উপমহাদেশে ইসলামের আগমন ও আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ওলামায়ে কেরামের অবদান
১৫ মে ২০২৫ ১৫:৪০
॥ ড. মুহাম্মদ খলিলুর রহমান মাদানী ॥
পূর্ব প্রকাশের পর
মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গোহী : হজরত মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গোহী ছিলেন হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর একজন শীর্ষ স্থানীয় ফিকাহবিদ আলেম। তাকে যুগের আবু হানিফা নামে অভিহিত করা হতো। তিনি ছিলেন শতাব্দীর এক কামেল ব্যক্তিত্ব। তার কামালিয়াত ও তরিকতের সাধনা স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে তাকে বিরত রাখেনি। তিনি তরিকত ও জিহাদের ইলম ও অনুপ্রেরণা লাভ করেন ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কীর কাছ থেকে। ইংরেজবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য ১২৭৬ হিজরিতে গ্রেফতার হয়ে তিনি ৬ মাস কারারুদ্ধ থাকেন। মুজাফফরনগর জেল থেকে মুক্তিলাভ করে গঙ্গোহীতেই তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। ১২৯৪ হিজরীতে মাওলানা মুহাম্মদ কাশেম নানাতুবী ও মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে নিয়ে হজে গমন করেন এবং সেখানে ইমদাদ উল্লাহ মুহাজির মক্কীর সাথে কিছুদিন কাটিয়ে দেশে ফিরে আসেন। তিনি পুনরায় ১২৯১ হিজরীতে শেষ বারের মতো হজে গমন করেন। হজের সফরে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয় স্বেচ্ছা নির্বাসিত সিপাহী বিপ্লবের অন্যতম নেতা হাজী ইমদাদ উল্লাহ মুহাজির মক্কীর পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং দেশের আলেম সমাজকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন।
শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান : শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিশিষ্ট সফল রাজনীতিবিদ। ১২৯৪ হিজরী সনে মওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গোহী ও মওলানা মুহাম্মদ কাশেম নানাতুবীর নেতৃত্বে উপমহাদেশের বুজুর্গ আলেমগণের এক কাফেলা পবিত্র হজ সমাপনের জন্য বায়তুল্লাহ শরিফ গমন করেন। শায়খুল হিন্দ এ কাফেলার অন্তর্ভুক্ত হন। হজ সমাপ্ত করে তিনি ১২৯৫ হিজরি সনে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে এসে ওই বছরেই তিনি সামরাতুৎ তরবিয়ত রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করেন।
শায়খুল হিন্দ একদিকে যেমন ছিলেন আধ্যাত্মিক শায়খ,সাথে সাথে তিনি ছিলেন এক সাহসী রাজনৈতিক নেতা। তিনি উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তানায়ক শাহ ওয়ালিউল্লাহ সূচিত আন্দোলনের সফল বাস্তবায়নকারী ছিলেন। তার কূটনৈতিক তৎপরতা ও সময়োচিত সাহসী রাজনৈতিক নির্দেশনা ইংরেজদের মসনদের ভিত নেড়ে দেয় এবং উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সহজ হয়। তিনি জমইয়াতুল আনসার (১৯০৯ খ্রি.) এবং নিয়ারাতুল মায়ারিফ (১৯১৪ খ্রি.) রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করেন। এগুলোর পরিচালনার নেতৃত্বে ছিলেন তার সুযোগ্য ছাত্র মাওলানা উবায়েদুল্লাহ সিন্ধি। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী শায়খুল হিন্দ শেষ জীবনে প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু করেন। এজন্য ইংরেজদের রোষানলে পতিত হয়ে তিন বছর সাত মাস মাল্টায় বন্দী জীবনযাপন করেন। (সংগ্রাম প্রকাশিত: শনিবার ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬, প্রিন্ট সংস্করণ সম্পাদকঃ আবুল আসাদ)।
মাওলানা উবায়েদুল্লাহ সিন্ধি : ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যারা সমগ্র জীবন নিয়োজিত করেছিলেন, মাওলানা উবায়েদুল্লাহ সিন্ধি তাদের মধ্যে এক বিরাট স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি ছিলেন এক মহান বিপ্লবী নেতা। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ পাঞ্জাবের চিয়ানওয়ালী নামক গ্রামে এক শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রাম সিং। মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করার সময় তিনি একজন নও মুসলিমের লেখা ‘তোহফাতুল হিন্দ’ নামক একখানা পুস্তক পাঠ করে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন, পরে ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে পনের বছর বয়সে সিন্ধুর বিখ্যাত সুফী হাফেজ মুহাম্মদ সিদ্দিকের নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন।
তিনি দেওবন্দের মাওলানা মাহমুদুল হাসানের তত্ত্বাবধানে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। পরে তিনি শায়খুল হিন্দের নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের এ দেশ থেকে বিতাড়নের এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কাবুল যান এবং একটি প্রবাসী সরকার গঠন করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাবুল থেকে সীমান্ত প্রদেশ আক্রমণ ও ভিতরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা পাকা পোক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের মাধ্যমে ফাঁস হয়ে পড়ে। পরিণতিতে মওলানা মাহমুদুল হাসান ও তার সঙ্গে মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী গ্রেফতার হয়ে মাল্টা দ্বীপে নির্বাসিত হন।
মাওলানা সিন্ধির পক্ষে তখন কাবুলে অবস্থান নিরাপদ ছিল না বলে তিনি মস্কো হয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে চলে যান। সে সময় ইস্তাম্বুলকেন্দ্রিক ইসলামী খেলাফতের উৎখাত ষড়যন্ত্র প্রবল হয়ে ওঠে। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে খেলাফত উৎখাত হওয়ার পর মওলানা সিন্ধি মক্কায় এসে রাজনৈাতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র মক্কা থেকে দেশে ফিরে এসে পুনরায় প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
মাওলানা সিন্ধি ইউরোপীয় মূলনীতির ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটিয়ে মাতৃভূমিকে ইংরেজদের হাত থেকে মুক্ত করার প্রয়াসী ছিলেন। দীর্ঘদিন নির্বাসনে কাটাবার পর যখন তিনি ভারতে ফিরে এলেন, তখন বঙ্গদেশের জমিয়তে ওলামা তার কলিকাতা অধিবেশনে তাকে সভাপতির ভাষণ প্রদানে আহ্বান জানালে তিনি ভাষণে বলেন, ‘আজকে যে বিপ্লব সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং দিন দিন তার ব্যাপকতর বিস্তৃতি ঘটেছে, তার ক্ষতি থেকে যদি আমার মাতৃভূমি রক্ষা পেতে চায়, তাহলে তাকে ইউরোপীয় মূলনীতির ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটাতে হবে।’ তার এ জাতীয়তাবাদী ধারণাপুষ্ট ভাষণে মুসলমানদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
মুফতি কেফায়েত উল্লাহ (র.) : এ উপমহাদেশকে মুক্ত করতে যারা অবর্ণনীয় জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন তাদের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মনীষী হলেন মাওলানা মুফতি কেফায়েত উল্লাহ (র.)। তিনি ১৮৫৭ সালের ভারতের উত্তর প্রদেশের শাহজাহানপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি উচ্চশিক্ষা লাভ করেন এ উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে। সেখানে তিনি ভারতীয় আলেমকুলের মুকুটবিহীন সম্রাট শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন।
মুফতি মুহাম্মদ কেফায়েত উল্লাহ (র.) তার পরম প্রিয় ওস্তাদ শায়খুল হিন্দের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রেরণা লাভ করেন এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণ শুরু করেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন হযরত শাইখুল হিন্দের চিন্তা ধারারই ধারক ও বাহক।
মুফতি সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে তৎকালীন ভারতীয় আলেম সমাজের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান ‘জমিয়তুল ওলামা’ প্রতিষ্ঠা। তিনি ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে কয়েকজন বিশিষ্ট আলেমদের আন্তরিক সহায়তায় ‘জমিয়তুল উলামা’ গঠন করেন। এ সময় তার ওস্তাদ শাইখুল হিন্দ মাল্টায় বন্দী ছিলেন। ১৯১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জমিয়তের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় পাঞ্জাবের অমৃতসরে। দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২০ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লিতে। ইতোমধ্যে শায়খুল হিন্দ মাল্টা থেকে মুক্তি লাভ করেন। তাকে উক্ত অধিবেশনের সভাপতি মনোনীত করা হয়। কিন্তু তিনি শারীরিক অসুস্থতাহেতু অধিবেশনে যোগ দিতে ব্যর্থ হন। শাইখুল হিন্দ উক্ত অধিবেশনে লিখিত বক্তব্য পাঠান। উক্ত ভাষণে শাইখুল হিন্দ দেশবাসীর সাথে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে যাবার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন এবং খেলাফত কমিটি ও কংগ্রেস পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ একাত্মতা ঘোষণা করেন। এ অবস্থায় মুফতি কেফায়েত উল্লাহ সাহেব জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং উক্ত অধিবেশনে সভাপতি মনোনীত হন। উক্ত অধিবেশনের ১০ দিন পর ৩০ নভেম্বর ১৯২০সালে মাহমুদুল হাসান ইন্তেকাল করেন এবং মুফতি সাহেব জমিয়তে উলামার স্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯২২ সালে আর্য সমাজের নেতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ শুদ্ধি অভিযান নামে একটি অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার মুসলমানকে ধর্মান্তরিত করতে থাকে। তখন মুফতি সাহেব এ ফেতনা থেকে মুসলমানদের হেফাজত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।
খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন কালে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, হিন্দু নেতাদের আন্তরিকতায় মোনাফেকী ও শুদ্ধি আন্দোলনের কারণে সে ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরে। ফলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। ১৯২৯ সালের লাহোর অধিবেশনের পর স্বাধীনতা সংগ্রাম আবার জোরদার হয়। ১৯৩০ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে জমিয়তে উলামা কংগ্রেসের সাথে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তার পর থেকে জমিয়ত স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। হজরত মুফতি সাহেব জমিয়তের সভাপতি হিসেবে এ সকল কর্মসূচি পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৩০ সালের কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলন নেতৃত্ব প্রদানকালে ১১ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। পুনরায় আইন অমান্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে ১৯৩২ সালের ১১ মার্চ তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৮ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৩৯ সালে মুফতি সাহেব ক্রমবর্ধমান শারীরিক দুর্বলতা ও অসুস্থতাহেতু জমিয়তুল উলামার সভাপতির দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। জমিয়তের সভাপতি মনোনীত হন মুফতি সাহেবের জীবনের সাথী মওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানী (র.)। আর এভাবে মুফতি কেফায়েত উল্লাহ স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। (চলবে)