানে বর্ণিত নাগরিকের মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা। ২. আইনের শাসন ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা কায়েম করা। ৩. আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্র পরিচালনা ও বিচারব্যবস্থার প্রতিটি কাজ সংশ্লিষ্টদের হাতে ন্যস্ত করা। তা বাস্তবায়নে কোনো প্রকার অনিয়মকে প্রশ্রয় না দেওয়া।
৪. সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করা। সৎকাজে রাষ্ট্রশক্তির প্রয়োগ, সৎকাজের জন্য পুরস্কৃত করা এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখা। ৫. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত জরুরি। ৬. সামগ্রিকভাবে প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা, আল্লাহর ভয় ও জবাবদিহির অনুভূতি জাগ্রত রাখা। মূল্যবোধে উজ্জীবিত মানুষ হোক সমাজ ও রাষ্ট্রের অংশীদার। আর রাষ্ট্র ও সমাজ রক্ষা করুক তার নিরন্তর অঙ্গীকার।