জনগণের দাবি পূরণ করতেই হবে
১৫ মে ২০২৫ ১৫:৪২
আওয়ামী লীগ ও এর সকল অঙ্গ সংগঠনের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কার্যত আওয়ামী লীগ নামের রাজনৈতিক দলটিকে অন্তর্বর্তী সরকার গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ, নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসসহ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও কাঠামো ধ্বংস, অর্থ পাচার, জনগণের অর্থ লুট, মাফিয়া ও চোরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মতো গণতন্ত্রবিরোধী ফ্যাসিজম কায়েম করার অপরাধে একটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার মতো সাহসী ও ইতিবাচক ঘটনা এদেশে এটিই প্রথম। অবশ্য স্বাধীনতার আগে আরেকবার তৎকালীন পাকিস্তান সরকারও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করেছিলেন এ দলেরই প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং। তিনি ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ এবং গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট দুঃশাসন কায়েম করেছিলেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগের পরিণতির জন্য প্রথমত দায়ী এ দলের নীতিনির্ধারক নেতারাই। কারণ তারা দীর্ঘ ৭৫ বছরেও একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে গড়ে তুলতে পারেননি। ‘জোর যার মুল্লুক তার’- এমন বর্বর প্রাগৈতিহাসিক দর্শনের রাজনীতি যে এ সভ্য দুনিয়ায় কেউ মেনে নেয় না, তা তারা বুঝতে চাননি। গণতন্ত্রের স্লোগান ও প্রতারণার খোলস একদিন না একদিন খসে পড়েইÑ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে এ সত্য আবারও প্রমাণ হলো। আওয়ামী লীগের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা কোনোদিনই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল না। ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় মুহাজির হিসেবে ভারত থেকে এদেশে আসা বিহারি সম্প্রদায়ের ওপর সীমাহীন নির্যাতন চালিয়ে এমন ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছিল যে, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বুঝেছিলেন, তাদের মোকাবিলায় প্রার্থী দিয়ে লাভ হবে না, কারণ নির্ভয়ে ভোটের পরিবেশ নেই। এরপর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে তারা জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিল ‘হেলিকপ্টারে ব্যালট বাক্স ছিনতাই’ নির্বাচন। এ নির্বাচনে ভোট ছিনতাই করে ক্ষমতা দখলের পর জাতীয় সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাকশাল কায়েম করে নির্বাচনব্যবস্থার কবর রচনা করেছিল। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগের মতোই ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করে ২০০৮-এ নির্বাচন নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। এ নির্বাচনের আগে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের নির্বাচন হবে ১৯৭০ সালের মতো।’ আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় তিনি তার কথা রাখতে পেরেছিলেন। এরপর ২০০৮ থেকে নিয়ে ২০২৪-এর হাসিনার দুঃশাসনের ইতিহাস তো সবার জানা। বাংলাদেশ আমলের দুবারের আওয়ামী ফ্যাসিস্ট দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেতে এ জাতিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪-এ শেখ মুজিবুর রহমানের দুঃশাসনকালে সরকারের প্যারামিলিটারি বাহিনী রক্ষীবাহিনীর হাতে তৎকালীন বিরোধীদল জাসদের প্রায় ৪০ হাজার নেতাকর্মী খুন-গুমের শিকার হয়েছেন। ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত হাসিনার দুঃশাসনে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও ভিন্নমতের লেখক, সাংবাদিক, সেনা কর্মকর্তা, ছাত্র-শ্রমিক ও সাধারণ নাগরিকসহ অসংখ্য মানুষ জুডিশিয়াল কিলিং, খুন, গুম, জেল-জুলুম, আয়নাঘরে নির্যাতনের শিকার হয়ে শাহাদাতবরণ করেছেন। নজিরবিহীন গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর শাপলা চত্বর, বিডিআর সদর দফতর পিলখানা, জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতাদের ফাঁসি এবং ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই বিপ্লবের সময় ক্ষমতা দখলের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের গণহত্যা।। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ৩৬ জুলাই বিপ্লবের গণহত্যার ঘটনা সরাসরি হাসিনার নির্দেশে হয়েছে এমন প্রমাণ উঠে এসেছে। দেশ-বিদেশের মানবাধিকার কর্মী ও গোটা গণতান্ত্রিক বিশ্ব দেখেছে জার্মানির হিটলার আর ইতালির মুসোলিনির পর এ শতকের ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে। তাই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে অপরিহার্য ছিল বলে একবাক্যে দেশ-বিদেশের সবাই স্বীকার করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে দলটিকে নিষিদ্ধ করা ছাড়া কোনো পথ খোলা ছিল না। এখন জনগণের দাবি আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে যারা হাসিনার ফ্যাসিস্ট রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা পালন করেছে, সেসব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ এবং সবার বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। সেই দলের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ হলো- আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল; বিশেষ করে জাতীয় পার্টি (এরশাদ ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু), জাসদ (ইনু), ওয়ার্কার্স পার্টি (মেনন), তরীকত ফেডারেশন, জাকের পার্টিসহ ফ্যাসিস্টের দোসর সকল রাজনৈতিক দল।
আমরাও মনে করি, অতি দ্রুত জুলাই বিপ্লব সনদ ঘোষণা ও অনুমোদন করতে হবে। শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। ফ্যাসিস্টদের দোসরদের দ্রুত রাজনীতি নিষিদ্ধ, গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শহীদের রক্তের বিনিময়ে বিপ্লবের সুফল পেতে হলে রাজনীতিকে দুর্বৃত্তমুক্ত করতে হবে। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দখল, ঘুষ-বাণিজ্যের সাথে কোনো আপস নয়। রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করে অর্থ-সম্পদ গড়া এবং পাচার করার দুঃস্বপ্নবাজদের রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠানোর এখনই সময়। রাজনীতিতে তাদেরই স্বাগত জানাতে হবে, যারা নিঃস্বার্থভাবে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ কথা বলার সাহস করেন, ‘এ জীবন-যৌবন, ধন-মান, দেশ-দশের তরে সকলি করিব দান/বিনিময়ে তার যা কিছু পাবো, তা তো দেবেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রহমান।’