আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন, নিবন্ধন স্থগিত
১৫ মে ২০২৫ ১৫:১৮
স্টাফ রিপোর্টার : অভ্যুত্থান দমাতে ‘গুম, খুন, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, গণহত্যা, বেআইনি আটক, অমানবিক নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাসীকার্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধের’ জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর সব কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। সদ্য সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারার আওতায় এ নিষেধাজ্ঞা জারি করে গত ১২ মে সোমবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। দলটিকে এখন জুলাই আন্দোলন দমনে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। সেজন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ইতোমধ্যে সংশোধন করা হয়েছে।
জুলাই গণহত্যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ ও এর নেতাদের বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ১১ মে শনিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তাঁর সরকারি বাসভবন যমুনায় উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
এর পাশাপাশি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বৈঠকের পর গত ১১ মে শনিবার রাতে উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাকর্মীর নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।’
এদিন রাতে যমুনার সামনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সভার সিদ্ধান্ত জানান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। দেড় মিনিটের বক্তব্যে তিনি সরকারের সিদ্ধান্ত পড়ে শোনান। কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি।
আসিফ নজরুল বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনও অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, এর অঙ্গ সংগঠন ও সমর্থক গোষ্ঠীকে সাজা দিতে পারবে।
আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের আলোকে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। গত ১২ মে সোমবার বিকাল সাড়ে ৫টা থেকে রাত ৯টা ২০ মিনিট পর্যন্ত বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইসি। বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ এ তথ্য জানান। এর আগে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। গত ১২ মে সোমবার বিকালে সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি স্বাক্ষরিত এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধনপ্রথা চালু করে নির্বাচন কমিশন। গত চারটি নির্বাচনে ৫৫টি দল নিবন্ধন পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের নিবন্ধন নাম্বার ৬, প্রতীক নৌকা। নিবন্ধন বাতিলের মাধ্যমে দলটির ভোটে অংশগ্রহণ বন্ধ হয়ে গেল। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে ৪৯টি দল নিবন্ধিত রয়েছে। আওয়ামী লীগ, জামায়াতসহ ছয়টি দলের নিবন্ধন বাতিল রয়েছে।
কমিশন সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছাড়াও নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার ও রহমান মাসউদ উপস্থিত ছিলেন। নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ, আইন শাখার যুগ্ম সচিব ফারুক আহমেদসহ কর্মকর্তারা আইনি দিকগুলো তুলে ধরেন।
নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-এর ৯০(জ) অনুচ্ছেদ দফা ১(খ) অনুযায়ী সরকার ঘোষিত নিষিদ্ধ দলের নিবন্ধন বাতিলের বিধান রয়েছে। আওয়ামী লীগ এর আগে নিবন্ধন শর্ত পূরণ, শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থতা এবং আদালতের নির্দেশে পাঁচটি দলের (জামায়াতে ইসলামী, ফ্রিডম পার্টি, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, পিডিপি ও জাগপা) নিবন্ধন বাতিল করা হয়।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়। নিষেধাজ্ঞার প্রজ্ঞাপন আসায় এখন নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী অধ্যাদেশ-২০২৫ ও সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংগঠনটির সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নিষেধাজ্ঞার প্রজ্ঞাপনে যা বলা হয়, যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এসআরও নম্বর ১৩৭-আইন/২০২৫, তারিখ ১২ মে ২০২৫ মূলে সরকার সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ধারা-১৮(১)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কর্তৃক যেকোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেকোনো ধরনের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, সেহেতু, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন (নম্বর-০০৬ তারিখ : ০৩/১১/২০০৮) এতদ্বারা স্থগিত করল। গত ১২ মে সোমবার সচিবালয়ে এক বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন হয়ে গেছে। অধ্যাদেশ অনুসারে বিষয়টি বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব আমাদের।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য ও ভিন্নমতের মানুষের ওপর হামলা, গুম, খুন, হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন নিপীড়নমূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। দলটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে গুম, খুন, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, গণহত্যা, বেআইনি আটক, অমানবিক নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে এবং এসব অভিযোগ দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উল্লেখিত অপরাধগুলোর অভিযোগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং দেশের ফৌজদারি আদালতে বহুসংখ্যক মামলা বিচারাধীন।
এসব মামলার বিচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, বাংলাদেশের সংহতি, জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার লক্ষ্যে ৫ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কর্তৃক গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, উসকানিমূলক মিছিল আয়োজন, রাষ্ট্রবিরোধী লিফলেট বিতরণ এবং ভিনদেশে পলাতক তাদের নেত্রীসহ অন্য নেতা-কর্মী কর্তৃক সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অপরাধমূলক বক্তব্য প্রদান, ব্যক্তি ও প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের প্রচেষ্টাসহ আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে, দলটি এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের মামলার বাদী ও সাক্ষীদের মনে ভীতির সঞ্চার করা হয়েছে, বিচার বিঘ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং সার্বিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কথা উল্লেখ করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকাসহ জনমনে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশে সন্ত্রাসী সংগঠনের মতো বিভিন্ন বেআইনি কার্যকলাপ ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। সরকার যুক্তিসংগতভাবে মনে করে সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ধারা-১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটি এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সমীচীন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।