আল্লামা ইকবালের সাহিত্য চিন্তা ও দর্শন
১৫ মে ২০২৫ ১৫:৪৭
॥ ওবায়েদ ইবনে গনি ॥
মুহাম্মদ ইকবাল একজন কবি। তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তার কবিতার প্রতিটি শব্দে তিনি ছন্দের মূর্ছনায় তুলে ধরেছেন তার বিশ্বাসী চেতনা। তিনি চিরন্তন বিশ্বাস এবং দৃঢ় প্রত্যয়ের কবি, দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামের কবি, দূরদর্শী রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিখ্যাত আধ্যাত্মবাদী, বিশ্বাসী দার্শনিক, ব্যারিস্টার এবং উদারপন্থি সংস্কারক। তার ফার্সি ও উর্দু কবিতাকে আধুনিক যুগের ফার্সি এবং উর্দু সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আল্লামা ইকবাল পাকিস্তানের জাতীয় কবি। তার কাব্যদর্শন উজ্জ্বল মশালের মতো পথহারা মুসলিম পথিকদের মঞ্জিলের সন্ধান দিয়ে থাকে।
চিরায়ত জ্ঞানের উৎস পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের জ্ঞানলাভের মাধ্যম- ১. মুসলিম উম্মাহর পালনীয় জীবনে আধ্যাত্মবাদের চর্চা। ২. জ্ঞানচর্চার গভীরে প্রবেশ করে প্রকৃতির স্বরূপ ও নিগূঢ় তত্ত্ব অনুসন্ধান। ৩. মানবজাতির সামগ্রিক ইতিহাসের পাশাপাশি পবিত্র কুরআনে নির্দেশিত জাতি ও জনপদভিত্তিক ইতিহাস অধ্যয়ন। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার শিখরকে বাহন বানিয়ে আধুনিকতা এখন আরো আধুনিক হয়ে উত্তর-আধুনিকতা হিসেবে নিজেকে বিকশিত করছে। সেই ছোঁয়ায় মানুষও এখন মডার্ন হতে হতে নিজেকে আল্ট্রা মডার্ন হিসেবে পরিচিত করতে বেশি উৎসাহী। কিন্তু শাব্দিক দিক থেকে সভ্যতার স্বর্ণযুগের মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচিত রাখলেও মনের অজান্তেই গোলাকার পৃথিবীর পথপরিক্রমায় ক্রমেই যে জাহেলি যুগেই ফিরে যাচ্ছে, তা অনেকেই অনুধাবন করতে সক্ষম নন কিংবা অনুধাবন করলেও স্বার্থবাদিতার কারণে স্বীকার করতে নারাজ। উত্তর-আধুনিকতার মোড়কে নাস্তিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ভোগবাদিতার গোলকধাঁধায় আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ বাঁধনহীন জাহেলিয়াতকে নতুন আবরণে গ্রহণ করে হয়ে পড়েছে শেকড়হীন পরগাছা। ফলে দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ, চরিত্র হারাচ্ছে শিক্ষাঙ্গন, নৈতিকতার চরম অবক্ষয় ঘটছে তরুণদের। এ অবস্থায় যখন ইসলামী আদর্শকে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি তথা জীবনের প্রত্যেক অঙ্গন থেকে বিতাড়িত করে ইসলামকে নিছক ধর্ম বানিয়ে মসজিদে আবদ্ধ রাখার সফল প্রয়াস চলছে; সে সময় মানবমুক্তির কাণ্ডারি হিসেবে যাদের খুঁজে পাওয়া যায়, তাদের প্রথমসারির একজন ব্যারিস্টার ও ডক্টর মহাকবি আল্লামা ইকবাল। তাই তো তাঁর দৃপ্ত আহ্বান-
ওঠো দুনিয়ার গরিব ভুখারে জাগিয়ে দাও
ধনিকের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও
করো ঈমানের আগুনে তপ্ত গোলামী খুন
বাজের সমুখে চটকের ভয় ভাঙিয়ে দাও।
(ফররুখ আহমদ অনূদিত)
ব্যারিস্টার আল্লামা ইকবাল আর পৃথিবীতে নেই। তিনি যখন ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল ফজরের আজানের সুরের মূর্ছনায় দুলতে দুলতে আল্লাহর দরবারে চলে যান, তখন বিশ্বপ্রেক্ষাপটে নতুন দোলা শুরু হয়েছে। মাত্র দুই দশকের মধ্যে পরাধীন ভূখণ্ডগুলো একে একে মুক্ত হতে থাকে ঔপনিবেশিকতার জগদ্দল পাথরচাপা থেকে। পৃথিবীর শরীরে আঁকতে থাকে নতুন নতুন স্বাধীন মানচিত্র, বাতাসে পতপত করে উড়তে থাকে নানা রঙের স্বাধীন পতাকা। বাহ্যিকভাবে মনে হতে থাকে যে, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে উদয় ঘটে স্বাধীন উজ্জ্বল দীপ্তিময় সূর্যের। রক্তযুদ্ধের পর হয়তো ভালোবাসার বাগান তৈরি হবে- এ আশা সব মানুষের হৃদয়ে বাসা বাঁধে। কিন্তু থেমে নেই কুটিল ষড়যন্ত্র। তারা আবার আক্রমণের নতুন কৌশল খোঁজে। বাণ নেমে যাওয়া ডুবন্ত ফসলের ক্ষেতে হালকা বৃষ্টিতে পানি ধুয়ে না দিয়ে বরং সূর্যের খরতাপে সব পুড়ে ছারখার করার কৌশলে মেতে ওঠে ইউরোপ-আমেরিকাসহ মহাশক্তিবর্গ।
ঠাণ্ডা লড়াইয়ের হিকমতে জাতিতে জাতিতে, মানুষে মানুষে, দেশে দেশে ছড়িয়ে দেয় অনৈক্য ও অবিশ্বাসের বিষবাষ্প। সেই হিকমতের স্বীকার হয় মিন্দানাওসহ ফিলিপাইনের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা, মিয়ানমারের আরাকান, ভারতের কাশ্মীর এবং মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনসহ অসংখ্য মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল। সভ্যতার স্বর্ণযুগে এসেও অর্ধশতাব্দী থেকে সুসভ্য জাতি রক্তের হোলিখেলা দেখছে এসব অঞ্চলে। এছাড়া তাদের হেকমতি গণতন্ত্র এবং মানবতাবাদের খোলসে নিজেদের কর্তৃত্বকে বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিক ও পরিশীলিত পন্থায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার নিমিত্তে সভ্যতাবিধ্বংসী পদক্ষেপ নিতেও দ্বিধা করছে না। সভ্যতার লীলাভূমি ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং আফগানিস্তানে গণতন্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতে এসে তারা হিংস্রতার সব প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে দ্বিধা করেনি। ফিলিস্তিন, আরাকান ও কাশ্মীরের স্বাধিকার আন্দোলন পরিচালনা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ইরাকমুক্তি আন্দোলন শুধু নয়, বরং সাদ্দাম হোসেনের বেঁচে থাকাটাও সন্ত্রাস; তাই তাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হলো।
ইসলামের প্রাণকেন্দ্র সৌদি আরব, ইরান, মিশর, সিরিয়া, তুরস্ক, আলজেরিয়া, বসনিয়া, চেচনিয়া, আজারবাইজান, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়ও কালো থাবা বিস্তারের সব আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছে। কম্পিউটারের উৎকর্ষতার সুযোগে মিডিয়ার দৌরাত্ম্যে তারা এখন বিশ্বমোড়লের ভূমিকায়। বিশেষ করে রাশিয়ার পতনের পর আমেরিকা ব্রিটেনকে সঙ্গী করে একক আধিপত্য বিস্তারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মানচিত্রভেদে তাদের পরিকল্পনাও বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনায় গৃহীত। মুসলমানদের মধ্যে জাতিগত শিয়া-সুন্নিসহ মাজহাবী বিভেদ সৃষ্টি, সাদা-কালোর বৈপরিত্য, আধুনিকতার নামে ইসলামবিমুখতার ফ্যাশনে ইসলামের ভ্রাতৃত্ববন্ধনকে বিচ্ছিন্ন করে মুসলিম বিশ্বের ফাটল তৈরিতে তারা পুরোপুরিভাবে সফল হয়েছে। এক আরব রাষ্ট্রকে আরেক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তারা ব্যবহার করেছে। পাকিস্তানকেও ব্যবহার করতে চাচ্ছে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। স্বাধীন সত্তা আজ মুসলমানদের কাছে স্বপ্নের বিষয়। মসজিদের মধ্যে ইসলাম চর্চা দেখা গেলেও সমগ্র জীবনে তাদেরই কর্তৃত্ব।
এ প্রেক্ষাপটে আবারও আল্লামা ইকবালের কথাই স্মরণ করতে হয়। তিনি মনে করেন, ‘এ দুনিয়ার জীবনে যারা রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অন্য জাতির অনুকরণ করে, অনুসরণ করে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় যারা পরাধীন, স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ ও জাতি হিসেবে যাদের পরিচয় নেই, স্বাধীনতা লাভ ও এর রক্ষার দায়িত্ববোধ যাদের চিন্তা-চেতনায় নেই; এমনকি যাদের রুহ বা আত্মা স্বাধীন জীবনবোধ থেকেও বঞ্চিত; তারা চিরমৃত, অনন্ত-অসীম সুখ-শান্তি লাভ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মূলত পরাধীন জাতি মৃতের চেয়েও নিকৃষ্ট।’ আল্লামা ইকবালের সমকালীন পরাধীনতা ও বর্তমান পরাধীনতায় বাহ্যত ঔপনিবেশিকতার পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও মূলত বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার সুবাদে পরাধীনতার চিত্র একই, বরং আরো মারাত্মক। বিশ্বাসে, নিশ্বাসে, চিন্তা-চেতনায়; এমনকি জীবনযাত্রায়ও যখন তাদেরই মত ও পথ, তখন ভৌগোলিক স্বাধীনতাও পরাধীনতারই আরেক রূপ বৈকি।
আল্লামা ইকবালের সমকাল এবং বর্তমান মুসলিমবিশ্বের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় শব্দ, ভাষা ও মানচিত্রগত পার্থক্য লক্ষ করে সাম্প্রতিক মুসলিমবিশ্ব স্বাধীন সত্তায় জেগে আছে বলে বাহ্যত অনুমিত হয়। কিন্তু একটু গভীরতায় গিয়ে বিশ্লেষণ করলে পরিণতি আগের চেয়ে ভয়াবহ হিসেবেই ধরা পড়ে। আল্লামা ইকবালের সমকালে ঔপনিবেশিক শাসকদের হাতে ভূখণ্ডগত পরাধীনতা ছিল সত্য, কিন্তু শৃঙ্খল ভাঙার আন্দোলনও তখন তীব্রতর ছিল। বিদেশি শাসকদের অত্যাচারের প্রেক্ষাপটে জনমনেও ছিল স্বাধীন হওয়ার তীব্র বাসনা। আল্লামা ইকবাল সে বাসনা বাস্তবায়নে বিশ্বাসের ভিত্তিতে রাসূল (সা.)-কে আদর্শ মহাপুরুষ হিসেবে গ্রহণ করে ঐক্য সংহতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সচেতনতার সঙ্গে পথ চলতে আহ্বান জানিয়েছেন।
১৯২৬ সালের ১৯ নভেম্বর এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘মুসলমানদের জীবনের রহস্য একতার মধ্যেই নিহিত। আমি বহু বছর ধরে অধ্যয়ন করেছি, অনেক রাত চিন্তাভাবনায় কাটিয়েছি, তাতে এ মর্মে উপলব্ধি করতে পারি- যার ওপর আমল করে আরবরা মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্ব ও ভালোবাসায় মাত্র ৩০ বছরের মধ্যেই বিশ্বের ইমামে (নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়) পরিণত হন, সেই আকাক্সিক্ষত সত্য হচ্ছে বিশ্বাস, ঐক্য ও সংহতি।’ তিনি আরো মনে করেন, ‘মানুষের মন, দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-পদ্ধতি আলাদা হওয়ার কারণে মতপার্থক্য আসতেই পারে। তাই বলে সেটাকে ধ্বংসাত্মকভাবে ব্যবহার না করে পূর্বপুরুষদের মতো রহমত হিসেবে দেখতে হবে। বাঁচতে হলে হীনম্মন্যতা পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সেøাগানে মুখরিত বর্তমান বিশ্ব। এ প্রেক্ষাপটে আল্লামা ইকবালকে গণতন্ত্রের বিরোধী বলে প্রচারণা চালিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী শক্তি সুকৌশলে মুসলমানদের থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। অথচ আল্লামা ইকবাল গণতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন না, বরং তিনি আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন তথা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দার্শনিক। তবে তার গণতন্ত্র ও পাশ্চাত্য গণতন্ত্র এক নয়। তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন, পশ্চিমা গণতন্ত্র মূলত পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার মুখোশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পুঁজিবাদের ভয়ংকর চরিত্র; যাতে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কাছে অসহনীয় হয়ে না ওঠে, তাই তারা গণতন্ত্র, নারী স্বাধীনতা, মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিশ্বায়ন প্রভৃতি চমকপ্রদ সেøাগান দিয়ে থাকে। বর্তমান বিশ্বের গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা আমেরিকা কর্তৃক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত ফিলিস্তিনি হামাস সরকারকে স্বীকৃতি না দিয়ে বরং বিভিন্ন অবরোধ আরোপে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।
এজন্যই আল্লামা ইকবাল বলেন, ‘পাশ্চাত্য গণতন্ত্র একটা ধোঁকা, এটা থেকে প্রাচীন সাম্রাজ্যবাদের সুর পাওয়া যায়।’ পক্ষান্তরে তার গণতন্ত্রের ভিত্তিই হচ্ছে ইসলাম; যেখানে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকে আল্লাহর ওপর এবং প্রহসন নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে ভোটাধিকার প্রয়োগ ও শাসকদের জবাবদিহির মাধ্যমে মানবচরিত্রকে নির্ভিক ও অকুতোভয় করে গড়ে তোলে। যে গণতন্ত্র ছিল রাসূলের (সা.) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের। আল্লামা ইকবাল সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে অপছন্দ করতেন। কেননা পাশ্চাত্য সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হলো দেশ, জন্মভূমি, ভাষা বংশ ও বর্ণ। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকপাল ছিলেন সত্য, কিন্তু মূলত তার সাধনা ছিল বিশ্ব-মুসলিমের স্বাধীনতা, ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে এক আত্মায় পরিণত করা। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে ভূখণ্ডগত পার্থক্য, সাদা-কালো ও মাজহাবী বিভেদ ভুলে বিশ্ব-মুসলিম এক আত্মায় এসে মিলবে- এটাই ছিল আল্লামা ইকবালের স্বপ্ন।
তাই তো ১৯২৩ সালের ১৪ নভেম্বর সৈয়দ সাঈদ উদ্দীন জাফরীকে লেখা চিঠিতে আল্লামা ইকবাল উল্লেখ করেন, ‘প্রথমে আমিও স্বদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলাম এবং হিন্দুস্তানের সম্মিলিত জাতীয়তাবাদের স্বপ্নও হয়তো সবার আগে আমিই দেখেছিলাম, কিন্তু অভিজ্ঞতা ও চিন্তাধারায় প্রসারতা আমার উক্ত ভাবনায় পবির্তন আসে। এখন স্বদেশি জাতীয়তাবাদ আমার কাছে শুধুমাত্র একটি অস্থায়ী পদ্ধতিমাত্র।’ তিনি আরো লেখেন, ‘আমার কাছে ইসলামই বিভিন্ন জাতিসমূহকে ভৌগোলিক সীমারেখার ঊর্ধ্বে উঠবার এবং গোত্র ও বংশের কৃত্রিম অথচ মানব বিবর্তনের প্রাথমিক স্তরসমূহে আবদ্ধ তারতম্যসমূহকে মেটাবার একটি কার্যকর হাতিয়ার।’ ১৯৩৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, ‘অবশ্যই ইসলাম একটি বিশ্ব মুসলিম রাষ্ট্রের অপেক্ষায়; যা গোত্রীয় ভেদাভেদের অনেক ঊর্ধ্বে হবে; যাতে ব্যক্তিগত ও একনায়কত্বভিত্তিক রাজত্ব এবং পুঁজিবাদের কোনো সুযোগ থাকবে না। বিশ্বের অভিজ্ঞতাই স্বয়ং এমন একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করে দেবে।’ বিশ্বাসী চেতনাকে শানিত করে মুসলিম দেশগুলোর ঐক্য সংহতি সিসাঢালা প্রাচীরের মতো দৃঢ় রাখতে আল্লামা ইকবাল ঘোষণা করেন, ‘কাবা শরীফের মর্যাদা রক্ষার্থে নীল নদের তীর হতে চীনের সুদূর কাশগড় পর্যন্ত মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’ নির্দিষ্ট কোনো ভূখণ্ড নিয়েই মুসলিম মিল্লাত সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। গোটা বিশ্বেই তাদের ঘর। আল্লামা ইকবালের ভাষায়-
চীন ওয়া আরব হামারা
হিন্দুস্তাঁ হামারা
মুসলিম হ্যাঁয় হাম ওয়ানহায়
সারা জাঁহা হামারা।
(আরব আমার ভারত আমার চীনও আমার নয়কো পর, বিশ্বসেরা মুসলিম আমি সারা জাহানে বেঁধেছি ঘর।)
বিশ্বায়নের সেøাগানে যখন পাশ্চাত্যজগৎ একক আধিপত্য বিস্তারে সফল হয়েছে, তার অনেক আগেই আল্লামা ইকবাল একক মুসলিম বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার এ স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই নয়, এর বাস্তবসম্মত রূপরেখাও প্রণয়ন করে গেছেন তিনি। আল্লামা ইকবাল চলে গেছেন প্রায় এক শতাব্দী আগে। এরই মধ্যে পাল্টে গেছে ভৌগোলিক মানচিত্র, পাল্টেছে মানবতাবাদী সেøাগানের নিখাদ রূপ, জ্ঞানচর্চার পদ্ধতিও ভিন্নরকম। এ অবস্থায়ও আল্লামা ইকবালের দর্শন অক্ষত রয়েছে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়েছে হাজারো ছিদ্রপথ, তাই জ্ঞানার্জনের কোনো বিকল্প নেই। ১৯২৬ সালে এক বক্তব্যে জ্ঞানার্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করে আল্লামা ইকবাল বলেন, ‘যারা নিজেরা সংবাদপত্র পড়তে অপারগ, তারা যেন অন্যদের কাছ থেকে শুনে নেয়। কেননা সমকালীন বিশ্বে যেসব জাতি কর্মতৎপর রয়েছে, তাদের মধ্যে অধিকাংশ জাতিই মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে।’ আল্লামা ইকবাল জ্ঞানে ও ধ্যানে আত্মাকে এতটা প্রখর করতে বলেছেন-
কর উন্নত সত্তা এমন
যেন তকদির লেখার আগে
শুধান আল্লাহ বান্দাকে : বল
কী বাসনা তোর হৃদয়ে জাগে।
(ফররুখ আহমদ অনূদিত)
জ্ঞানচর্চা ও ঐক্য-সংহতির জন্য আল্লামা ইকবাল ভারতীয় মুসলমানদের যে দিকনির্দেশনা দিয়ে তার ভিত্তিতে বিশ্ব-মুসলিমের জন্য কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক সংগঠন, তরুণদের সুসজ্জিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, আন্তর্জাতিক তহবিল গঠন, বিভিন্ন দেশে পুরুষ মহিলাদের জন্য সাংস্কৃতিক শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক ভিত্তিতে আইনজ্ঞসহ উলামা পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। সেইসাথে মিডিয়ার ক্ষেত্রে মুসলমানদের আরো বেশি অগ্রগামী হওয়া জরুরি। আর দৃঢ় ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে সর্বপ্রকার স্বার্থান্ধতা ও বর্ণবৈষম্য ভুলে সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সব উপায় বের করতে হবে মুসলিম উম্মাহকে। তবেই মুসলমানদের আত্মার বিকাশ ও জাগরণ সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক।